দূরদেশ- ওবামার আফগান দোলাচল by আলী রীয়াজ

আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনাদের ২০১৪ সাল শেষ হওয়ার আগেই প্রত্যাহার করা হবে, এটা নতুন বিষয় নয়। কিন্তু গত মঙ্গলবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন তাঁর প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে ‘সব সেনা’ তুলে আনার প্রস্তুতি নিতে বললেন,
তখন তা সারা দুনিয়ার গণমাধ্যমের প্রধান সংবাদে পরিণত হলো। তার কারণ হলো, এটা কখনোই ভাবা হয়নি সত্যি সত্যি সব মার্কিন সেনা তুলে নেওয়া হবে। সামরিক ভাষায় যাকে ‘জিরো অপশন’ বলা হচ্ছিল, সেটাই যে শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে, তা প্রায় কেউই ভাবেননি। এই খবরের পাশাপাশি দুটো প্রশ্ন উঠছে—প্রথমত, ওবামা কি সত্যি সত্যি ‘জিরো অপশন’ বেছে নিলেন বা নিতে বাধ্য হলেন? দ্বিতীয়ত, যদি সব মার্কিন সেনা তুলে নেওয়া হয়, তার আশু পরিণতি কী হবে?
২০১১ সালের গ্রীষ্মকালে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা যখন ঘোষণা করেন যে যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে তার সেনাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবে, তখন থেকেই সেটা সবার জানা বিষয়। এই ঘোষণার পর ২০১২ সালের মে মাসে ন্যাটোর শীর্ষ বৈঠক হয় শিকাগোতে। সেখানেও এই পরিকল্পনাই অনুমোদিত হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে ২০১৩ সালের মাঝামাঝি নাগাদ ন্যাটোর সেনারা সব ধরনের যুদ্ধাভিযানের দায়িত্ব আফগানিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে সমর্পণ করবেন এবং সে সময় যে এক লাখ ৩০ হাজার সেনা ছিলেন, তাঁদের অধিকাংশ ২০১৪ সালের ডিসেম্বরের মধ্যেই নিজ নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হবে। ওই বছরের জুলাইতে টোকিওতে যে ৭০-জাতি বেসামরিক ও কূটনৈতিক বৈঠক হয়, তাতে বলা হয় যে সেনা প্রত্যাহারের পাশাপাশি আফগান বাহিনীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বছরে চার বিলিয়ন ডলার করে দেওয়া হবে। সেখানে আরও শর্তসাপেক্ষ উন্নয়ন সাহায্যেরও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল।

