একদিকে পঙ্গুত্ব অন্যদিকে গ্রেপ্তার-বাণিজ্য

শিরোনামটি দুটো বাংলা দৈনিকের ইদানীং পৃথক খবর থেকে নেওয়া। আলোচনার অপেক্ষা রাখে না, ২০১৩ সালটি আমাদের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির জন্য চ্যালেঞ্জস্বরূপ ছিল। রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকত প্রায় প্রতিনিয়ত। আর এসব কর্মসূচি সহিংস হয়ে যেত অনেক ক্ষেত্রেই। বলা বাহুল্য, কর্মসূচির মোকাবিলায় মূল দায়িত্বে ছিল পুলিশ। আবার কর্মসূচি ছাড়াই টহলরত পুলিশের ওপর হামলার নিন্দনীয় রেওয়াজও চালু হয়ে পড়েছিল। সংবাদপত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুসারে, ওই বছর এসব হামলায় নিহত হয়েছেন ১৫ জন পুলিশ সদস্য। আহত প্রায় আড়াই হাজার। তার মধ্যে গুরুতর আহত তিন শ; যাদের মধ্যেও হাত, পা, চোখ হারিয়ে পঙ্গুত্বের পথে আছেন দেড় শতাধিক। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, এঁদের মধ্যে একজন ছাড়া কাউকে বিদেশে পাঠিয়ে চিকিৎসা করানো হয়নি। লাগানো হয়নি কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। এই অবস্থায় তাঁরা হতাশ। দিশেহারা স্বজনেরা। এগুলো স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। আরও জানা যায়, তাঁদের স্বজনেরা সুচিকিৎসার দাবিতে দ্বারে দ্বারে ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছেন। এ ধরনের পঙ্গুত্বের আশঙ্কায় যাঁরা আছেন, তাঁদের মধ্যে কনস্টেবল থেকে উচ্চশিক্ষিত সাব-ইন্সপেক্টরও রয়েছেন। পাশাপাশি এক দিনের ব্যবধানেই অন্য দৈনিকে আরেকটি খবর শতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। অভিযোগ হচ্ছে, আটকের পর টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার। জানা যায়, এ ধরনের অভিযোগসংবলিত একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
এ প্রতিবেদনে উল্লিখিত পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন এসপি থেকে কনস্টেবল পর্যন্ত। এমনকি রাষ্ট্রপতি পদক পাওয়া পুলিশ সদস্যের নামও আছে এ তালিকায়। জানা যায়, অর্থের বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে, টাকা লেনদেন কখনো সরাসরি আর বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দালাল বা মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে হয়েছে; হয়েছে জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও অসাধু সাংবাদিকদের মাধ্যমেও। যেহেতু প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সুনির্দিষ্ট তথ্যসংবলিত অভিযোগটি পাঠানো হয়েছে, তা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে। আশা করা যৌক্তিক হবে যে পক্ষপাতহীন জরুরি তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দুটো বিষয়ই একইভাবে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার মতো। প্রথমত দেড় শ গুরুতর আহত পুলিশ সদস্যের সুচিকিৎসায় অবজ্ঞার বিষয়টি আলোচনা করা যাক। এসব পুলিশ সদস্য রাষ্ট্রের পক্ষে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আজ বিপন্ন। কারও বা হাতের কবজি উড়ে গেছে, কেটে ফেলতে হয়েছে কারও পা আর চোখ নষ্ট হয়ে গেছে কারও। দৈনিকটির প্রতিবেদন অনুসারে, পুলিশের এ ধরনের সদস্যের সংখ্যা দেড় শ। এঁদের উপযুক্ত চিকিৎসা না হওয়াটা অত্যন্ত দুঃখজনক বললেও কম বলা হবে। তাঁদের শারীরিক বিকলাঙ্গতাকে ঠিক পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা কতটা সম্ভব আর ব্যয়ই বা কত, তা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। আমাদের সরকারের আর্থিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
তা সত্ত্বেও এ ধরনের ভাগ্যহত জনসেবকেরা রাষ্ট্রের সম্ভাব্য সর্বাধিক সহায়তা আশা করতে পারেন। তাঁদের প্রতি যথোপযুক্ত দায়িত্ব পালন না করলে জাতি হিসেবে আমরা দায়ী থাকব। তাই উদারতার সঙ্গে বিষয়টি দ্রুত বিবেচনায় নেওয়া আবশ্যক। তাঁদের প্রতি উপযুক্ত মনোযোগের অভাব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। যতজনের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে তাঁদের সবার বিদেশে দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার দরকার নাও হতে পারে। কারও চিকিৎসা হয়তোবা দেশেই করা যায়। বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখা দরকার। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের যথোপযুক্ত আর্থিক সহায়তা নিশ্চিত করার আবশ্যকতা রয়েছে। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে, গেছে অমূল্য সময়। তবু বিষয়টি পুলিশ সদর দপ্তরের অগ্রাধিকার তালিকায় রাখার আবশ্যকতা রয়েছে। গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের যে চিত্রটি আলোচ্য প্রতিবেদনে এসেছে, তা বাস্তবে খুবই ক্ষুদ্র একটি নজির। কোথাও একটি দাঙ্গা-হাঙ্গামা হলো। এজাহারে নাম থাকে ১০-১৫ জনের। আর অজ্ঞাত দেখানো হয় দুই-তিন হাজার। এজাহারে এরূপ হতেও পারে। অভিযোগ রয়েছে, অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তারের আগে ঘটনার সঙ্গে তাদের প্রকৃত সংশ্লিষ্টতা তলিয়ে না দেখে কোনো কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যাকে ইচ্ছা তাকেই গ্রেপ্তার করে থাকেন। ক্ষেত্রবিশেষে বাণিজ্যের অভিযোগও থাকে। এজাতীয় অভিযোগ সম্পর্কে দ্রুত বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। এরূপ চলতে থাকলে প্রকৃত অপরাধী রয়ে যেতে পারে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এজাতীয় ক্ষেত্রে সরকারি দলের পরিচয় ও আনুকূল্য নিয়ে কিছু লোকও নেমে পড়েন। তাঁদেরও উদ্দেশ্য বাণিজ্যের ভাগ।
