প্রতিদিনই সচেতন থাকতে হবে

অটিস্টিক শিশুর মা-বাবার কাছে প্রতিটি দিনই যেন সচেতনতা দিন বা দিবস। তাদের জন্য হয়তো ২ এপ্রিল বিশেষ কোনো তাৎপর্য বহন করে না। তবে একদিন নিশ্চয়ই করবে, যখন সমাজের প্রতিটি স্তরে প্রায় সব সচেতন ব্যক্তি দায়িত্বশীল হয়ে এগিয়ে আসবেন তাদের পাশে, উপলব্ধির ছায়া ছড়াবে বিভিন্নভাবে। আজ সেই বিশেষ দিনটি ‘বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস’ সারা বিশ্বে একই সঙ্গে পালিত হচ্ছে। এটি সপ্তম বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, যেন আপনার চারপাশের কেউ না কেউ অটিস্টিক শিশুর মা-বাবা। আপনার বলয়ের কোনো না কোনো বৃত্তে তার অবস্থান। বছরের এই একটি দিনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে যদি তাদের কথা মনে করে কোনো আশা বা অঙ্গীকার করা হয়, সে-ই বা কম কী! এই একটা দিন তাদের সম্পর্কে জানবেন, পড়বেন, একটু-আধটু সাংগঠনিক সহায়তার হাত বাড়াবেন—এভাবেই শুরু হোক সচেতনতা। আর এই হাত যদি হয় বিশেষ বা বিশিষ্ট কোনো হাত যেমন সরকারের হাত, লেখক, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিল্পী-সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের হাত, তাহলে তাদের মধ্য থেকেও কোনো একদিন বেরিয়ে আসতে পারে পৃথিবীকে দেওয়ার মতো বিশেষ কোনো মানুষ। হোক না সে অটিস্টিক মানুষ, সাধারণ প্রবাহ থেকে একটু আলাদা। অটিজমধারার মধ্যে ছিলেন এবং আছেন অনেক নামীদামি বিজ্ঞানী ও শিল্পী।
অটিস্টিক মানুষগুলো চলন-বলনে একটু আলাদা, কোথাও বিশেষ ভিন্নতা থাকে। অটিজম কোনো অসুখ নয়। তাদের মস্তিষ্কের কোথাও একটু আলাদা করে বানিয়েছেন সৃষ্টিকর্তা। সে আমাদের মতো গুছিয়ে, বুঝিয়ে কথা বলতে পারে না। তার অর্থ এই নয় যে সে আমাদের কথা বোঝে না। বলার আগেই সে হয়তো আমাদের বুঝতে পারে, আমরা হয়তো তা বুঝি না। অনেক অটিস্টিক শিশুকে দেখেছি, যারা যেকোনো সালের যেকোনো তারিখ অর্থাৎ কী বার ছিল বা হবে, বলে দিতে পারে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে। আপনি অনেক চেষ্টা করে দেখুন তো পারেন কি না? এমনকি দু-চার মাস সামনের বা পেছনের কোনো দিনের?  অটিস্টিক শিশুরা কম কথা বলে, সবার মধ্যে থেকেও সে যেন নিজের মধ্যে থাকে। সব কথার উত্তর সে দেয় না বা দিতে চায় না আবার আমাদের মতো গুছিয়ে উত্তর দিতে পারেও না। একাকিত্ব পছন্দ করে। সবকিছুতে তার মেনে নেওয়া রুটিন মেনে চলতে চায়। তাদের সুনির্দিষ্ট পছন্দ থাকে। হতে পারে সেটা কোনো নির্দিষ্ট খেলনা, খেলা, মিউজিক; আর খাবারের বেলায় তো আছেই। তাদের মধ্যে একটি শিশুকে দেখেছি, সে খেলনা কি-বোর্ড দিয়ে গানের ও ছড়াগানের মিউজিক বাজাচ্ছে। কারও কাছ থেকে সে শেখেনি কোনো দিন। বলুন তো, ওই শিশুটিকে সামাজিক প্রতিষ্ঠা দেওয়ার মতো কোনো প্রতিষ্ঠান কি আমরা দিতে পারব? কে দায়িত্ব নেবে তার?
