এখনো সমঝোতার সুযোগ আছে- সাক্ষাৎকারে নিজাম উদ্দিন আহমদ by বিশ্বজিৎ চৌধুরী

নিজাম উদ্দিন আহমদ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক। এ বিভাগের চেয়ারম্যানও ছিলেন তিনি। অধ্যাপনার পেশায় আছেন ১৯৭৯ সাল থেকে। ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন থেকে ‘স্থানীয় পর্যায়ে আমলাতন্ত্র ও স্থানীয় রাজনীতি’ বিষয়ের ওপর গবেষণার জন্য পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। দ্য পার্লামেন্ট অব বাংলাদেশ, নন পার্টি কেয়ারটেকার গভর্নমেন্ট ইন বাংলাদেশ: এক্সপেরিয়েন্স অ্যান্ড প্রসপেক্টসহ আটটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তাঁর।
 সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিশ্বজিৎ চৌধুরী

প্রথম আলো: নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর দুই দশক অতিবাহিত হয়েছে, কিন্তু সে অর্থে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা টেকসই হলো না। এখনো নির্বাচন নিয়ে একটা সমঝোতায় আসতে পারল না রাজনৈতিক দলগুলো। আমাদের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ কী?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: এটা ঠিক যে ধীরগতিতে হলেও আমরা এগোচ্ছিলাম। নব্বইয়ের পর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনগুলোতে পরাজিত পক্ষের কিছু অভিযোগ থাকলেও শেষ পর্যন্ত মেনে নিয়েছে দুই পক্ষই। কিন্তু এবার যেটা হলো, সেটাকে কী বলব আমরা? বিএনপি নির্বাচনেই এল না। তাতে নির্বাচন একটা হলো। ভালো-মন্দ পরের কথা, এখানে তো সত্যিকারের বিরোধী দলের কোনো অস্তিত্বই থাকল না। এটা গণতন্ত্রের জন্য বড় ক্ষতি। রাজনীতির জন্যও ক্ষতি। এমনকি সরকারি দল আওয়ামী লীগের জন্যও স্বস্তিকর নয় বলে মনে করি।
প্রথম আলো: জাতীয় সংসদে বিরোধী দল তো একটা আছে...
নিজাম উদ্দিন আহমদ: এখন যে বিরোধী দল আছে, জাতীয় পার্টি, সেটাকে আদৌ বিরোধী দল বলা যাবে কি না সংশয় আছে। তারা সরকারেও আছে, বিরোধী দলেও। এভাবে দুই নৌকায় পা দিয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করা যায় না। দেখুন, সংসদে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে যেমন সরকারের কর্মকাণ্ডের একটা জবাবদিহি থাকে, তেমনি সরকারি দলের জন্যও তা সুবিধাজনক।
প্রথম আলো: দুই পক্ষের সমঝোতা হলো না। নির্বাচনও হয়ে গেল, এভাবে সংসদ কি পূর্ণ মেয়াদে চলতে পারবে বলে মনে হয়?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: চাপে না পড়লে সরকার হয়তো চালিয়ে নিতে পারবে। ১৫৩ জন সদস্য যে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হলেন, সেটা চ্যালেঞ্জ করে আদালতে একটা মামলা করা হয়েছে। এর নিষ্পত্তি হতে আরও সময় লাগবে। সুতরাং সরকার চালিয়ে যেতেই পারে।
প্রথম আলো: তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে সরে এসে বিএনপির পক্ষে কি সমঝোতায় যাওয়া সম্ভব?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: বিএনপির জন্য এখন সমঝোতায় যাওয়া ছাড়া আর কোনো পথ খোলা আছে বলে তো মনে হয় না। আওয়ামী লীগ যেমন আন্দোলনের মাধ্যমে বিএনপি সরকারকে দাবি মানতে বাধ্য করেছিল, সেটা বিএনপি পারেনি। প্রাথমিকভাবে এটা তাদের ব্যর্থতা। এখন সরকার যদি পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় থাকতে পারে, তাহলে সাত যোগ পাঁচ মোট ১২ বছর সরকারে তাদের প্রতিনিধিত্ব থাকল না। এবার তো সংসদেও তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই। এতে দলের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটিই বড় হয়ে উঠবে। যা-ই বলেন, বিরোধী দল হিসেবেও সংসদে থাকলে তার একটি কণ্ঠস্বর থাকে। সাধারণ মানুষ সরকারের কথা যেমন শোনেন, বিরোধী দলেরটাও শোনেন। সংবাদমাধ্যমগুলোও কোনো বিষয়ে সরকার ও বিরোধী দলের অবস্থান তুলে ধরতে পারে।