সেনা প্রত্যাহার বিষয়ে কোনো রকম দ্বিমত বা সংশয় না থাকলেও ধারণা করা হচ্ছিল, সব সেনা প্রত্যাহার হবে না, কিছু সেনা সেখানে থাকবে। এই কিছুর সংখ্যাটা কত হবে সে বিষয়ে গত কয়েক বছরে বিস্তর আলাপ-আলোচনা হয়েছে। ২০১৩ সালে এই নিয়ে আলোচনার সময় আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাধ্যক্ষ জেনারেল জন এলেন পরামর্শ দিয়েছিলেন যে ছয় হাজার থেকে ১৫ হাজার মার্কিন সেনা আফগানিস্তানে রাখা দরকার, যাতে করে তাঁরা আফগানদের প্রশিক্ষণ দিতে পারেন এবং সাহায্য করতে পারেন। কিন্তু ওবামা প্রশাসন এ রকম ইঙ্গিত দিয়েছিল যে এই সংখ্যা হবে আড়াই হাজারের মতো। ২০১৪ সালের গোড়ায় মার্কিন সেনার সংখ্যা ছিল ৩৮ হাজার।
এই সেনাদের আফগানিস্তানে থাকার আইনগত ভিত্তি তৈরি করার জন্য দরকার যুক্তরাষ্ট্র ও আফগানিস্তানের মধ্যে একটি প্রতিরক্ষা চুক্তি সম্পাদন হওয়া। এই নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল, গত বছরের মাঝামাঝি একটা খসড়াও তৈরি হয়েছিল। এই চুক্তিতে বলা হয়েছিল যে যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা ২০২৪ সাল পর্যন্ত এবং দরকারে তার বেশি সময় ধরে তাঁদের ঘাঁটিতে অবস্থান করতে পারবেন এবং সন্ত্রাস দমনের কাজে সেসব ঘাঁটি ব্যবহার করতে পারবেন। এই চুক্তির কিছু কিছু ধারা নিয়ে দুই পক্ষেরই আপত্তি ছিল। কিন্তু আফগান প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে এই চুক্তি সম্পাদনে দেরি করে আসছিলেন। দেশের ‘লয়া জিরগা’ এই চুক্তির ব্যাপারে তাদের সম্মতি দেওয়ার পরও কারজাই এ নিয়ে দীর্ঘসূত্রতার পথ থেকে সরে না আসায় যুক্তরাষ্ট্র হুমকি দিয়ে আসছিল যে সব সেনা তুলে নেওয়া হবে।
সব সেনা তুলে নেওয়া হলে আফগান সরকার ক্রমাগতভাবে শক্তিশালী হয়ে ওঠা তালেবানের মোকাবিলা করতে পারবে কি না, এ বিষয়ে সামরিক বিশ্লেষকদের মনে রয়েছে গভীর সংশয়। সে কারণে ধারণা করা হচ্ছিল যে কারজাই কোনো অবস্থাতেই সব মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঝুঁকি নেবেন না। তিনি সম্ভবত এই নিয়ে আলোচনায় মার্কিনদের কাছ থেকে আরও কিছু সুবিধা নিতে চাইছেন। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রও এই মুহূর্তে আফগানিস্তান থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহার করতে চাইবে না। কেননা, আফগানিস্তানের ঘাঁটিগুলো থেকেই তারা পাকিস্তানের দুর্গম অঞ্চলে তালেবানের ওপর ড্রোন হামলা চালিয়ে আসছে। এই যুদ্ধে প্রায় আড়াই হাজার মার্কিন সেনা নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন কয়েক হাজার। অধিকাংশ মার্কিন নাগরিক এখন যেমন এই যুদ্ধ সমর্থন করেন না, তেমনি তাঁরা চান না এই অঞ্চলে এমন এক অবস্থা তৈরি হোক যে সেখান থেকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীরা আবারও মার্কিন নাগরিকদের ওপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করতে পারে।
ওবামা যখন মঙ্গলবার আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাইকে সব সেনা প্রত্যাহারের সম্ভাবনার কথা জানান এবং মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়কে এই মর্মে প্রস্তুতি নিতে বলেন, তখন বোঝা যায় যে ওবামা এই পথ নিতে প্রস্তুত আছেন। একার্থে সেটা তাঁর পছন্দনির্ভর নয়, কেননা কোনো রকম চুক্তি না হলে তাঁর আর কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে তাঁর আশু প্রতিক্রিয়া কী হবে, সেটাই এখন প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়ে উঠছে। গত এক-দেড় বছরের আলোচনায় এই দিকটি নিয়ে কিছু আলোচনা হলেও তা খুব গভীরভাবে বিবেচনা করা হয়নি। কেননা, সবাই আশা করছিলেন যে এই অবস্থার উদ্ভব ঘটবে না। তবে এসব আলোচনায় যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে তা হলো, এর সবচেয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়বে পাকিস্তানের ওপর। অনেকের আশঙ্কা যে আফগানিস্তান হয়ে উঠবে পাকিস্তানি জঙ্গিদের অভয়ারণ্য। তারা আফগানিস্তানকে ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তানের একটা অংশে তাদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারবে। পাকিস্তানি প্রশাসনের একটি বড় অংশই এখন অনুধাবন করতে পারছে যে তালেবান নেতারা এবং তাঁদের জঙ্গিদের সাহায্য করার পরিণতি ভালো হয়নি, এখন তাঁদের ঘরের শান্তি বিপন্ন, জাতীয় নিরাপত্তাই বিঘ্নিত। পাকিস্তানি সেনারা পাকিস্তানি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালাচ্ছেন। অন্যদিকে ভারতের কোনো কোনো সেনা কর্মকর্তা মনে করেন যে সেনা প্রত্যাহারের প্রভাব পড়বে ভারতশাসিত কাশ্মীরে, সেখানে ‘জঙ্গি’ তৎপরতা বাড়বে।
গত এক দশকের বেশি মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি যেমন আফগানিস্তানে তালেবানের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করেছে, তেমনি তাদের জঙ্গি কার্যক্রম আফগান জনগণের কাছে অগ্রহণযোগ্য বলেই প্রমাণিত। কারজাই সরকারের দুর্নীতি ও অপশাসনের ফলে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা প্রায় নেই বললেই চলে। আসন্ন নির্বাচনে নতুন নেতৃত্ব এলে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটবে কি না, সেটা বলা দুষ্কর। কিন্তু দেশের নিরাপত্তাব্যবস্থা ভেঙে পড়লে নতুন সরকারের পক্ষে তা সামাল দেওয়ার মতো অবস্থা থাকবে বলে মনে হয় না। এই রকম বিবেচনায়ই পাকিস্তানি একজন কর্মকর্তা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর আফগানিস্তানে গৃহযুদ্ধের সূচনা হতে পারে। এখন আফগান নিরাপত্তা বাহিনীতে যে তিন লাখ ৫২ হাজার সদস্য রয়েছেন, তাঁদের প্রায় ৩০ শতাংশ পক্ষ ত্যাগ করতে পারেন বলে তাঁর ধারণা। এসব আশঙ্কা সত্ত্বেও কোনো কোনো বিশ্লেষকের ধারণা, মার্কিন সেনাদের প্রত্যাহারের পর আফগানরা তাদের ভাগ্য নিজেরাই তৈরি করতে পারবে। তবে যেভাবেই বিবেচনা করি না, এই বছরের আগামী কয়েক মাস আফগানদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়।
আলী রীয়াজ: পাবলিক পলিসি স্কলার, উড্রো উইলসন ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর স্কলারস, ওয়াশিংটন।

No comments

Powered by Blogger.