উচ্চশিক্ষা- পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থায়ন by কাবেরী গায়েন

রাবার বুলেটে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর দেহ ঝাঁজরা হতে দেখার স্মৃতি ঝাপসা হওয়ার আগেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের পিঠ ঝাঁজরা হলো রাবার বুলেটে। আহত অন্তত ২৫০ জন শিক্ষার্থী। এর আগে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্ধিত শিক্ষা ফি-বিরোধী আন্দোলনে প্রক্টরকে হাত তুলতে দেখেছি আন্দোলনরত নারী শিক্ষার্থীর শরীরে। হামলাকারী কে?
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্দেশে পুলিশ ও ছাত্রলীগ। ময়মনসিংহে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে পুলিশ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন বর্ধিত ভর্তি ফি ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদে সান্ধ্য কোর্স চালু করার প্রতিবাদে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন ব্যবসায়ী-পেশিশক্তিবাজ-রাজনীতিকদের হাতে দখল বিশ্ববিদ্যালয়েরই ১২টি আবাসিক হল দখলমুক্ত করা এবং নতুন হল নির্মাণের দাবিতে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থী ও পুলিশ—সবাই পাবলিক অর্থায়নে পরিচালিত। অথচ মুখোমুখি অবস্থানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বনাম কর্তৃপক্ষ, শিক্ষার্থী বনাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই মুখোমুখি অবস্থান আসলে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বনাম রাষ্ট্রের। তাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মীকে বহিষ্কার করা কিংবা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে লালবাগ বিভাগের ডিসি কিংবা কোতোয়ালি থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা সমাধান নয়। বরং সমাধান যেখানে, আলোচনা শুরু হোক সেই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়ন প্রসঙ্গেই।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়ন কীভাবে হবে?
‘পাবলিক’ প্রতিষ্ঠান মানেই জনগণের ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পাবলিকের ট্যাক্সের টাকায় চলবে, এই অতিসাধারণ সহজ কথাটি বলতে গেলেই নিপীড়ন নেমে আসছে শিক্ষার্থীদের ওপর। এসব নিপীড়ন চালানোতে প্রায়ই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে সরকার কর্তৃক বাছাই করা অথচ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েরই বেনিফিশিয়ারি কর্তৃপক্ষের অবয়ব, তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক-কর্মকর্তা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্বব্যাংকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ২০০৬-২৬ সাল পর্যন্ত যে উচ্চশিক্ষার কৌশলপত্র লিখেছে, তারই বাস্তবায়নের চেষ্টা হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে। চার স্তরবিশিষ্ট এই কৌশলপত্রের প্রথম পর্যায় শুরু হয়েছে ২০০৬-০৭ সালে। স্বল্পমেয়াদি পর্যায় ছিল ২০০৮-১৩। মধ্যমেয়াদি পর্ব মাত্র শুরু হয়েছে ২০১৪-১৯ এবং দীর্ঘমেয়াদি পর্ব নির্ধারিত ২০২০-২৬। প্রতিটি স্তরে ২৫ শতাংশ হারে শিক্ষা ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে এবং ২০২৬ সাল নাগাদ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অন্তত ৫০ শতাংশ ব্যয় অভ্যন্তরীণ খাত থেকে জোগাড় করার কথা বলা হয়েছে। এ বছর শুরু হয়েছে মধ্যমেয়াদি পর্ব। ফলে তোড়জোড়টা বেশ চোখে পড়ছে। অভ্যন্তরীণ ব্যয় নির্বাহের প্রচেষ্টা হিসেবেই ছাত্র ভর্তি ফি বাড়ানো বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সন্ধ্যাকালীন কোর্স চালু করার যৌক্তিকতা দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন। প্রশ্ন হলো, ভর্তি ফি বাড়িয়ে এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সান্ধ্য কোর্স চালু করে কি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ কমানোর বিষয়টি সামলানো যাবে? এটি কাঠামোগত প্রশ্ন। নৈতিক প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষা কি তবে কেবল কিনেই নিতে হবে? প্রবেশাধিকার কি থাকবে না সাধারণের?