প্রথম আলো: সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলে সরকারি দলই বা কেন সমঝোতায় আগ্রহী হবে?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: সরকার যদি মনে করে, বিরোধী দলের তো চ্যালেঞ্জ করার মতো ক্ষমতা নেই, সুতরাং সবকিছু উপেক্ষা করে চালিয়ে যাব। সেটাও ঠিক হবে না। বুঝতে হবে বিএনপিরও বিরাট জনসমর্থন আছে। নির্বাচনে বিএনপির সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দলের কেউ মনোনয়নপত্র জমা দেয়নি। এটাও এ দলের জন্য বড় সাফল্য। সরকার চেষ্টা করেও কাউকে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করাতে পারেনি। সাম্প্রতিক উপজেলা নির্বাচনেও তৃণমূলে বিএনপির জোরালো জনসমর্থন লক্ষ করা গেছে। শেষ পর্যন্ত জনসমর্থনের ব্যাপারটিই তো মুখ্য। এই দিকটা সরকার বিবেচনায় নিলে ভালো করবে।
প্রথম আলো: তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে নিয়েও আমরা দেখেছি, দুই পক্ষই নানা সময়ে অভিযোগ করেছে। আদালতের রায়ও এ রকম সরকারব্যবস্থা অনুমোদন করে না। তাহলে তত্ত্বাবধায়ক ফর্মুলাটি কি ব্যর্থ হয়ে গেল?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: না। দেখুন, আদালতের রায়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারপদ্ধতিকে সংবিধানসম্মত নয় বলা হয়েছে। কিন্তু আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আরও দুটি মেয়াদে এই ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে পারে। কেন এই পর্যবেক্ষণ? কারণ, বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় নিলে, দুটি দলের পরস্পরের প্রতি যে সন্দেহ-অবিশ্বাস, এর প্রেক্ষাপটে অন্তত আরও কিছুদিন এই ব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে গ্রহণযোগ্য।
প্রথম আলো: বিএনপির পক্ষে সমঝোতায় যাওয়ার পথ কী?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: আমার মনে হয় নির্বাচন পরিচালনার যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে, তাকে নিরপেক্ষ করার ব্যাপারে দেনদরবার করতে পারে বিএনপি। নির্বাচন কমিশনকে যদি সরকারের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করা যায়, তাহলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। ভারতের মতো এত বড় একটি দেশে যদি প্রধান নির্বাচন কমিশনার পুরো নির্বাচনটাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারেন, সেটা বাংলাদেশে সম্ভব হবে না কেন?
এ ছাড়া প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখার ব্যাপারটিও নিয়ে আলোচনা করতে হবে। সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের সব সরকারই প্রশাসনকে দলীয়করণ করেছে। বর্তমানে অবস্থাটা এমন জায়গায় গিয়ে পৌঁছেছে যে ঢালাওভাবে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে। পদ নেই, তবু পদায়ন করা হচ্ছে। হয়তো এটা একধরনের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ। পৃথিবীর কোনো দেশের আমলাতন্ত্রে এর নজির নেই। এই ব্যাপারগুলো নিয়ে মীমাংসায় আসতে হবে।
প্রথম আলো: এই প্রশাসনই তো নির্বাচন পরিচালনা করছে?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: হ্যাঁ, এই দুষ্টচক্র থেকে তো বেরিয়ে আসতে হবে। যেমন জেলা প্রশাসককেই রিটার্নিং অফিসার করতে হবে কেন? নির্বাচন কমিশনার নিজেরাই তার লোক নিয়োগ করতে পারে। একই দিনে ৩০০ আসনে নির্বাচন না করে ধাপে ধাপে করলেই তো হয়। তাতে নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা-কর্মচারী বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষে নির্দিষ্ট এলাকায় বেশি মনোযোগ দেওয়া ও সক্রিয় ভূমিকা রাখা সম্ভব হবে। ভারতে দেড় মাস ধরে নির্বাচন চলে। এখানেও সে রকম হতে পারে। নির্বাচন ধাপে ধাপে হবে, কিন্তু ফলাফল ঘোষিত হবে না। ফলাফল ঘোষণা হবে পুরো নির্বাচন-প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়ার পর।
