হয়রানিই যেখানে নিয়ম by সোলায়মান তুষার

মো. রফিকুল ইসলাম। নেত্রকোনার কেন্দুয়া কাওড়া আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ে ১০ বছর শিক্ষকতা করেছেন। বেতন-ভাতাও পেয়েছেন। এরপর কাচিমপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার প্রক্রিয়া চলছিল।
এরই মধ্যে আগের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জসিম উদ্দিন অভিযোগ আনেন রফিকুল ইসলাম ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। ব্যাংক লোন মেরে দেয়ারও অভিযোগও আনা হয় তার বিরুদ্ধে। বরখাস্ত হন রফিকুল ইসলাম। নেত্রকোনা-৩ আসনের তৎকালীন এমপি মঞ্জুর কাদের কোরাইশীও জসিম উদ্দিনের পক্ষ নেন। তদন্ত কমিটি গঠন করে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। অধিদপ্তরের উপপরিচালক আবুল হোসেন (মাদরাসা) ওই ঘটনার তদন্ত করেন। তদন্তে রফিকুল ইসলাম নির্দোষ প্রমাণিত হন। এ খবর নেত্রকোনায় পৌঁছলে সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের কোরাইশী ক্ষেপে যান। তিনি মাউশিতে আসেন। উচ্চস্বরে কথাবার্তা বলেন মাউশির কর্মকর্তাদের সঙ্গে। কর্মকর্তারা বলে দেন রফিকুল ইসলামের সব কাগজপত্রই ঠিক। কিন্তু মুক্তি মিলেনি রফিকুল ইসলামের। দীর্ঘদিন ধরে বেতন-ভাতা বন্ধ।  এ পর্যন্ত শিক্ষা ভবনে এসেছেন ২০ থেকে ২৫ দিন। কিন্তু তার বেতন চালু হয়নি। এভাবে হাজার শিক্ষক-কর্মকর্তা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষাভবনে এসেও তাদের নিরাশ হয়ে ফিরতে হচ্ছে। কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ। ঘুষ না দিলে কেউ কাজ করতে চান না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, কেন্দুয়া কাওড়া আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. জসিম উদ্দিন সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের কোরাইশীর ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন দু’বছর। ওই সময় তিনি স্কুলে যেতেন না নিয়মিত। হঠাৎ একদিন গিয়ে স্বাক্ষর করতেন। বেতন-ভাতা ঠিকই নিতেন। স্থানীয় একটি নির্বাচনেও অংশ নিতে চেয়েছিলেন তিনি। রফিকুল ইসলাম তাতে সমর্থন করেননি বলে ক্ষেপে গিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। রফিকুল ইসলাম বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না দীর্ঘদিন ধরে। সংসার চলে না। সংসারে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭। সারাদিন তাকে টিউশনি করতে হয়। ফাঁকে আবার মাউশিতে আসতে হয়। ২৫শে ফেব্রুয়ারি দুপুরে শিক্ষা ভবনে দেখা হয় এ প্রতিনিধির সঙ্গে। এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় হাঁটাহাঁটি করছেন। বলেন, বয়স হয়ে গেছে। বিনা দোষে আমাকে কষ্টের শিকার হতে হচ্ছে। নেত্রকোনা-৩ আসনের সাবেক এমপি মঞ্জুর কাদের কোরাইশী বলেন, আমি শিক্ষা ভবনে রফিকুল ইসলামের বিষয়ে খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম এটা সত্য। তিনি ভুয়া কাগজপত্র দিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। ব্যাংকের টাকা মেরে দিয়েছেন। তবে মো. জসিম উদ্দিন তার ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন। বলেন, এমনিতেই মাঝেমধ্যে দায়িত্ব পালন করতো। তবে অধিদপ্তরের উপপরিচালক (মাদরাসা) আবুল হোসেন বলেন, শিক্ষক রফিকুল ইসলামের কাগজপত্রে কোন ক্রটি নেই। তিনি ভুয়া কাগজ দিয়েও এমপিওভুক্তি হননি। তার বিরুদ্ধে ব্যাংকের টাকা মেরে দেয়ারও প্রমাণ মেলেনি। বরং, প্রধান শিক্ষকেই অসাধু মনে হয়েছে। তিনি বলেন, একদিন মঞ্জুর কাদের কোরাইশী এসে আমাকে জিজ্ঞেস করেন রফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ কেন প্রমাণিত হলো না, জবাবে আমি বলি তার সব কাগজপত্র ঠিক আছে এজন্য প্রমাণিত হয়নি।
