নতুন করে কূটনীতিক চাপ আসছে by মিজানুর রহমান

দশম সংসদ নির্বাচনের পর গঠিত সরকারের প্রথম কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে দ্রুত নতুন নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছিলেন বিদেশী দূতরা। জুনের মধ্যে পরবর্তী নির্বাচন দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা অন্য দূতদের সামনে যুক্তরাষ্ট্রের এমন মনোভাব প্রকাশ করেছিলেন।
অন্যরাও নতুন নির্বাচন ও রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনে দ্রুত সংলাপের উদ্যোগ নিতে প্রতিমন্ত্রীকে চেপে ধরেছিলেন। সংলাপ ও নতুন নির্বাচনের বিষয়ে সরকারের অবস্থান ইতিবাচক- এমন ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেন প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। সরকার গঠনের প্রায় দেড় মাস পর পররাষ্ট্র দপ্তরে ‘পূর্ণমন্ত্রী’ নিয়োগ দেয়া হয়েছে । পেশাদার কূটনীতিক থেকে রাজনীতিক আবুল হাসান মাহমুদ আলী শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে দায়িত্ব বুঝে নিয়েছেন। কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রথম বৈঠকেই আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের চাপের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। ওই চাপ দিনে দিনে আরও বাড়ার আশঙ্কাও করেছেন তিনি। সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপেও বিষয়টি উঠেছিল। প্রশ্ন ছোড়া হয়েছিল তার দিকে। প্রসঙ্গ এড়িয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারা জানেন, আমিও জানি, সবাই জানেন।’ অন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে বলে বিদায় নেন। একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মতে, আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের বয়কটের মধ্যে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচনের পর দিন থেকেই নতুন নির্বাচনের তাগিদ আসছে। সামপ্রতিক সময়ে দু’দফায় দুই শতাধিক উপজেলা নির্বাচন ওই তাগিদকে আরও জোরালো করেছে। ঢাকার পেশাদার কূটনীতিকরা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনকে অভ্যন্তরীণ ঘটনা হিসেবেই দুনিয়াতে দেখা হয়। সরকার গঠন কিংবা পরিবর্তনে এ নির্বাচনের কোন ভূমিকা নেই। তৃণমূল পর্যায়ে সরকারি সেবা নিশ্চিত করতে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার। তবে সামপ্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে জনমত যাছাইয়ে গুরুত্বপূর্ণ থেকে অতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে এটি। জাতীয় সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে করার দাবিতে বিরোধী জোট যখন আন্দোলনে ব্যস্ত, তখনই মহাজোট সরকার তাদের আরও ব্যস্ত করতে চার সিটি করপোরেশন নির্বাচন আয়োজনের কৌশল নেয়। কিন্তু চার সিটিতেই জয় পেয়ে যায় বিরোধীরা। আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিশাল ব্যবধানে বিএনপির প্রার্থীর জয় বিশ্ব মিডিয়ায় আলোচিত হয়। সরকারের জনপ্রিয়তার মানদণ্ড হিসেবে বিবেচিত হয় ওই ৫ সিটির নির্বাচন। বিরোধী দলের দাবি আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পায়। একটি গ্রহণযোগ্য সরকার ব্যবস্থার অধীনে সবাইকে নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজনের জন্য খোদ বিশ্ববিবেক জাতিসংঘ দূতিয়ালি করে। কিন্তু সরকার কোন ছাড় দিতে রাজি না হওয়ায় সেই দূতিয়ালি সফল হয়নি। একতরফা নির্বাচনের আয়োজন সম্পন্ন করে সরকার ও নির্বাচন কমিশন। বিরোধী প্রধান জোট তো বটেই, বাম-ডান সব দলই তা বর্জন করে। ফলে ১৫৩ আসনে কোন প্রতিদ্বন্দ্বিতাই হয়নি। