কলকাতার চিঠি- প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে মমতা! by অমর সাহা

আগামী ৭ এপ্রিল থেকে শুরু হচ্ছে ভারতের সংসদ লোকসভার নির্বাচন। ভারতের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার ভি এস সম্পাত বুধবার সকালে রাজধানী নয়াদিল্লিতে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণা দিয়েছেন নির্বাচনের নির্ঘণ্ট। নির্বাচন চলবে নয় দফায়। শুরু ৭ এপ্রিল, শেষ ১২ মে। ইতিমধ্যে বিভিন্ন দল ঠিকও করে ফেলেছে তাদের দলীয় প্রার্থীদের তালিকা। কোনো কোনো দল ঘোষণাও করেছে প্রার্থীদের তালিকা।
ভারতীয় সংসদ লোকসভার আসনসংখ্যা ৫৪৩। এর মধ্যে ক্ষমতায় যেতে হলে চাই ২৭২টি আসন। কিন্তু কোন দল বা জোট এই ম্যাজিকসংখ্যা আসন পাবে, তাই নিয়ে এখন রাজনীতি বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চলছে অঙ্ক-কষাকষি। দেশের কয়েকটি সমীক্ষা সংস্থা ইতিমধ্যে ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে যে সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তাতে দেশের বড় দুই দল কংগ্রেস বা বিজেপি অথবা দেশের দুই বড় দলের দুই বড় জোট ইউপিএ বা এনডিএ কাউকেই এবারের নির্বাচনে জয়ী হয়ে সরকার গড়ার ইঙ্গিত দেয়নি। সব সমীক্ষায় একটি চিত্র স্পষ্ট হয়েছে, আসনসংখ্যার দিক থেকে এগিয়ে থাকবে বিজেপি বা বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ বা জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট।

এসব রাজনৈতিক বিশ্লেষণের মধ্যেই ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের বহু নেতা-মন্ত্রী ইতিমধ্যে রাজনৈতিক ময়দানে নেমে প্রচারও শুরু করেছেন আগামীর সরকার গড়বে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস। তারাই হবে সরকার গড়ার প্রধান কারিগর। নির্ণায়ক শক্তি। প্রধানমন্ত্রী হবেন মমতা।

গত ৩০ জানুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে তৃণমূল কংগ্রেসের বিশাল সমাবেশেও প্রখ্যাত লেখিকা মহাশ্বেতা দেবী জানান, মমতাকেই তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চান। মাত্র আড়াই বছরে তিনি রাজ্যকে সাজিয়ে দিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী পদে তিনিই একমাত্র যোগ্য। মমতা মানবদরদি, জনহিতৈষী, লড়াকু নেত্রী এবং কাজে সবটাই মমতাময়। এই সমাবেশে মমতার আরেক ঘনিষ্ঠ এবং কলকাতার টিপু সুলতান মসজিদের ইমাম মওলানা নুরুর রহমান বরকতি মহাশ্বেতা দেবীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলেন, ‘মমতার মতো মুখ্যমন্ত্রী ভারতে আর একজনও নেই। এবার আপনারা মমতাকে সিএম (মুখ্যমন্ত্রী) থেকে পিএম (প্রধানমন্ত্রী) করে দিন।’

ভারতের লোকসভার ৫৪৩টি আসনের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের রয়েছে ৪২টি আসন। মমতার মূলত ঘাঁটিই হলো এই পশ্চিমবঙ্গ। এখন মমতার লোকসভায় আসন আছে ১৯টি। এবারের নির্বাচনে সেই সংখ্যা বাড়বে বলেই ইঙ্গিত দিয়েছে বিভিন্ন জনমত সমীক্ষা। সর্বশেষ ২৩ ফেব্রুয়ারি এবিপি নিউজ এবং নিয়েলসন কোম্পানির সমীক্ষায় বলা হয়েছে, মমতার দল ২৯টি আসনে জিততে পারে। যদি ধরেও নেওয়া যায় মমতা ৪২টি আসনের মধ্যে ৩০টিই আসন পাবেন, তবে কীভাবে তিনি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন দেখেন?

কয়েক দিন আগের জনমত সমীক্ষার দুটি চিত্র দেখা যাক। একটি সর্বভারতীয় পর্যায়ের আর অন্যটি পশ্চিমবঙ্গের। এবিপি আনন্দ এবং এসি নিয়েলসনের পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল পেতে পারে ২৬, বামফ্রন্ট ১৩, কংগ্রেস ২, বিজেপি শূন্য ও অন্যরা পেতে পারে একটি আসন। আজতক-সি ভোটার পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়, তৃণমূল পেতে পারে ২৩, বামফ্রন্ট ১৬, কংগ্রেস ২, বিজেপি শূন্য ও অন্যরা একটি আসন। আর আইবিএন-সিএসডিএস পরিচালিত সমীক্ষায় বলা হয়, তৃণমূল পেতে পারে ২০ থেকে ২৮, বামফ্রন্ট ৭ থেকে ১৩, কংগ্রেস ৫ থেকে ৯, বিজেপি শূন্য থেকে ২ ও অন্যরা শূন্য আসন।