ইউজিসির ২০ বছর মেয়াদি কৌশলপত্রে আরও প্রস্তাব করা হয়েছে ক্রমান্বয়ে ছাত্রদের আবাসিক হলগুলোর ভর্তুকি তুলে দেওয়ার। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে এই সুপারিশ বাস্তবায়নের চেষ্টাটি ধরা পড়ে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২টি আবাসিক হল বেদখল হয়ে আছে। পাটুয়াটুলী-ওয়াইজঘাট এলাকায় তিব্বত হলের প্রায় নয় কাঠা জমি হাজি সেলিমের গুলশান আরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স আর পুলিশের যৌথ দখলে থাকার অভিযোগ রয়েছে। অন্য হলগুলোও রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের দখলে। ২০০৯ সাল থেকেই হল উদ্ধারের জন্য আন্দোলন চলছে। আন্দোলনকারী নেতাদের মতে, যখনই তাঁরা হল উদ্ধারের দাবিনামা নিয়ে যান, নানা আশ্বাস সত্ত্বেও সেসব যে উদ্ধারযোগ্য নয়, তেমনই একটি জটিল চিত্র পান তাঁরা। সে জন্যই নতুন হল নির্মাণের দাবি করছেন। সে দাবি তুললে বলা হয়, দখল হওয়া হলগুলো আগে উদ্ধার করা হোক! একদিকে সরকার চাপ দিচ্ছে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিজস্ব অর্থায়নে স্বাবলম্বী হওয়ার, অন্যদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব ছাত্রাবাস উদ্ধারের আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য গুলিবর্ষণ করা হচ্ছে। তবে কি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মফস্বল থেকে আসা দরিদ্র, নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা কীভাবে ঠেকাবে, তারই টেস্ট কেস হিসেবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে দেখা হচ্ছে?

হল দখলমুক্ত করার দাবিতে আন্দোলন করতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের...
বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স এবং শিক্ষকদের বেতন
সান্ধ্য কোর্সের উদ্দেশ্য শিক্ষার বিস্তারজাতীয় মহৎ কিছু নয়, যেমন বলার চেষ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তেমন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোর্সের অভিন্ন সিলেবাসে একই বেতনে পড়ার সুযোগ পেতেন এসব কোর্সে ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে যে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে ভর্তি হতে পারেননি, তাঁদেরই আধিক্য থাকার কথা এসব কোর্সে। কিন্তু সান্ধ্য কোর্সের জনমিতি যেমন উচ্চমাধ্যমিক পাস করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ না পাওয়া সাধারণ ঘরের শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সাক্ষ্য দেয় না, তেমনি তাঁদের উচ্চ ভর্তি ফি এবং সিলেবাসের ধরন পরিষ্কার নির্দেশ করে যে এসব কোর্সের উদ্দেশ্য নেহাত বাণিজ্যিক। বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালিত এসব কোর্সের কার্যক্রম চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো ব্যবহার করে। প্রায়ই বিভাগীয় অবকাঠামো উন্নয়নের কথা বলে এসব কোর্স চালু করা হয়, অথচ অবকাঠামো উন্নয়নে যেমন এই অর্থের খুব কম অংশই ব্যবহূত হয়, তেমনি বিভাগের গবেষণা খাতেও বরাদ্দ হয় না এই অর্থ। তবু শিক্ষার্থীদের জোরালো আন্দোলনের বিপরীতে এসব বাণিজ্যিক সান্ধ্য কোর্স চালু করার যে উদ্যোগ নেয় কর্তৃপক্ষ, সে কি কেবলই তাদের নৈতিকতার অবক্ষয়? উত্তরটি খোঁজা জরুরি।
জীবন যাপনের সব খাতে ব্যয় বৃদ্ধি হয়েছে বেসরকারি হারে, আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন দেওয়া হচ্ছে যে কাঠামোতে—এই দুয়ের সমন্বয়হীনতাই শিক্ষকদের বাড়তি আয়ের মরিয়া চেষ্টার দিকে ধাবিত করছে সন্দেহ নেই। পৃথিবীর প্রায় যেকোনো দেশের চেয়েই বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম।
