কবিতাই বিপন্ন বিশ্বকে বাঁচাবে by কবি ফজল শাহাবুদ্দীন

বাংলা কবিতার ৫০ দশকের অন্যতম প্রধান কবি ফজল শাহাবুদ্দীন এখন অসুস্থ। ব্রেইন স্ট্রোকে আক্রান্ত এ কবির দিন কাটছে নিভৃতে তার বাসভবন ‘নিভৃতি’তে। জন্মেছিলেন ১৯৩৬ সালের ৪ ফেব্র“য়ারি কুমিল্লার নবীনগর থানার শাহপুর গ্রামে। সাপ্তাহিক বিচিত্রার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ফজল শাহাবুদ্দীনকে মূল্যায়ন করা হয় বাংলাদেশের পিরিওডিক্যাল পত্রিকার জনক হিসেবে। কবির ৭৮তম জন্মদিন উপলক্ষে সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করা হল যুগান্তর সাময়িকীর পাঠকদের জন্য। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন কবি শাহীন রেজা। বি.স.
শাহীন : ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত আপনার প্রথম কবিতা কোনটি? কবিতাটি কোন পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল?
ফজল শাহাবুদ্দীন : ‘সন্ধ্যা’ নামের একটি কবিতা। মাসিক মাহে নও আর দৈনিক মিল্লাতের সাহিত্য পাতায়। কবি আবদুল কাদির ছিলেন মাহে নওয়ের সম্পাদক আর মিল্লাতের সম্পাদক ছিলেন কবি তালিম হোসেন।
একজন কবি হিসেবে জীবনটাকে কীভাবে উপভোগ করলেন?
: ভোগ করাই তো হল না। বয়েস তো হল কয়েক কুড়ি। উপভোগের কথা আর কী বলব। একবার মন্ত্রী হওয়ার একটা সুযোগ এসেছিল- তবে হতে পারিনি। হলে হয়তো উপভোগেরও একটা সুযোগ হয়ে যেত।
নিজের লেখা কোন কবিতাটি আপনার প্রিয়? কেন?
: অনেকদিন আগে আমার লেখা একটি ক্ষুদ্র কবিতা আমার বেশ প্রিয় হয়ে উঠেছিল। টাঙ্গাইলের এক তরুণ কবি ঢাকা এলে বারবার আমাকে বলত- এমন একটি কবিতা লিখেও সুখ। হায় মীর আবুল খায়ের আজ কোথায়? সেই তরুণ বয়সেই সেসব ছেড়ে চলে গেল। কবিতাটির নাম ‘কোনো একজনকে’।
কবিতাটি হচ্ছে-
‘তুমি কি জানো না মেয়ে
সবচেয়ে
নীল যার চোখ,
বনের পাখির মতো যার গলা ভাঙে নির্মোকঃ
শ্রাবণ বাতাসে ভিজে
যার দেহ ফুলে ওঠে ঘননীল উতলা শেমিজে
সেই মেয়ে তুমি ছাড়া আর কেউ নয়
জলের সুরভি ভরা শুধু সুরময়।
কৈশোরকালে কবিতা রচনা শুরুর সেই দিনগুলোর কথা কি মনে পড়ে? কেমন ছিল সেই দিনগুলো?