মো. সবুজ মিয়া দারুল ইহসান ইউনিভার্সিটি থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগ থেকে ডিপ্লোমা সার্টিফিকেট নিয়ে নেত্রকোনার দুর্গাশ্রম উচ্চ বিদ্যালয়ে গ্রন্থাগারিক হিসেবে যোগ দেন। এরপর কেটে গেছে দু’বছর। তিনিও এসেছেন তার এমপিওভুক্তির খবর নিতে। কিন্তু কোন আশার বাণী শুনতে পাননি তিনি। শামছুল আলম পটুয়াখালীর খেপুপাড়া হাইস্কুলের শিক্ষক। তার ভাইয়ের স্ত্রী রিপা আক্তার খেপুপাড়া ডিগ্রি কলেজে কেরানি পদে কাজ করছেন কয়েক বছর ধরে। তার এমপিওর খবর নিতে এসেছেন শামছুল ইসলাম। তাকে শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তারা নানাভাবে ঘোরাচ্ছেন। আজ এ কাগজ, কাল ওই কাগজ বলে কয়েক বছর কেটে গেছে। কিন্তু এমপিওভুক্তির কোন খবর নেই। সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জের পাংশী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এসেছেন তার প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষকের এমপিওভুক্তির খবর নিতে। সেটিও হয়নি। নেত্রকোনার একটি ফাজিল মাদরাসার তিনজন শিক্ষক একই সঙ্গে টাইম-স্কেলের আবেদন করেন কয়েকমাস আগে। এর মধ্যে একজনের টাইম-স্কেল হয়েছে গত জানুয়ারি থেকে। বাকি দু’জনের হয়নি। তাদেরও বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। এ কাগজ নেই সেই কাগজ বলে একেক দিন আসতে বলা হয়। এ পর্যন্ত এমপিওভুক্তির কাগজই দিয়েছেন তিনবার। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যার টাইম-স্কেল হয়েছে তিনি শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তাদের ১০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন। শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তাদের ঘুষ বাণিজ্যের কারণে নাটোরের শালেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ইসলাম হোসেন ২০১১ সালের জুন থেকে বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না। তিনি ২০০৫ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০১০ সালের ৯ই মে ওমর আলী নামের এক ব্যক্তি গভর্নিং বডির সভাপতি হন। সভাপতি হয়ে ১৫ই মে এক সভা আহ্বান করে অবৈধভাবে ইসলাম হোসেনকে সরিয়ে দিয়ে তার আপন ভাই এনামুল হককে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেন। শিক্ষা ভবনের কর্মকর্তারা মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে এনামুল হককে বৈধতা দেন। সেই থেকে ইসলাম হোসেন স্কুলছাড়া। বর্তমানে তিনি স্কুলে যেতে পারেন না। এমপিও বন্ধ। সংসারে চলছে অভাব-অনটন। মাঝে কিছুদিন এমপিওর টাকা পেয়েছিলেন। বর্তমানে তা-ও বন্ধ। বর্তমানে স্কুলে কোন কমিটিও নেই। ইসলাম হোসেন সুদূর নাটোর থেকে এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৪০ বার এসেছেন শিক্ষাভবনে। কয়েকজনকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা ঘুষ দিয়েছেন। আজ করে দেবো, কাল করে দেবো তাকে ঘোরাচ্ছেন। ইসলাম হোসেন বলেন, সংসার চলছে না। কয়েক দিন পরপরই শিক্ষাভবনে আসি খোঁজ নিতে। আমি বৈধ প্রধান শিক্ষক। অথচ আমাকে সরিয়ে অবৈধভাবে একজনকে নিয়োগ দেয়া হয়। তাকে বৈধতা দেন শিক্ষাভবনের কর্মকর্তারা। এটা মেনে নেয়া যায় না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, আমরা চেষ্টা করছি যাতে কেউ হয়রানির শিকার না হয়। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিষয়ে আমাদের অবস্থান জিরো টলারেন্স নীতি। প্রমাণ পেলেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ শিক্ষা ভবনে দেশের ৩০ হাজার মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, এবতেদায়ী, দাখিল ও আলিম মাদরাসার প্রায় ১০ লাখ শিক্ষক-কর্মচারী-কর্মকর্তাকে আসতে হয় বিভিন্ন কাজে।

No comments

Powered by Blogger.