একটি হিসাব দিয়েছেন জাপানের ইনস্টিটিউট অব পলিসি সায়েন্সের গবেষক মঞ্জুরে খোদা টরিক, যা দেশের কয়েকটি অনলাইন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশন, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ (২০১০-১২) উপাত্ত নিয়ে তিনি দেখিয়েছেন বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতন সবচেয়ে কম (শুরুতে ১৩৫ মার্কিন ডলার, সর্বোচ্চ ৪১৩ ডলার)। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতন শুরুতে ৩৯৫৪ ডলার এবং সর্বোচ্চ ৭৪৯৯ ডলার। এমনকি ইথিওপিয়া, যার মাথাপিছু আয় মাত্র ৪৫৪ মার্কিন ডলার (বাংলাদেশে ১০৪০ ডলার), সেখানেও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের বেতন অনেক বেশি (৮৬৪-১৫৮০ মার্কিন ডলার)। শিক্ষা ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগও সবচেয়ে কম বাংলাদেশে, জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ। ইথিওপিয়া, ভারত, কাজাখস্তানে এই হার যথাক্রমে ৪.৭ শতাংশ, ৩.৩ শতাংশ ও ৬.৮ শতাংশ। সম্পদশালী দেশগুলোর কথা বাদই থাক। একজন প্রভাষক যে বেতন পান, সেই টাকায় ঢাকা শহরে একটি বাসযোগ্য বাসা ভাড়া করাই কঠিন। জীবন চালানোর ন্যূনতম উপার্জনের জন্যই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় বা সন্ধ্যাকালীন কোর্সে পড়াতে হয়। এটি কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই সমস্যা নয়। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সাভারে গিয়েছিলাম পিএটিসিতে বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ নতুন কর্মকর্তাদের ট্রেনিং শেষে বিতর্ক অনুষ্ঠানে মডারেটর হিসেবে। অবাক হয়েছি প্রথম বিতর্কের বিষয়বস্তু দেখে, Low salary is the cause of massive corruption in the public service sector। অর্থাৎ পাবলিক সার্ভিস সেক্টরে বিশাল দুর্নীতি হয়, তাঁরা মেনে নিয়েই বিতর্কটি করেছেন এবং কম বেতনই যে এর কারণ, সে কথা উঠে এসেছে। গোটা পাবলিক সার্ভিস সেক্টরই এই সমস্যায় বিচলিত, বুঝতে পারলাম। কিন্তু সেই সমস্যার সমাধান তো হুট করে ছাত্র ভর্তি ফি বাড়ানো বা বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সান্ধ্য কোর্স চালু করার মধ্যে হতে পারে না। বেতন বৃদ্ধির জন্য, শিক্ষার ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য শিক্ষকদের দাবি তোলাই বরং জরুরি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পাবলিকের থাকুক
রোকেয়া হলে এক বছর সহকারী আবাসিক শিক্ষক হিসেবে কাজ করার সময় দেখেছি, গ্রামের নিরক্ষর মা-বাবার মেয়েটিও ভর্তি হচ্ছেন ফলিত রসায়ন বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে। এটিই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শক্তি। শিক্ষায় বিনিয়োগ হচ্ছে একটি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ বিনিয়োগ। বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকাশ আর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশকে আলাদা করে দেখার অবকাশ নেই। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে পাবলিক তো রাখতেই হবে, গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার জন্যও বরাদ্দ বাড়াতে হবে। যে প্রক্রিয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীকে এই দাবিতে একাত্ম করার বিপরীতে সাংঘর্ষিক অবস্থানে দাঁড় করায়, সেই প্রক্রিয়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চেতনার পরিপন্থী। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে বাঁচানোর জন্যই এর অর্থায়ন বিষয়ে শিক্ষাবিদ, অভিভাবক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিবিড় আলোচনার মাধ্যমে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হোক; যা সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য প্রযোজ্য হবে। বুলেটে ঝাঁজরা হওয়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীর বুক-পিঠ আজ এ দাবিই পেশ করছে জাতির কাছে।
ড. কাবেরী গায়েন: অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.