তাদের দিয়ে ক্লাসের স্বাভাবিক কারিকুলাম পড়িয়ে নিয়মিত পরীক্ষার মাধ্যমে শ্রেণী উত্তরণ না-ও হতে পারে। নিয়মিত অঙ্ক বা সমাজবিজ্ঞান সে না-ও করতে চাইতে পারে বা না-ও পারতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাদের জন্য তো এখনো তেমন কোনো সরকারি স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান হয়নি, যেখানে তাদের অবস্থা অনুযায়ী পারদর্শিতামতো পড়াশোনা এবং পারঙ্গমতার ব্যবস্থা করা যাবে। আগেই বলেছি, অটিজম কোনো রোগ নয় বা মানসিক ব্যাধি নয়। মস্তিষ্কের গঠনমূলক সমস্যা। এতটাই সূক্ষ্ম যে কোথায় কেমন সমস্যা, যা এখনো সঠিকভাবে নিরূপণ করা যায়নি। আমরা যেমন একসঙ্গে দু-তিনটি কাজের সমন্বয় ঘটাতে পারি, তারা পারে না। তারা সিঙ্গেল ট্র্যাকের হয়ে থাকে। তাদের সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ দেখিয়ে একটু সময় নিয়ে গুছিয়ে-বুঝিয়ে অনেক কিছু করানো সম্ভব। একা একা নিজের মধ্যে থাকতে পছন্দ করে বলে তাদের সবার কাছ থেকে আলাদা করে রাখলে আরও ক্ষতি হবে তাদের। অনেক বাবা-মা তাদের সবার মধ্যে নিয়ে যেতে বা পরিচয় করিয়ে দিতে লজ্জা বোধ করেন। তাতে তাদের আরও ক্ষতি হলো। তাদের সামাজিক নিয়মাবলির সঙ্গে আরও পরিচয় করিয়ে দিতে হবে প্রতিনিয়ত।
এই অটিজম সচেতনতা দিবসে আমরা সব অভিভাবক, শিক্ষক একটা মননশীল কাজ করতে পারি। প্রতিটি স্বাভাবিক শিশুকে ঘরে ও স্কুলে-ক্লাসে অটিজম সম্পর্কে জানাতে পারি। প্রত্যেক মা জানবেন এবং জানাবেন, আপনার স্বাভাবিক শিশুটিকে যেন অটিস্টিক শিশুটির সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করে, বরং অন্য সব স্বাভাবিক শিশুর চেয়ে একটু বেশি গুরুত্ব দিয়ে মেশে। কখনো যেন তাকে আলাদা প্রমাণ করে ভর্ৎসনা না করে। এই ছোট্ট সচেতনতাটুকু শিশুদের অর্থাৎ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সম্মুখে এগিয়ে নিয়ে যাবে, দেশ এগোবে। আপনার অটিস্টিক শিশুকে বেশি বেশি সময় দিন। একই শব্দ অনেক অর্থ বহন করে, এমন শব্দ ব্যবহারে তাদের সঙ্গে সতর্ক থাকুন। মনে রাখবেন, গুছিয়ে ভাষার মাধ্যমে নিজেকে প্রকাশ করা তাদের জন্য কঠিন। ব্যবহারিক ভাষা তাদের জন্য সহজ এবং সহজে সেগুলো গ্রহণ করে।  মনে রাখবেন, তাদের মধ্য থেকেই এসেছেন বিশিষ্ট মনীষীরা—আলবার্ট আইনস্টাইন, আইজ্যাক নিউটন, মোজার্ট, চার্লস ডারউইন, হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যান্ডারসন, মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর মতো অনেকে।
শামসুদ্দোহা সেলিম: চিকিৎসক ও কবি।

No comments

Powered by Blogger.