পুলিশের ক্ষমতা অপব্যবহার বন্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির সুপারিশ ইউরোপীয় পার্লামেন্টের

সম্প্রতি বাংলাদেশ সফরে আসা দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ইউরোপীয় পার্লামেন্টের (ইপি) উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে পুলিশের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধে  সরকারকে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহনের আহবান জানান। ক্রমবর্ধমান নির্যাতন ও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্তে জাতিসংঘের বিশেষ টীমকে আমন্ত্রন জানানোর ওপরও জোর দেন প্রতিনিধি দলটি।

ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের পক্ষ থেকে গণমাধ্যমকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশে সফরকারী ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দলের বরাত দিয়ে এসব কথা বলা হয়। 
প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার সাথে বৈঠক করেন। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের দুই শীর্ষ নেতার সাথে বৈঠক শেষে প্রতিনিধি দলটি বিদ্যমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানায়।
গত জানুয়ারিতে ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে সহিংসতা এবং পরবর্তীতে উপজেলা নির্বাচনকে ঘিরে ভোটারদের নিয়ে রীতিমতো রশি টানাটানিতে চরম উদ্বেগ জানায় ইউরোপীয় পার্লামেন্ট। এমতাবস্থায় দুই দলকে সংলাপে বসার আহবান জানায় প্রতিনিধি দলটি। দুই দলকেই এমন একটি পথ খুজে বের করা উচিত যাতে বাংলাদেশের মানুষ অচিরেই একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক পরিবেশে তাদের প্রতিনিধি বাছাই করার সুযোগ পান। 
ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলটি একটি স্বাধীন নির্বাচন কমিশন পুন:গর্ঠনের আহবান জানিয়ে বলেন, এই ক্ষেত্রে বিগত কয়েক বছরে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১০ মিলিয়ন ইউরো সহায়তা দিয়েছে। নির্বাচনে বিশৃঙ্খলার বিষয়ে একটি পূর্নাঙ্গ তদন্তের ওপরও গুরুত্বারোপ করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দলটি। 
প্রতিনিধি দলটি সুশীল সমাজকে কাজ করার সুযোগ দানে সরকারের সহযোগিতা কামনা করে বলেন, মত প্রকাশের স্বাধীনতা থাকতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন সংশোধনের মাধ্যমে যেন কোন ধরণের দুরভিসন্ধির বাস্তবায়ন করা না হয় সেদিকে নজর দেয়ারও আহবান জানান এই দলটি।
বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা, বিচারবহি:র্ভূত হত্যাকাণ্ড ও অপহরণের খবরে উদ্বেগ জানিয়ে প্রতিনিধি দলটি এসব ঘটনায় সরকারের পক্ষ থেকে জোরালো তদন্ত দাবি করে। 
দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক ইউরোপীয়ান পার্লামেন্টের ডেলিগেশন টিমের চেয়ারপারসন জিয়ান লিম্বার্টের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলটি গত ২৪-২৫ মার্চ দুই দিনের বাংলাদেশ সফর করেন। গত ৫ই জানুয়ারি বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এটাই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের উচ্চ পর্যায়ের প্রথম সফর।
প্রতিনিধি দলটি বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও পোশাক শিল্পের সাথে জড়িতদের সাথে দীর্ঘ আলোচনায় বসে। বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের সাথে  ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিক জড়িত উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় গত ৩ বছরে ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ৫৭শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
এ প্রেক্ষাপটে ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট পোশাক কারখানার বর্তমান নিরাপত্তা ব্যবস্থা ও শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার বিষয়টি খতিয়ে দেখছে বলেও প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। বিশেষ করে শ্রম আইন সংশোধন ও ২শ নতুন নিরাপত্তা পরিদর্শক নিয়োগের সরকারি সিদ্ধান্তের সুফল কতটা পোশাক খাতে পড়ছে তা পর্যবেক্ষণ করছে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট।
কিন্তু এখনও করণীয় বিষয়ের বেশিরভাগই অসম্পূর্ণ রয়েছে-এমন মন্তব্য করে প্রেস-বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইউরোপীয় পার্লামেন্ট মনে করে ইউরোপীয় ক্রেতা ও বাংলাদেশের পোশাক মালিকদের তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করা উচিত। আন্তর্জাতিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে ইউরোপ ও বাংলাদেশের মধ্যে যে মতৈক্য রয়েছে তার আলোকেই উভয় পক্ষকে প্রতিশ্রুতি পালনে আন্তরিক হওয়া দরকার বলেও বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়। 
ইউরোপ শ্রম আইনের যথাযথ বাস্তবায়নে সরকারকে আরও সচেষ্ট হওয়ার আহবান জানিয়ে বলেন, দ্রুত পরিদর্শক নিয়োগ জরুরী এবং তাদের প্রতিবেদন নিয়মিত প্রকাশিত ও পর্যালোচনা হওয়া উচিত। শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরী বৃদ্ধি হওয়া উচিত বলেও মত দেন ইউরোপীয়ান পার্লামেন্ট।
সাভারে রানা প্লাজা ধ্বসে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে যথাযথ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণের ওপরও জোর দেন ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলটি। আগামী ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধ্বসের একবছর পূর্ণ হওয়ার আগেই এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হওয়া দরকার বলেও মত দেন তারা।
বাংলাদেশ সফরে আসা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলের চেয়ারপারসন লিম্বার্টের বরাত দিয়ে প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, “যখন ইউরোপীয় ক্রেতারা কোন পোশাক কেনেন, তারা এটা নিশ্চিত হতে চান যে যারা এই পোশাকটি তৈরি করেছেন তারা কর্মস্থলে নিরাপদে আছেন এবং একটি সম্মানজনক জীবিকা নির্বাহ করছেন”।
প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলটি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সাথে বৈঠককালে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা বিপদগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপ নিয়েও আলোচনা করেন।  ইউরোপীয় প্রতিনিধি দলটি এ ধরনের ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি আরও মানবিক হওয়ার ওপর জোর  দেন। একই সাথে উদ্বাস্তুদের সহায়তায় কর্মরত বিদেশী এনজিদের এদেশে প্রবেশে ও কাজ করার সুযোগদানে সরকারের আরও উদার ভূমিকা প্রত্যাশা করেন প্রতিনিধি দলটি।
ভারতের সাথে বাংলাদেশের স্থিতিশীল ও বহুমুখী সম্পর্কের উন্নয়নকে স্বাগত জানান বিশেষ করে সীমান্ত হত্যা উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পাওয়ায় সন্তোষ প্রকাশ করেন প্রতিনিধি দলের সদস্যরা। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট ও বাংলাদেশের সহযোগীতামূলক কার্যকলাপেরও প্রশংসা করেন প্রতিনিধি দলটি। বিশেস করে দারিদ্র বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তন ও লিংগ বৈষম্য দূরীকরণে বাংলাদেশের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে সন্তোষ প্রকাশ করে প্রতিনিধি দলটি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসের প্রাককালে বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগে প্রতিনিধি দলটি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা প্রান দিয়েছেন তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন এবং বাংলাদেশের সমস্ত মানুষের প্রতি শুভকামনা জানান। বাংলাদেশে অবস্থানকালে তাদের প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আন্তরিকতার জন্য প্রতিনিধি দলটি কৃতজ্ঞতা জানান।

No comments

Powered by Blogger.