এবার গোটা দেশের চিত্র। এবিপি আনন্দ-এসি নিয়েলসন তাদের সমীক্ষা রিপোর্টে বলেছে, বিজেপির নেতৃত্বাধীন এনডিএ পেতে পারে ২২৬, কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ পেতে পারে ১০১, বাম দল পেতে পারে ৩০, তৃণমূল পেতে পারে ২৬ ও অন্যরা পেতে পারে ১৬০টি আসন। ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটার তাদের সমীক্ষায় বলেছে, এনডিএ পেতে পারে ২০৭ থেকে ২১৭, ইউপিএ ৯৮ থেকে ১০৮, বাম ৩১, তৃণমূল ২৩ ও অন্যরা পেতে পারে ১৬৯ থেকে ১৭৯টি আসন। আর আইবিএন-সিএসডিএস বলেছে, এনডিএ পেতে পারে ২১১ থেকে ২৩১, ইউপিএ ১০৭ থেকে ১২৭, বাম দল ১৫ থেকে ২৩, তৃণমূল ২০ থেকে ২৮ ও অন্যরা পেতে পারে ৯৭ থেকে ১৬৭টি আসন।

আর সর্বশেষ এবিপি নিউজ-নিয়েলসন কোম্পানির সমীক্ষায় বলা হয়, এনডিএ ২৩৬, ইউপিএ ৯২ ও অন্যান্য দল পাবে ২১৫টি আসন।

যদিও সর্বশেষ ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ পেয়েছিল ১৫৯, ইউপিএ ২৬২, বাম দল ২৪, তৃণমূল ১৯ ও অন্যরা ৮২টি আসন। অন্যান্য বলতে বোঝানো হয়েছে, ইউপিএ এবং এনডিএ জোটের বাইরের দলকে। এর মধ্যে রয়েছে মুলায়ম সিং যাদবের সমাজবাদী পার্টি, মমতার তৃণমূল কংগ্রেস, জয়ললিতার এআইএডিএমকে, মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি, নবীন পট্টনায়কের বিজু জনতা দল, নীতিশ কুমারের সংযুক্ত জনতা দল, চন্দ্রবাবু নাইডুর তেলেগু দেশমসহ বিভিন্ন রাজ্যের আঞ্চলিক দল। এখন প্রশ্ন উঠেছে, এই সংখ্যায় কীভাবে মমতার দল প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন দেখছে?

চারটি সমীক্ষায়ই দেখা গেছে অন্যরা পেতে পারে যথাক্রমে ১৬০, ১৬৯ থেকে ১৮৯, ৯৭ থেকে ১৬৭ এবং ২১৫টি আসন। এর মধ্যে অবশ্য ধরা আছে তৃণমূলের আসনও। সমীক্ষার ফলাফল সত্যি হলেও কীভাবে গড়বেন তৃণমূল সরকার?

তৃণমূল ভারতের কংগ্রেস বা বিজেপির জোটের বাইরে থাকা আঞ্চলিক দলগুলোর কি মমতাকে প্রধানমন্ত্রী করার পক্ষে সমর্থন পাবে? কারণ, মুলায়ম, জয়ললিতা, মায়াবতী, চন্দ্রবাবু নাইডু, নিতীশকুমার, নবীন পট্টনায়কেরাও প্রধানমন্ত্রীর দাবিদার।

এদিকে ১১টি বাম ও প্রগতিশীল দলের জোট ইতিমধ্যে জানিয়ে দিয়েছে, তারা কংগ্রেস-বিজেপিবিরোধী তৃতীয় শক্তির সরকার গড়তে আশাবাদী। তাই কীভাবে মমতা প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন, সেই প্রশ্নটি এখন উঠে এসেছে রাজনৈতিক মহলে। তাই মমতা যতটা সহজ ভাবছেন যে বিজেপি বা কংগ্রেস সরকার গড়ার অবস্থানে না গেলে আঞ্চলিক শক্তির জোট সরকার গড়ার সুযোগ পেলে তিনি হয়তো বড় শরিকের দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হতে পারেন।

কিন্তু বর্তমান যে রাজনৈতিক অবস্থা তাতে এনডিএ, ইউপিএ বা তৃতীয় শক্তির জোট যে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী পদে সমর্থন দেবে তেমনটা নিশ্চিত করে বলছেন না রাজনৈতিক নেতারা। তাই মমতার দল যতই মমতাকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন দেখুক না কেন, এটা যে মমতার পক্ষে কঠিন হবে, তা অবশ্য মেনে নিয়েছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

অমর সাহা: প্রথম আলোর কলকাতা প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.