: আমার প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয় আমার বয়স যখন সতেরো বছর তিন মাস- আমি তখন আর কৈশোরকালে ছিলাম না এবং যৌবনেও উপস্থিত হতে পারিনি। রবীন্দ্রনাথের সমাপ্তি গল্পের মতো অবস্থা আমার। দিনগুলো আমার তখন- মধুর ছিল সুন্দর ছিল। এক ধরনের মুগ্ধতা ছিল চিত্তে, এক ধরনের অস্থিরতা ছিল অঙ্গে অঙ্গে, আর এক ধরনের আলো-অন্ধকারের খেলা ছিল সব অনুভবে এবং চৈতন্যে।
এই তো সেই সব দিন সেই সব রাত এবং সেই সব গোধূলি সন্ধ্যা।
কবিতা করতে গিয়ে আপনাকে লেখাপড়া বন্ধ রেখে পোস্ট অফিসে কেরানির চাকরি নিতে হয়েছিল। সেই ঘটনার কথা যদি একটু বলেন...।
: আমার আব্বাকে আমি বলেছিলাম, I have opted for poetry.. ফলশ্র“তি হিসেবে আমাকে আমার শিক্ষা জীবনের সাময়িক ইতি টানতে হয়েছিল। আমি তখন জগন্নাথ কলেজের ছাত্র। সেই সময় আমার বাংলার অধ্যাপক ছিলেন শ্রী অজিত কুমার গুহ এবং মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী। মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী আমাকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন- আমাকে অচিন্ত্যনীয় উৎসাহ দিয়েছিলেন কবিতা রচনায়। একটি গভীর নেশার মতো তখন ছিল কবিতা আমার কাছে। অবশ্য সেটা বেশ পরে উপলব্ধি করেছিলাম।
প্রথম যৌবনের মতো সেই উন্মাদনা। আসলে কবিতা যখন অন্তর্দাহে মিশে যায় তখন আকাশ স্তম্ভিত হয়, নদী উন্মত্ত হয়, আর বৃক্ষ শাখায় আন্দোলিত হয় চিরকালের .....।
যদি ‘প্রিয় কবি’ সম্পর্কে জানতে চাই- তাহলে কার নাম আপনি উল্লেখ করবেন? একজনের নাম.....।
: না, দু’জনের নাম বলছি। রবীন্দ নাথ ঠাকুর ও জীবনানন্দ দাশ।
আধুনিক কবিতার জনক বলা হয় জীবনানন্দকে। তাহলে রবীন্দ নাথ, নজরুল এদের কী বলা যাবে?
: আধুনিক বাংলা কবিতার প্রারম্ভ মাইকেল থেকে। রবীন্দ নাথ আর নজরুল আমাদের আধুনিক মৌলিক কবিদের অন্য দু’জন- যার চতুর্থ জন হলেন জীবনানন্দ দাশ।
তিরিশের পর ‘ছন্দোবদ্ধ’ কবিতার চর্চা নেই বললেই চলে। ছন্দবিহীন কবিতার এই উত্থানকে আপনি কিভাবে দেখেন?
পরবর্তী কবিরা প্রায় সবাই অসংখ্য ছন্দোবদ্ধ কবিতা লিখেছেন- এমনকি সনেটও রচনা করেছেন।
‘কবিতা’ না ‘গদ্য’- সাহিত্যের এ দুটি ধারার কোনটাকে আপনি শক্তিশালী বলে মনে করেন?
: একটি সমুদ্র বাতাস অন্যটি অরণ্য মর্মর- এরকম ভাবতে ভালো লাগে আমার।
এই দেশে একমাত্র কবি, যিনি উপন্যাস রচনা করে অশ্লীলতার দায়ে কারাবরণ করেছেন, তিনি আপনি। সেই উপন্যাস এবং গ্রেফতার প্রসঙ্গে কিছু বলবেন কি?
: সে অনেক লম্বা কাহিনী। আমি ঢাকায় অরণ্যরাত্রির জন্য আর সমরেশ বাবু কলকাতায় প্রজাপতির জন্য এরেস্ট হয়েছিলেন। তবে আমি আগে হয়েছিলাম- সমরেশ বাবু আমাকে কলকাতায় তেমনি কৃতিত্ব দিয়েছিলেন।
প্রত্যেকটি মানুষের জীবনে একটি লক্ষ্য থাকে। আপনার জীবনেও নিশ্চয়ই ছিল- সেই লক্ষ্য সম্পর্কে যদি জানতে চাই।
: আমার জীবনকে আমার একটি লক্ষ্যভ্রষ্ট নক্ষত্রের মতো মনে হয়েছে সব সময়- এখনও মনে হয়। আমার ধারণা সত্যিকার লক্ষ্য থাকে একজন বিজ্ঞানীর, কবির নয়।
আপনার ‘প্রিয় বন্ধু’ কে?
: বন্ধুত্ব একটি আপেক্ষিক অর্থের শব্দ।
সতীর্থ শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ সম্পর্কে যদি মূল্যায়ন করতে বলা হয়- তাহলে কিভাবে করবেন?
