বাংলাদেশে কয়লা-বিভ্রাট by জোসেফ অলচিন

অন্য যে কোন গরিব দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রয়োজন অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রচুর বিদ্যুৎ। তা যত সস্তায় হয় ততোই ভাল। এদেশের শতকরা ৮০ ভাগ বিদ্যুৎ আছে প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে। কিন্তু সেই গ্যাসের মজুত কমে আসছে। নতুন নতুন কূপ খনন করা হচ্ছে। ভর্তুকি ব্যবস্থা অপর্যাপ্ত। এ অবস্থায় সরকার এক্ষেত্রে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু এই পরিবর্তন বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে এসেছে। কারণ কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশ দূষণ করে। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের প্রভাব এখানে সবচেয়ে বেশি পড়ে। ২০১০ সালের উন্নত বিদ্যুৎ ক্ষেত্র বিষয়ে মাস্টারপ্ল্যানের অধীনে সরকার আশা করছে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশের শতকরা ৫০ ভাগ বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে কয়লা থেকে। বর্তমানের চেয়ে তা শতকরা ২ ভাগ বেশি। (বাংলাদেশে বর্তমানে কয়লাচালিত একটি ছোট্ট বিদ্যুৎ স্থাপনা আছে)। সরকার আশা করছে, নতুন ডজনখানেক নতুন কয়লাচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে এ কাজ সম্পন্ন করবে। এর মধ্যে একটি হবে রামপালে বিতর্কিত স্থানে। সেখান থেকে ১৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সেটা হবে দেশের বর্তমান মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের এক-পশ্চমাংশ। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০১৬ সালের মধ্যে সম্পন্ন হওয়ার কথা রয়েছে। কিন্তু এই কেন্দ্রটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন, ইউনেস্কোর তালিকাভুক্ত ও রয়েল বেঙ্গল টাইগারদের সবচেয়ে বড় আস্তানা সুন্দরবন থেকে ১০ মাইল উত্তরের বেশি দূরে নয়। ইরাবতীর বিলুপ্ত ডলফিনও রয়েছে এই বনে। বঙ্গোপসাগরে মাঝে-মধ্যেই সৃষ্টি হয় ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। তা থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষা দেয় এই বন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক আনু মুহাম্মদের মতে, প্রতিটি ঘূর্ণিঝড় থেকে লাখ লাখ জীবন রক্ষা করে ম্যানগ্রোভ।
১৯৯৭ সালে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয় সুন্দরবন। তা সত্ত্বেও রামপাল স্টেশনে যাতে কয়লাবোঝাই জাহাজ যেতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য পানিপথগুলোকে ড্রেজিং করা হবে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে। পার্শ্ববর্তী খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক রিপোর্ট অনুযায়ী, তাতে বছরে এ স্থাপনা থেকে ৫ লাখ টনেরও বেশি বিষাক্ত তৈলাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ করা হবে। সেই বর্জ্য পরিবাহিত হবে সুন্দরবনের ভিতর দিয়ে সব ছোট নদীতে। আনু মুহাম্মদের মতে, আরেকটি সমস্যা হলোÑ রামপাল প্রকল্প সুযোগ সন্ধানী ভূমিগ্রাসীদের জন্য ভূমি গ্রাস করে অন্যান্য দূষণকারী কারখানা ওই এলাকায় নির্মাণের পথ করে দিয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে তথাকথিত জাহাজ ভাঙা শিল্প।