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তা নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। বাকি আসনে নাম মাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ব্যাপক গোলযোগের মধ্য ভোট হয়। সরকারের পক্ষে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের কারিগরি সহায়তা দিয়ে থাকেন- এমন এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা মানবজমিনকে বলেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষকের আকাল পড়লেও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অনেক বিদেশী পর্যবেক্ষক ও সাংবাদিক এসেছেন। তারা প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ১৯শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক দলের সদস্য হয়ে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাজশাহীর তিনটি কেন্দ্র সরজমিন ঘুরেছেন। ঢাকায় নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন সাভারে গিয়ে তার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। নির্বাচনে বিরোধী জোটের শরিক দলগুলোর সমর্থিত প্রার্থীদের অংশগ্রহণের প্রশংসা করেছেন। তাদের সিদ্ধান্তকে স্বাগতও জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের তরফেও তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ ছিল গত দুই দফা উপজেলা নির্বাচনে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বিষয়ে ইইউ’র যে অবস্থান ছিল তা ওই নির্বাচনের পরে আরও জোরালো হয়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন ঢাকার এমন কর্মকর্তা। তবে তার মূল্যায়ন ভিন্ন। তার মতে, নির্বাচনের পর দিন থেকে সরকার গঠন এবং পরে বিভিন্ন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে সময়ক্ষণ উল্লেখ করে নতুন নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছে, ইইউ সেখানে ব্যতিক্রম। তারা নীরবেই সব পর্যবেক্ষণ করছে। তা ছাড়া সরকারের মনোভাবও তারা বোঝার চেষ্টা করছে বলে জানান ওই কর্মকর্তা। কানাডা অবশ্য এরই মধ্যে অবস্থান স্পষ্ট করেছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত জানতে চেয়েছেন সরকার আসলে কবে নাগাদ রাজনৈতিক সংলাপ শুরু করতে চায়? নতুন নির্বাচন নিয়ে তাদের ভাবনার বিষয়টিও জানতে চেয়েছেন তিনি। প্রতিমন্ত্রী অবশ্য সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের বিষয়টি জানিয়েছেন তাকে। প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে রাষ্ট্রদূত যে সন্তুষ্ট হতে পারেননি তা তার পরবর্তী অনুষ্ঠানগুলোতে দেয়া বক্তৃতায় ফুটে উঠেছে। কানাডা দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচনের তাগিদ দিয়েছে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দেশের দক্ষিণ অঞ্চলের ৫ জেলা সফরে কাটিয়েছেন গত পাঁচ দিন। ওই সময়ের মধ্যে দ্বিতীয় দফায় ১১১ উপজেলার নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে সরকার সমর্থকদের আচরণ এবং বিরোধী নেতাকর্মীদের কর্মকাণ্ড সরজমিন প্রত্যক্ষ করার সুযোগ পেয়েছেন তিনি। তৃণমূলের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার লোকজনের সঙ্গে তার মতবিনিময়ের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। মজিনা ঢাকায় ফিরেছেন। শিগগির তিনি পররাষ্ট্র ভবনে যাবেন। নয়ামন্ত্রীর সঙ্গে তার বৈঠক হবে। কেবল মজিনাই নন, পশ্চিম-পূর্ব-উত্তর-দক্ষিণ সব দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সংগঠনের প্রতিনিধিরাই নয়ামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করবেন। সব আলোচনায় নতুন নির্বাচন আয়োজনের তাগিদের বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে বলে মনে করছেন পেশাদার কূটনীতিকরা। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, উপজেলা নির্বাচনের ফল কূটনীতিকদের আলোচনায় নতুন যুক্তি হিসেবে উঠে আসবে। নতুন নির্বাচন দাবির ক্ষেত্রে এর আগে নির্বাচন বর্জন ইস্যুটি ব্যবহার হয়েছে। এবার তৃণমূলের নয়া ম্যান্ডেটের বিষয়টি শক্তিশালী যুক্তি হিসেবে আসবে।

No comments

Powered by Blogger.