আর এঁদের পাশে পেয়ে পুলিশের সদস্যরাও অনুপ্রাণিত হন। প্রসার ঘটে বাণিজ্যের। এটা সত্যি আর বাস্তব যে এজাহারে নাম থাকলেই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থাকবে, এমনটা নাও হতে পারে। আর নাম না থাকলেও সংশ্লিষ্ট থাকতে পারেন কেউ কেউ। তাই পুলিশের পক্ষে ছকবাঁধা পথে চলার সুযোগ নেই। কোনো কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশ সাময়িকভাবে তাদের হেফাজতে নিতে পারে। প্রাথমিক অনুসন্ধানে নিরপরাধ মনে হলে ছেড়ে দেওয়াই সংগত। আর অপরাধ করেছে মনে হলে আদালতে সোপর্দ করতে হবে। এগুলো সবই আইন আর প্রবিধানের কথা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে এসব ভালো ভালো কথা এখন বেশ কিছু ক্ষেত্রে কেতাবেই সীমাবদ্ধ থাকছে। কিছু পুলিশ সদস্যের বাণিজ্যের দুর্নিবার স্পৃহায় অপরাধী সমাজে বুক উঁচিয়ে চলে। নিরপরাধ ব্যক্তি সাময়িকভাবে হলেও করে হাজতবাস। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। আইনের জ্ঞান, নৈতিকতা আর মানবিক গুণাবলিসম্পন্ন পুলিশও সদস্যও অনেক রয়েছেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের সমাজের অবক্ষয়ের ছাপ এ বাহিনীর সদস্যদের ওপরও পড়েছে। তদুপরি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ আর বদলি থেকে পদোন্নতি চেইন অব কমান্ডকে করে ফেলেছে বিপন্ন। এতে ক্ষেত্রবিশেষে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নজরদারি বা নির্দেশনাও উপেক্ষিত হয়। আর তাঁদের নজরদারিতে ক্ষেত্রবিশেষে সময়ে সময়ে শৈথিল্যের অভিযোগও আসে। যে প্রতিবেদনটির বিষয় ওপরে আলোচিত হলো, সেখানে মূলত জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়টিই মুখ্য। এসব সংগঠনের কোনো নেতা-কর্মী ধর্তব্য অপরাধ করে থাকলে তাঁদের গ্রেপ্তার করাই যৌক্তিক। একইভাবে অন্য কোনো দলের নেতা-কর্মী বা নির্দলীয় কেউ তা করলেও আইনের একই বিধান প্রযোজ্য হওয়ার কথা।
আর এ ধরনের কোনো অপরাধ না করলে নিছক কোনো দল করার জন্য কাউকে গ্রেপ্তারের কোনো কারণ থাকতে পারে না। তবে একটি বিষয় সাম্প্রতিক কালে নজরে এসেছে। গত বছরটিতে সহিংস আন্দোলন-সংগ্রামে পুলিশ আক্রান্ত হয়েছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে। পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে কোথাও কোথাও। এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হয়েছে বিনা প্ররোচনায়। এ ধরনের ঘটনায় এজাহারভুক্ত বা সন্দেহভাজন আসামিদের কারও প্রতি পুলিশের কোনো সদস্যের অতি নমনীয় নীতির বিবরণ সংবাদপত্রে এসেছে। এসেছে ভূমি ক্রয়ের আড়ালে বাণিজ্যের অভিযোগ। এজাতীয় ঘটনা কিন্তু ঘটে চলছে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আর দেশের সর্বত্র। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় সংকলিত প্রতিবেদনটি এর একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ মাত্র। এজাতীয় সংবাদ বেদনাদায়ক। যাঁরা কোনো পুলিশ সদস্যের হত্যা কিংবা জখম সংক্রান্ত মামলার আসামি, তাঁদের অপরাধ প্রমাণে উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহে পুলিশের বরং তৎপর হওয়াই স্বাভাবিক। শুধু গ্রেপ্তার নয়, প্রকৃত অপরাধীকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করাতে হলে বাদীপক্ষের সর্বাত্মক প্রচেষ্টা দরকার। নচেৎ গ্রেপ্তার করা হলেও প্রমাণের অভাবে তাঁদের খালাস পাওয়ার সম্ভাবনাই থেকে যায়। কিন্তু যেখানে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে অনীহা কিংবা ছাড় দেওয়া, সেখানে মামলা প্রমাণে সে কর্মকর্তারা সচেষ্ট হবেন, এমনটি আশা করার কোনো কারণ দেখা যায় না। তাঁদের চোখ থেকে হয়তোবা অপসৃত নিহত কিংবা পঙ্গুত্বের পথগামী তাঁদের সহকর্মীরা। যাঁরা রাষ্ট্রের প্রয়োজনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থেকে পঙ্গুত্বের পথে, তাঁদের দ্রুত সুচিকিৎসা করানো রাষ্ট্রের দায়। তেমনি এসব ঘটনার জন্য যারা দায়ী কিংবা এ দেশের বায়ু যারা বিষাক্ত করছে আর নেভাতে চাইছে আলো, তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণে শৈথিল্য অগ্রহণযোগ্য।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.