গত পাঁচ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ শক্ত হয়ে দাঁড়ানোর জন্য লড়াই করছে। প্রাকৃতিক গ্যাসের অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বছরে কমেছে ২০ হাজার কোটি ঘন ফুট, যা কিনা শতকরা প্রায় ২০ ভাগ। এই ঘাটতির কারণে প্রতিবছর বিদ্যুৎ উৎপাদনে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। কয়েক দশকে ভোক্তাদের ও শিল্প খাতে ভর্তুকি বাড়ানোয় এখানে গ্যাস ফুরিয়ে যাবে। এভাবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ক্রমাগত লোকসান গুনছে। অর্থনৈতিক দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো অসচ্ছল কোম্পানিগুলোকে ঋণ দিয়ে যাচ্ছে, যা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। ওইসব কোম্পানি কম দামে ও যেনতেনভাবে অপচয় করছে গ্যাস। সর্বোপরি, এতে সরকারকে ২০১২ সালে প্রায় ৩৪০ কোটি ডলার ভর্তুকি দিতে হয়েছে। ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের হিসাবে, এই অর্থ মোট বাজেটের প্রায় এক-চতুর্থাংশ। বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের মজুত আছে গ্যাস। কিন্তু তা উত্তোলন প্রক্রিয়া ধীর গতির। রাষ্ট্রীয় কোম্পানিগুলোর এসব গ্যাস উত্তোলনের সক্ষমতা নেই অথবা তারা জানে না কিভাবে গ্যাস উত্তোলন করতে হয়। বিদেশী বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর অর্থনৈতিক সুবিধা নেই। স্থানীয় বাজারে ব্যাপক ভর্তুকি দেয়া হয়। তাই এখানে তারা উৎপাদিত গ্যাস বিক্রি করে তাদের বিনিয়োগ পুনরুদ্ধার নিয়ে সন্দিহান। সাম্প্রতিক নিলামগুলোতে, গভীর সমুদ্রে গ্যাস ব্লকগুলোর জন্য কোন কোম্পানি দরপত্র দাখিল করেনি। অগভীর ব্লকের জন্য মাত্র দু’টি কোম্পানি দরপত্র দাখিল করেছে। এরফলে বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সঙ্কট এড়াতে তরল জ্বালানি আমদানি করতে হয় বাংলাদেশকে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশলী প্রফেসর মোহাম্মদ তামিম বলেন, এজন্য দরিদ্র এ দেশটির বার্ষিক আমদানি বিল বেড়েছে ২০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশে বছরে বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় ৩০০০ কোটি ডলারের পণ্য।
এসব নিয়ে বিতর্ক অনেক দিনের। তবে এখনও এর বিকল্প কোন পন্থা বেরিয়ে আসেনি। পারমাণবিক বিদ্যুৎ এদেশের মানুষের কাছে খুব গ্রহণযোগ্য। কিন্তু যেখানে ঠিকমতো অবকাঠামো নেই, সেখানে এমন কাজ খামখেয়ালিপনা। বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু নীতি-নির্ধারকরা এর উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ ও পরিকল্পনা নেয়নি। এটা হয়েছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর কায়েমি স্বার্থ থাকার কারণে। এছাড়া রয়েছে প্রারম্ভিক অর্থনীতি। সন্দ্বীপে নবায়নযোগ্য প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদন অতি ব্যয়সাপেক্ষ একটি উদাহরণ। তাই এ প্রকল্প তার সক্ষমতার মাত্র শতকরা ৫০ ভাগ পরিচালিত হয়। কারণ, স্থানীয়রা বিদ্যুৎ কেনার সামর্থ্য রাখেন না, এমনকি দাম কমিয়ে দিলেও না। তাই এখন ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কয়লার দিকে ঝুঁকতে হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে বিপুল পরিমাণ কয়লা পাওয়া যায়। এর দামও অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল। বাংলাদেশের নিজের খনি থেকে বিশেষ করে উত্তরের খনি থেকে কয়লা উত্তোলন করা হলে তাতে অনেক মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে। সরকার রামপালের প্রকল্প চালু করার পক্ষে। এখানে জনবসতি ঘন নয়। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালিত হবে অস্ট্রেলিয়া অথবা ইন্দোনেশিয়া থেকে আমদানি করা কয়লায়।
