পরিবর্তনশীল সমাজের খণ্ডচিত্র হেঁটে চলেছি বন জোছনায়

দিলরুবা আহমেদ আমেরিকা প্রবাসী বাঙালি কথাসাহিত্যিক। দীর্ঘ প্রবাস জীবনে থেকেও তিনি বাংলাদেশের পরিবর্তনশীল সমাজ ব্যবস্থার ওপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখেন, আর তারই প্রতিফলন ঘটে তার লেখায়। হেঁটে চলেছি বন জোছনায় হাতে পাওয়া তার সর্বশেষ উপন্যাস।
সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, পাওয়া-না পাওয়া, ভালোবাসা ও অবহেলা এসব কিছু নিয়েই মানুষের জীবন। মানুষের জীবন থেমে থাকে না। এটা সৃষ্টিকর্তার অবধারিত নিয়ম উপন্যাসটিতে লেখিকা যে চরিত্রগুলোর অবতারণা করেছেন তারা প্রত্যেকেই ওই একই ফ্রেমে বাঁধা। জীবনের বাস্তবতা থেকে কেউই দূরে নয়। পাঠক পড়লেই বুঝতে পারবেন কোনো কল্পকাহিনী স্থান পায়নি উপন্যাসটিতে। এটা লেখিকার একান্তই সৃষ্টিশীলতা। এখানেই তিনি সার্থক। উপন্যাসটিকে তিনি তার কল্পনা ও সৃষ্টিশীলতা দিয়ে বাস্তবতার চাদরে মুড়ে দিয়েছেন।
জীবন মানে যদি শুধুই সুখ হতো তাহলে সৃষ্টি হতো না এত-গল্প, উপন্যাস ও কবিতা। সাহিত্যের ভাণ্ডারে অধিকাংশ জায়গা তখন হয়তো শূন্যতাই দখল করত। রুচিশীলতার নিপুণ হাতে লেখিকা দেখিয়েছেন ভালোবাসার রকমফের আর ছুটে চলা। কন্যার মনে পিতার প্রতি ভালোবাসার যে শাশ্বত উপস্থিতি তার খণ্ড চিত্র উপন্যাসটিকে আরও আবেদনময় করেছে। মমতাজের জীবনের গতিময় ট্রাজেডি, হামিদ সাহেবের প্রগাঢ় ভালোবাসার বলয়ে আবদ্ধ থেকেও মমতাজের কষ্ট যেন আমাদের সমাজেরই একটি বাস্তবচিত্র যা শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের কোথাও না কোথাও এখনও ঘটে। দাদন, আমের, পারুল, বকুল, নেহা, মালবিকা, দুজামাই, রশীদ স্যার সবাই পরিবর্তনশীল সমাজের একটি জীবন্ত চিত্র। তারা সবাই ছুটে চলেছেন জীবনের পরিসমাপ্তির দিকে যেখানে শুধুই সুখ নেই আবার শুধুই দুঃখও নেই। এরা জীবন নামক জোছনায় ফেরারি। সে জোছনায় হেঁটে চলেছে কথাসাহিত্যিক দিলরুবা আহমেদের চরিত্রগুলো। সেদিক থেকে হেঁটে চলেছি বন-জোছনায় নামকরণটি যথার্থ এবং গভীর তাৎপর্যপূর্ণ হয়েছে।
উপন্যাসটি পড়তে গিয়ে বারবারই কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও কবি শামসুর রাহমানের কথা মনে পড়েছে। চরিত্রগুলো রূপায়নে লেখিকা বাংলার যে অবয়বকে বেছে নিয়েছেন তা পড়লে মনে করার উপায় নেই যে দীর্ঘদিন ধরে এ লেখিকা প্রবাসী। সুদূর আমেরিকায় অবস্থান করেও তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন বাংলার পরিবর্তনশীল সমাজব্যবস্থা। ঢাকা শহরে হাতিরঝিলের সৌন্দর্যও তার উপন্যাস থেকে বাদ পড়েনি।
বাইশ বছরের যৌবন যেন কালবৈশাখী ঝড়ের মতো। একদিকে আমেরের দুর্নিবার আকর্ষণ অন্যদিকে নীলাঞ্জনা নামক মায়াবী কণ্ঠের আকর্ষণীয় স্বপ্নের রানীর ফোনালাপ থেকে সৃষ্ট ভালোবাসার মধ্যে এক অদ্ভুত সমীকরণ লক্ষণীয়। মুঠোফোনের জগতে ল্যান্ডফোনের ফোনালাপে সৃষ্ট প্রেম দ্বারা লেখিকা আমেরকে সমাজে কিছুটা বোকা টাইপের ছেলে হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন। কিন্তু নীলাঞ্জনার প্রতি আমেরের অন্তরের আকুতিটুকু শুধু বুঝতে পারবে ভুক্তভোগী শ্রেণির তরুণরা। অন্যদিকে নীলাঞ্জনা খালার কথামতো যে কাজটি অবিরত করে যাচ্ছিল তা যে তার জীবনে বেঁচে থাকার অনেকটাই অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছিল তা না বুঝেছে আমের না বুঝেছে তার খালা। কারণ রশীদ স্যারদের মতো মানুষদের সঙ্গে সমাজের যে মেয়েরা কেবল মাত্র বিবাহযোগ্য হয়ে উঠেছে এবং যারা অপরূপ সুন্দরী সামাজিক পারিপার্শিকতা তাদের বাধ্য করে রশীদ স্যারদের মতো মানুষদের বিয়ে করতে। তাদের বেঁচে থাকার অবলম্বন কী হবে তা নিয়ে কেউ ভাবে না। শেষ পর্যন্ত লেখিকা নীলাঞ্জনা নামক মালবিকার জীবনকে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন যাতে আমেরের জীবনে বিশাল এক ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে।
উপন্যাসের মূল দুটি চরিত্র মমতাজ ও হামিদ সাহেব। একটি প্রেম থেকে একটি সংসার। এখানে প্রেমের জয় দিয়েই শুরু যাদের জীবন অনেকেই ভাববেন তাদের আবার কিসের কষ্ট। যমুনার এপারে দাঁড়িয়ে আজও যদি কেউ ভাবেন, সম্রাট শাহজাহান কী আসলে মমতাজকে ভালোবাসতেন নাকি ঘৃণা করতেন? মমতাজের মনের গহীনে যে কষ্ট লুকিয়ে আছে তা তার পিতার জন্য এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু জীবনের প্রথম বিয়ে, প্রথম স্বামী, প্রথম বাসর সবই কী ঘৃণায় পরিপূর্ণ? হামিদ সাহেব তার জীবনে সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে মমতাজকে জয় করেছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। বড় মেয়ের মুখের দিকে যখন মমতাজ বেগম তাকান তখন কী তিনি সাবেক স্বামীর প্রতি শুধুই ঘৃণা প্রকাশ করেন, নাকি এমন লক্ষ্মী একটি মেয়ে দেয়ার জন্য তার প্রতি কৃতজ্ঞতাও পোষণ করেন তা কিন্তু লেখিকা উপন্যাসে ব্যক্ত করেননি। তিনি শুধু দেখিয়েছেন আগের স্বামীর প্রতি ঘৃণা।
একজন পুলিশ অফিসারের ঢাকা শহরে বাড়ি, গাড়ি, ধন-সম্পদের অভাব নেই আজ এমন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর এক শ্রেণীর সদস্যের বাস্তব চরিত্র উন্মোচন করেছেন অতি সাবধানে। একজন সৎ পুলিশ অফিসার তার বেতনের টাকা দিয়ে ঢাকা শহরে গাড়ি, বাড়ির মালিক হতে পারবে এটা অকল্পনীয়। হামিদ সাহেব তাই-ই হয়েছেন। যদিও তার চরিত্র উপন্যাসে শুধুই সাফল্যের পরিচয়বাহী।
দাদনের স্ত্রী নেহা নামক বউ একটি অসাধারণ সৃষ্টি লেখিকার। পুরো উপন্যাসটি অলংকৃত করেছে নেহা নামক চরিত্রটি। এ চরিত্রটি রূপায়ন করতে গিয়ে লেখিকা যেসব ঘটনার অবতারণা করেছেন তাতে হুমায়ূন আহমেদের কথা মনে পড়ে যায়। কীভাবে সত্য বলার মাধ্যমে নেহা চরিত্রটি শ্বশুর-শাশুড়ির মন জয় করতে পেরেছে তা উপন্যাসটি না পড়লে বোঝা যাবে না। আকলিমার মা চরিত্রটি যেমন উপভোগ্য, তেমনি জামাই চরিত্র রচনায় তিনি অনেক হাসির খোরাক যুগিয়েছেন উপন্যাসে।
পিতার প্রতি কন্যাদের যে ভালোবাসা, দুর্নিবার আকর্ষণ উপন্যাসটিতে তা জোছনার মতো পরিব্যপ্ত। প্রবাসী মেয়েরা কাছে এলে হামিদ সাহেবের ঘর জোছনায় ভরে যায়। এ যেন শাশ্বত বাংলার চিরন্তন রূপ। এখানে হামিদ সাহেবকে সম্রাট শাহজাহান ভাবলেও ক্ষতি নেই। কেন না তার বিরুদ্ধে তার স্ত্রী, কন্যাদের কোনো অভিযোগ নেই। হামিদ সাহেবের শেষ পরিণতি উপন্যাসটিকে আরও মর্মান্তিক করে তুলেছে।
দিলরুবা আহমেদের ৯৬ পৃষ্ঠার উপন্যাসটির প্রচ্ছদ দৃষ্টিগ্রাহ্য। উন্নতমানের কাগজে ছাপা। প্রকাশক : আয়েশা হক শিমু, শৈলী প্রকাশন, ৫ সিডিএ বা/এ, মোমিন রোড, চট্টগ্রাম।
মোঃ রাশেদুল কবির আজাদ

No comments

Powered by Blogger.