উদ্বেগের মধ্যে ত্বকী মঞ্চের প্রতীকী অনশন পালিত by রাজীব নূর ও আসিফ হোসেন

উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা ছিল। তবু শেষ পর্যন্ত নির্বিঘ্নে হয়ে গেল সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের প্রতীকী অনশন। নারায়ণগঞ্জে মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যার ১১ মাস পূর্তি উপলক্ষে
আজ শুক্রবার শহরের চাষাঢ়ায় প্রধান শহীদ মিনারে প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালনের ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই কর্মসূচি পণ্ড করতে সেখানে পাল্টা কর্মসূচি ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগের সাংসদ শামীম ওসমানের সমর্থক ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।

দুই পক্ষই শহীদ মিনারে কর্মসূচি পালন করবে বলে ঘোষণা দেওয়ায় অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জে নাগরিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের অন্যতম নেতা রফিউর রাব্বির ছেলে মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী গত বছরের ৬ মার্চ নিখোঁজ হয়। ৮ মার্চ শহরের চারারগোপ এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীসংলগ্ন কুমুদিনী খাল থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। ত্বকীর খুনিদের গ্রেপ্তার ও ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চ। হত্যাকাণ্ডের পর থেকে রফিউর রাব্বি ও ত্বকী মঞ্চের নেতারা খুনের জন্য শামীম ওসমান, তাঁর ছেলে অয়ন ওসমান, ভাতিজা আজমেরী ওসমানসহ ওসমান পরিবারের সদস্য ও তাঁদের সহযোগীদের দায়ী করে আসছেন।

খুনিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে ত্বকী মঞ্চ প্রতি মাসের ৬ থেকে ৮ তারিখের মধ্যে শহীদ মিনারে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে। গত ৬ ডিসেম্বর ত্বকী মঞ্চের সমাবেশ চলাকালে শামীম ওসমানের অনুসারীরা তোলারাম কলেজ থেকে উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে শহীদ মিনার এলাকায় আসে। একই সময় ত্বকী মঞ্চের লোকজন মিছিল নিয়ে বের হলে সংঘর্ষ বাধার উপক্রম হয়। পুলিশ মিছিল দুটির মাঝখানে অবস্থান নিলে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব হয়। এরপর আবার ৮ জানুয়ারিতে ত্বকী মঞ্চের নির্ধারিত কর্মসূচির সময় শামীম ওসমানের অনুসারীরা শহীদ মিনার দখল করে রাখে। পরে ত্বকী মঞ্চ শহরের ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে গিয়ে সমাবেশ করে। এর দুই দিন পর ১০ জানুয়ারি হত্যাকাণ্ডের ১১ মাস পূর্তিতে ৭ ফেব্রুয়ারি সকাল সাড়ে নয়টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত প্রতীকী অনশন কর্মসূচি পালন করবে বলে ঘোষণা দেয় এবং শহীদ মিনার ব্যবহারের জন্য সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে রাখে।

কিন্তু মহান ভাষা দিবস উপলক্ষে সেখানে একই সময়ে সমাবেশ ডাকেন শামীম ওসমানের অনুগত জেলা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা। গত বুধবার হঠাত্ করেই শামীম ওসমান অনুসারী যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নামে একটি ব্যানার লাগানো হয়। ব্যানারে তিন দিনব্যাপী কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। তবে এ জন্য শহীদ মিনারের তত্ত্বাবধানকারী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাছ থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। ফলে গত বুধবার শহীদ মিনারে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে পারেনি নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোট।

ত্বকী মঞ্চ প্রতীকী অনশনের কর্মসূচি পালন করতে পারবে কি না—এ সংশয়ের কারণে আজ নির্ধারিত সময় সকাল সাড়ে নয়টার দুই ঘণ্টা আগে শহীদ মিনারে অবস্থান নেয়। পরে সকাল নয়টার দিকে ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মী শহীদ মিনারে আসেন। এ সময় ছাত্রলীগের উদ্যোগে সেখানে কিছু চেয়ার নিয়ে আসা হয়। তবে পরিস্থিতি প্রতিকূল বুঝতে পেরে ছাত্রলীগ শহীদ মিনার ছেড়ে আশপাশে অবস্থান নেয়। তাই ত্বকী মঞ্চের অনশন চলাকালে পুরো সময় ধরে সেখানে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করে।

অবশ্য জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি শাফায়াত আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগে জানতাম না যে শহীদ মিনারে ত্বকী মঞ্চের কর্মসূচি আছে। তাই কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়েছিল। তবে অপ্রীতিকর পরিস্থিতি এড়াবার জন্য ছাড় দিয়েছি।’

অনশন শেষে সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি বলেন, ‘আমরা প্রায় এক মাস আগে আমাদের কর্মসূচি ঘোষণা করেছি। শহীদ মিনার ব্যবহারের জন্য নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন থেকে অনুমতি নেওয়ার পর র্যাব ও পুলিশকে কর্মসূচি সম্পর্কে অবহিত করেছি। তবু আমাদের কর্মসূচি পণ্ড করতে শামীম ওসমানের লোকজন পাল্টা সমাবেশ ডেকে আমাদের পূর্বঘোষিত কর্মসূচি ভণ্ডুল করার চেষ্টা করেছে।’

ত্বকী মঞ্চের কর্মসূচি ভণ্ডুল করার চেষ্টা কেন করা হয়েছে—এ প্রশ্ন তুলে রাব্বি বলেন, কারণ ওসমানরা জানেন এখানে কাদের বিরুদ্ধে কথা হবে। কারা ত্বকীকে হত্যা করেছে, এটা সারা দেশের মানুষসহ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও জানেন। তিনি দ্রুত হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার জন্য র্যাবের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, র্যাব কিশোরগঞ্জের সোনালী ব্যাংকের ১৬ কোটি টাকা উদ্ধার করতে পারল মাত্র ৪৮ ঘণ্টায়। অথচ এখনো কেন ত্বকী হত্যা মামলার অভিযোগপত্র দিতে পারল না?

অনশন চলাকালে আরও বক্তব্য দেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের সদস্য সচিব ও নারায়ণগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি হালিম আজাদ, জেলা খেলাঘরের সভাপতি রথীন চক্রবর্তী, জেলা কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি হাফিজুল ইসলাম, জেলা বাসদের সমন্বয়ক নিখিল দাস, নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সভাপতি এ বি সিদ্দিক, সাধারণ সম্পাদক আবদুর রহমান, ত্বকীর চাচা কবি ওয়াহিদ রেজা, নারায়ণগঞ্জ সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি প্রদীপ ঘোষ, জেলা উদীচীর সাবেক সভাপতি খেলাঘরের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক জহিরুল ইসলাম, গণসংহতি আন্দোলনের জেলা সমন্বয়ক তরিকুল সুজন প্রমুখ।
সবশেষে ত্বকীর মা রওনক রেহানা পানি পান করিয়ে অনশন ভঙ্গ করান।

No comments

Powered by Blogger.