দৃশ্যত বাংলাদেশ এক বাধ্যবাধকতায় আটকা পড়েছে। বছরে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়ছে শতকরা ১০ ভাগ। এতে ২০৩০ সাল নাগাদ উৎপাদন তিনগুণ বাড়িয়ে ৩০ হাজার মেগাওয়াটের বেশি করতে করতে হবে। কিন্তু এই পরিমাণটি অনেক বেশি নয়। শুধু নবায়নযোগ্য উৎস ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্র ৫ গুণের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। কয়লার ওপর নির্ভরশীল না হয়ে বাংলাদেশের সামনে চাপ উপশমের উন্নত অনেক উপায় আছে। এমনকি ভর্তুকি ব্যবস্থা পুরোটাই সংস্কার করা উচিত। বর্তমানে এ ব্যবস্থা শুধুই অকার্যকর নয়, একই সঙ্গে তা অতি দরিদ্রদের কোন সহায়তায় আসছে না। বাংলাদেশের শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ বিদ্যুতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিলে তাতে গ্যাসের দাম বাড়বে। তাতে অর্থনীতিতে ধাক্কা সামলাতে ও সম্ভাব্য সামাজিক অসন্তোষ সামাল দিতে এসব পদক্ষেপ নিতে হবে ধীর গতিতে। ইত্যবসরে গ্যাস সংযোগ আরও সক্রিয় করতে হবে। ব্যাপক অপচয় ও অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণে সরকারকে প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ হাজার ডলার গচ্চা দিতে হচ্ছে। কেন্দ্রগুলো পুনর্গঠন ও চৌর্য্যবৃত্তি বন্ধ করা গেলে তাতে মোট গ্যাসের বিল দাম করে যেত। পাশাপাশি কমতো ভর্তুকির পরিমাণ। বছরে বিদেশী সরকারগুরো বাংলাদেশের বার্ষিক উন্নয়নে কমপক্ষে ৩০০ কোটি ডলার সহায়তা দিচ্ছে। কয়লাচালিত স্থাপনাগুলোতে (যেমনটা জাপান মাতারবাড়িতে করার পরিকল্পনা নিয়েছে) অর্থায়ন করা, অকার্যকর প্রকল্পগুলোতে অর্থায়ন করার পরিবর্তে দাতাদের উচিত নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উন্নয়নের দিকে অর্থায়ন করা। বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য বিদেশী দাতারা সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্পে অর্থায়ন করেছে। এ খাতে সৌর প্যানেল বিক্রি করা হচ্ছে এবং তা থেকে গ্রামীণ মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে। এভাবে গ্রামের ৩ লাখ ২০ হাজার মানুষ তাদের সামান্য প্রয়োজনের বিদ্যুৎ পাচ্ছে। তবে জাতীয় বিদ্যুৎ গ্রিডে অনেক বেশি ও বড় প্রকল্প প্রয়োজন। এতে অর্থনীতি উন্নত হবে। এমন প্রকল্প উন্নয়ন করা যেতে পারে চীনের সমর্থন নিয়ে। রামপাল কয়লাভিত্তিক প্রকল্প নিয়ে সরকার পরিবেশের ওপর প্রতিক্রিয়া নিয়ে যে কথা বলেছে তা হলো, দীর্ঘ মেয়াদে সালফার ডাই-অক্সাইড ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড তেমন উল্লেখযোগ্য হবে না। কারণ, ঘূর্ণিঝড় মাঝে-মধ্যেই উপকূলে আঘাত হেনে দূষণ সরিয়ে নেবে। তা বাস্তবই। তবে তাতে বাতাস আরও বেশি দূষিত হবে, যা পরে বারবার এ ঘটনার বিস্তার ঘটাবে জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট তীব্র জোয়ার। এ ঘটনা ঘটবেই যতক্ষণ না পলিমাটির এই বদ্বীপের ক্ষয় হয়।
জোসেফ অলচিন, ঢাকায় অবস্থানরত সাংবাদিক।
(গত ৪ঠা মার্চ নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত ‘বাংলাদেশজ কয়েল ডিল্যুশন’ লেখার অনুবাদ)।

No comments

Powered by Blogger.