প্রথম আলো: গত ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়ে গেল, তাতে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা নিয়ে কী বলবেন?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: দেখুন, বিরোধী দল যদি নির্বাচনে অংশ না নেয়, মনোনয়নপত্রই যদি জমা না দেয়, তাহলে নির্বাচন কমিশনকে ভালো বা মন্দ বলার সুযোগ কোথায়? তাঁরা সংবিধান অনুযায়ী যা করার তা করেছে। যেখানে প্রতিদ্বন্দ্বী নেই, সেখানে একজনকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত ঘোষণা তো করতেই হবে। যেখানে নির্বাচন হয়েছে, সেখানে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছে। এখানে তাদের করণীয় বিশেষ কিছু ছিল বলে মনে হয় না।
প্রথম আলো: স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার কথা উঠেছে। আপনার কি মনে হয় এই নির্বাচন দলীয়ভাবে হওয়া উচিত, নাকি দলের প্রভাবমুক্ত রাখা উচিত এই নির্বাচনকে?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: দেখুন, একসময় আমি নিজেই লেখালেখি করেছি স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলীয়ভাবে করার পক্ষে। আসলে সামরিক সরকারগুলো নিজেদের স্বার্থেই স্থানীয় নির্বাচনকে নির্দলীয় করতে চেয়েছে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল, যাঁরা নির্বাচিত হয়ে আসবেন, তাঁদেরই দলে টেনে নেবেন। সে উদ্দেশ্য অবশ্য সফল হয়নি। যাক, সেটি অন্য প্রসঙ্গ। বর্তমানে আমি মনে করি, যত দিন দলের তৃণমূলে গণতন্ত্রায়ণ করা না যায়, তত দিন নির্বাচন নির্দলীয়ভাবেই হওয়া উচিত।
এখন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকেরা দলীয়ভাবে নির্বাচনের কথা বলছেন। লক্ষ করবেন, বিএনপি কিন্তু এর বিরোধিতা করছে না। তার কারণ, দুটি দলই কেন্দ্রীয়ভাবে এটা নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। ওপর থেকে একজনকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করে দলীয়ভাবে প্রতীক বরাদ্দ করলে তাতে তৃণমূলের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটবে বলে মনে হয় না। বরং তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা যদি নিজেদের মনের মতো প্রার্থী ঠিক করেন, তাহলেই প্রকৃত প্রতিনিধিত্ব হতে পারে। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা স্থানীয় এমপিদের পছন্দ অনুযায়ী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হচ্ছে বলেই এত ‘বিদ্রোহী প্রার্থীর’ প্রাদুর্ভাব ঘটছে। দলের তৃণমূলে গণতন্ত্রায়ণ নিশ্চিত করার পরই কেবল দলীয়ভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে পারে।
প্রথম আলো: এবার যে উপজেলা নির্বাচন হয়ে গেল, তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় পর্যায়ে তো সেই আশির দশকের নির্বাচনের চেহারাই ফিরে এল।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: এটি খুবই দুঃখজনক। নির্বাচন কমিশনের আরও দৃঢ় অবস্থান আশা করেছিলাম আমরা। প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছুটিতে ছিলেন। এতে নিয়মের হয়তো ব্যত্যয় ঘটেনি। কিন্তু তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিলে গুরুত্বটা বাড়ত। আর এই নির্বাচনের চিত্র যদি আমাদের আশির দশকের কথা মনে করিয়ে দেয়, আমরা যদি আবার পেছনে ফিরে যাই, তাহলে নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান, গণতন্ত্রের চেতনা—সবই তো ধূলিসাৎ হয়ে গেল।
প্রথম আলো: এই অবস্থা থেকে উত্তরণের উপায়টা কী?
নিজাম উদ্দিন আহমদ: আমি মনে করি, এখনো সমঝোতার সুযোগ আছে। প্রধান দুটি দলের মধ্যে ঐতিহাসিক পটভূমির কারণে অনেক বিভেদ আছে। সন্দেহ-অবিশ্বাস আছে। এখানে আমি আবার ভারতের উদাহরণ টানব। কংগ্রেস ও বিজেপির মধ্যে মতাদর্শ ও অন্যান্য বিষয়ে যোজন দূরত্ব। কিন্তু সোনিয়া গান্ধী ও বাজপেয়ি কিংবা মনমোহন ও আদভানি কি জাতীয় ইস্যুতে পাশাপাশি বসছেন না? নিজেদের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে এটা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজও ভূমিকা রাখতে পারে। আমাদের দুর্ভাগ্য যে নাগরিক সমাজও এখন দলীয় পরিচয়ে বিভক্ত। কিন্তু সমঝোতা না হলে আমাদের গণতন্ত্র বিপন্ন হবে, ভবিষ্যৎ বিপন্ন হবে—এ কথা মাথায় রেখেই সমঝোতা অপরিহার্য।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
নিজাম উদ্দিন আহমদ: ধন্যবাদ।

No comments

Powered by Blogger.