আজ-কাল-পরশু- সেই প্রতিবাদী ছাত্ররা কোথায় by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর

একুশের মাস ফেব্রুয়ারি চলে গেল। রেখে গেল সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের ডাক, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করার চেতনা ও সর্বোপরি বইমেলার মাধ্যমে বেশি করে বই, ভালো বই পড়ার আহ্বান। এবারের ফেব্রুয়ারি মাসের একটি ব্যতিক্রর্মী খবর হলো: আদালত কর্তৃক সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের নির্দেশ ও সময়সীমা নির্ধারণ।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রক্ষায় প্রাণও দিয়েছিল তরুণ ও ছাত্ররাই। দেশের প্রায় সর্বত্র ভাষাশহীদদের স্মরণে নির্মিত শহীদ মিনারের মর্যাদাও রক্ষা করে তরুণ ও ছাত্রসমাজ। কিন্তু গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে লক্ষ করছি, ছাত্র ও তরুণসমাজ একুশের চেতনা থেকে ক্রমে দূরে সরে যাচ্ছে। এর প্রধান কারণ আমাদের দূষিত রাজনীতি, যার ফসল দূষিত ছাত্ররাজনীতি। ছাত্র-তরুণদের মধ্যে সুস্থ রাজনৈতিক চেতনা অনুপস্থিত বলে তাদের পক্ষে এখন ‘একুশে’ উপলক্ষে বড় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা সম্ভব হয় না। একসময় ঢাকায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের সামগ্রিক অনুষ্ঠান তত্ত্বাবধান করত ‘ডাকসু’। ডাকসুর সহসভাপতি থাকতেন শহীদ মিনারের অনুষ্ঠানের প্রধান মুখপাত্র। সেই ডাকসু নেই ২৫ বছর ধরে। ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে নেই ন্যূনতম ঐক্য। ঐক্যবোধ থাকলে অন্তত শহীদ দিবস উপলক্ষে সব ছাত্রসংগঠন একটি ‘কেন্দ্রীয় একুশে উদ্যাপন পরিষদ’ গঠন করে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করতে পারত। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা সরকারি মহল বিরোধী মতের ছাত্রদের যদি এসব কাজে যুক্ত করতে না চায়, তাহলে অন্তত কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন বিভাগকেই দায়িত্ব দিতে পারত। তবু তো শহীদ দিবসে ঐতিহ্যগতভাবে ছাত্রসমাজের হাতেই থাকত শহীদ মিনারের তত্ত্বাবধান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের জন্য এটা এক বড় ব্যর্থতা যে তাদেরই ক্যাম্পাসে একুশের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার তত্ত্বাবধান করছে অছাত্ররা। আজ যদি সুষ্ঠু ছাত্ররাজনীতি থাকত, গণতান্ত্রিক ধারায় পরিচালিত হতো, নির্বাচিত ডাকসু থাকত, হল সংসদ থাকত; তাহলে একুশে উপলক্ষে ঢাকায় কেন্দ্রীয় সব অনুষ্ঠানে ছাত্রদেরই নেতৃত্ব থাকত। ১৯৫২ সাল থেকে ছাত্ররাই এই নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। শুধু পারছে না ’৯০-এর পরে ‘গণতান্ত্রিক পর্ব’ শুরু হওয়ার পর থেকে।

সম্প্রতি হাইকোর্ট ১ এপ্রিলের মধ্যে দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ গণমাধ্যমের বিজ্ঞাপন, সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লেখার নির্দেশ দিয়েছেন। হাইকোর্টের এই নির্দেশ বর্তমান ছাত্রসমাজের জন্য এক বড় ব্যর্থতার প্রমাণ। কারণ, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের ব্যাপারে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করা ছাত্রসমাজেরই কাজ। সেই পাকিস্তান আমলেই ছাত্ররা বিভিন্ন এলাকায় দোকানে দোকানে গিয়ে বাংলায় সাইনবোর্ড লেখার জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে অনেক দোকানের ইংরেজিতে লেখা সাইনবোর্ড কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হতো। এখন এই লজ্জাবোধও কারও নেই। এখন সর্বত্র ইংরেজি ভাষার ছড়াছড়ি। সর্বস্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনে ছাত্রদেরও কোনো কর্মসূচি বা আগ্রহ চোখে পড়ে না।

একুশের একটা বড় শিক্ষা হলো: ‘একুশ মানে মাথানত না করা।’ (আবুল ফজলের উদ্ধৃতি) আমাদের তরুণ ও ছাত্রসমাজের দিকে তাকালে কি মনে হয় তারা এই চেতনায় উদ্দীপ্ত? তারা কি সরকারের সব ন্যায়-অন্যায় ঠিকভাবে বুঝতে পারে? তারা কি জাতীয় রাজনীতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বিতর্ক করে? আলোচনা করে? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের তথাকথিত অঙ্গসংগঠনগুলো কি তাদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করতে পারে? নাকি মূল দল যা বলে দেয়, সেটাই তোতাপাখির মতো তাদের বলতে হয়? ছাত্র-তরুণদের নিজস্ব মত বলে কি কিছু নেই?

৫ জানুয়ারির প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সময়ও আমরা ছাত্র ও তরুণসমাজকে কোনো দৃশ্যগ্রাহ্য ভূমিকা রাখতে দেখিনি। পক্ষেও না, বিপক্ষেও না।

বিগত শেখ হাসিনা সরকার বলেছিল: ‘এটা (৫ জানুয়ারি) সংবিধান রক্ষার নির্বাচন। আসল নির্বাচন পরে হবে।’ এখন কিন্তু সরকার তা বলছে না। এ ব্যাপারে ছাত্র ও তরুণসমাজ কোনো ভূমিকা পালন করছে না। এর অর্থ এখনকার ছাত্র ও তরুণসমাজ অন্যায়ের কাছে মাথানত না করার শিক্ষা বা প্রেরণা পায়নি। একুশে মানে শুধু প্রভাতফেরি, ফুল দেওয়া, নানা অনুষ্ঠান করা আর বইমেলা নয়। এগুলো একুশের আনুষ্ঠানিকতা। একুশের মূল কথা: ‘অন্যায়ের কাছে মাথানত না করা।’ একুশে ছাত্রদের সৃষ্টি। তাই একুশের চেতনা প্রধানত প্রত্যাশা করা হয় ছাত্রদের কাছেই।

’৯০-এর পর থেকে দেশে কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিচ্ছে না কর্তৃপক্ষ। এ জন্য দায়ী বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও দুই বছরের তত্ত্বাবধায়ক সরকার। কেন নির্বাচন দিচ্ছে না তার ব্যাখ্যাও কেউ দেয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি একটা খোঁড়া যুক্তি দেন: ‘ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন দিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে অশান্তি হবে। এতে সেশনজট হতে পারে। তাঁদের কাছে পড়াশোনাই মুখ্য।’ অদ্ভুত যুক্তি! গত ২৫ বছরে যারা ছাত্রত্ব শেষ করেছে, তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক চর্চা করতে পারেনি। বিভিন্ন আবাসিক হল, কেন্দ্রীয়ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, বিতর্ক করতে পারেনি শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধি, ফান্ড ও কর্তৃপক্ষীয় উদ্যোগের অভাবে।

অবাক লাগে, তরুণ ও ছাত্রসমাজ এত বড় অন্যায় ২৫ বছর মেনে নিয়েছে। আমাদের বর্তমান ছাত্ররাজনীতি কত দূষিত, বিভ্রান্ত ও লেজুড়, এই একটি ইস্যুতে তাদের নীরবতায় তা প্রতিফলিত হয়। নির্দল সাধারণ ছাত্রসমাজও এ ব্যাপারে কোনো আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি। ১৯৫২ সালের ছাত্রসমাজ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য। এ জন্য তারা প্রাণ দিয়েছিল। আর এখনকার ছাত্রসমাজ নিজ দেশের সরকার তথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে নিজেদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভোটাধিকার আদায় করতে পারেনি। পারেনি বললে বেশি বলা হবে, ভোটাধিকার আদায় করার চেষ্টাও করেনি। এতে প্রমাণিত হয়, অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথানত না করার শিক্ষা তারা গ্রহণ করতে পারেনি।

‘গণজাগরণ মঞ্চের’ তরুণ ও ছাত্রদের তবু অভিনন্দন জানাতে হয়। কারণ, অন্তত একটি জনপ্রিয় দাবিতে তারা আন্দোলন করেছে। অন্য দাবি তাদের বিবেচনায় ছিল না। সেটা তাদের কৌশল হতে পারে। এ নিয়ে সমালোচনা করা হলে তারা বলেছে: ‘তারা এখন বাংলা পরীক্ষা দিচ্ছে। তাই ইংরেজি নিয়ে ভাবছে না।’ এটা অবশ্যই একটা যুক্তি। তবু তাদের একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, ’৬৮-৬৯ সালের মহান গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল ১১ দফা দাবি নিয়ে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ঐতিহাসিক ছয় দফা দিয়ে। তরুণদের শুধু একটা ‘পরীক্ষা’ নিয়ে মাসের পর মাস বসে থাকলে হয় না। তরুণ ও ছাত্রদের ওপর নানা অবিচার হচ্ছে। সেই অবিচারের বিরুদ্ধে তাদের ঐক্যবদ্ধভাবে বিভিন্ন দাবি নিয়ে সংগ্রাম করা উচিত।

জাতীয় রাজনীতিতে নানা ইস্যু রয়েছে। বিভিন্ন দল, পেশাজীবী সংস্থা ও নাগরিক সমাজ সেই সব দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। আমরা ছাত্রসমাজকে জাতীয় ইস্যুতে এখন যুক্ত হতে বলব না। এটা ‘পাকিস্তান আমল’ নয়। এটা স্বাধীন বাংলাদেশ। এখানে একধরনের গণতন্ত্র রয়েছে। স্বাধীন গণমাধ্যম রয়েছে। সোচ্চার নাগরিক সমাজ রয়েছে। জাতীয় ইস্যু নিয়ে কথা বলার বা আন্দোলন করার ফোরামের অভাব নেই, যা পাকিস্তান আমলে ছিল। পাকিস্তান আমলে গণতন্ত্রই ছিল না। তাই ছাত্রসমাজকে নানা জাতীয় ইস্যু নিয়ে আন্দোলন করতে হয়েছিল। এখন তরুণ ও ছাত্রসমাজ শুধু তাদের স্বার্থে তাদের দাবি আদায়ে আন্দোলনে এগিয়ে এলেই যথেষ্ট। তবে সেই আন্দোলনও পরীক্ষা বা ক্লাসের ক্ষতি করে নয়। রাস্তা বন্ধ করেও নয়। জাতীয় ইস্যু নিয়ে ছাত্রদের আন্দোলন করার প্রয়োজন না হলেও ছাত্রসমাজের প্রতিটি জাতীয় ইস্যু নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করা উচিত। বিতর্ক করা উচিত। বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষজ্ঞদের আমন্ত্রণ করে তাঁদের কথা শোনা উচিত। তাঁদের প্রশ্ন করা উচিত। এতে ছাত্রদের মতামত গঠন সহজ হবে। যুক্তি দিয়ে বুঝতে শিখবে।

মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।

No comments

Powered by Blogger.