: আমার ধারণা শামসুর রাহমান আর আল মাহমুদ পঞ্চাশ দশকের বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবিদের দু’জন। ওরা দু’জনেই আমাকে পঞ্চাশের অনুল্লেখযোগ্য কবি বলে মনে করেন।
প্রায়শঃই আপনি মাইকেল মধুসূদন দত্তের কথা বলেন, উচ্চ কণ্ঠে তার কবিতা আবৃত্তি করেন- তার প্রতি আপনার এই অবসেশানের কারণ কি?
: মধুসূদন আধুনিক বাংলা কবিতার প্রারম্ভ। আমি মধুসূদন দত্তকে বাংলা ভাষার প্রধান মৌলিক কবিদের একজন বলে মনে করি। মধুসূদনকে বাংলাদেশে নতুন করে মূল্যায়ন করা উচিত। মধুসূদনের নাটকীয়তাকে গভীরতার অর্থে আবিষ্কার আর প্রতিষ্ঠা এখন প্রয়োজন।
ইদানীং তরুণদের মধ্যে সনেট চর্চার আগ্রহ একেবারে নেই বললেই চলে। এটিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
: আমি শংকিত নই। সনেটবিহীন একটি কবিতার
জগৎ বৃষ্টিহীন এবং ছায়াহীন ও হাওয়াবিহীন একটি প্রান্তরের মতো মনে হয় আমার।
‘কবিতা’ নিয়ে আপনার কোনো বিশেষ পরিকল্পনা আছে কি?
: আছে। আমি বাংলাদেশে একটি কবিতা লাইব্রেরি ও কবিতা আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করতে চাই। পঁচিশ বছর আগে এমনি একটি বাসনার কথা আমি এবং কবি সৈয়দ আলী আহসান, কবি শামসুর রাহমানসহ উচ্চারণ করেছিলাম।
মরার আগে তেমনি একটি কিছু দেখে যেতে চাই।
আপনাকে বলা হয় ‘অন্তহীনতার কবি’। কেউ কেউ বলেন ‘মুক্তিযুদ্ধের কবি’- এ সম্পর্কে আপনার কি মূল্যায়ন?
: আমি জানি, আমি শুধু একজন কবি।
পৃথিবীর মহাপৃথিবীর প্রকৃতির মহাপ্রকৃতির জগতের মহাজগতের সমুদ্রের মহাসমুদ্রের কবি- শুধু একজন কবি।
আপনার কবিতায় ‘মুক্তিযুদ্ধ’ একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে- অথচ মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ বলে দাবিদার অনেকেই আপনাকে তাদের দলভুক্ত করতে নারাজ- বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
: এরকমটি হয়। কখনও কখনও। কোনো কোনো দেশে। আমার ধারণা, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধটি সবমিলিয়েই একটি অসাধারণ কবিতা। তাকে সঠিকভাবে অনুধাবন করা প্রয়োজন। এখানে স্বপক্ষ-বিপক্ষ অর্থহীন।
‘মুক্তিযুদ্ধ’ নিয়ে যে বিতর্ক, দলাদলি ও বিভক্তি- তাতে করে জাতি হিসেবে আমরা কি দুর্বল হয়ে পড়ছি না? এ থেকে উত্তরণের উপায় কি?
: এসব কিছুই হচ্ছে সততাবিহীন রাজনীতির জন্য। আমাদের জীবনে সত্যকে প্রতিষ্ঠা করতে পারলে এসব বিতর্ক বিভক্তি অপসারিত হয়ে যাবে।
‘মুক্তিযুদ্ধের কবি’ হিসেবে আপনি নিশ্চয়ই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হোক- এটা প্রত্যাশা করেন। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় বিচার শুরু হচ্ছে- সেটাকে কি আপনি সমর্থন করেন?
: একজন কবি হিসেবে সর্বক্ষেত্রে সত্যকে প্রতিষ্ঠিত দেখতে চাই আমি। আমি জানি সত্যই চিরকালের পরম মুক্তি আনবে একদিন।
এক সময় রাজনীতিবিদরা জনগণের জন্য রাজনীতি করতেন। অভিযোগ উঠেছে- এখন তারা নিজেদের এবং দলের জন্য রাজনীতি করেন। এটা কতখানি সত্যি? এ ব্যাপারে আপনার কোনো বক্তব্য আছে কি?
: এক সময় দেশে নেতারা ছিলেন- তারাই নেতৃত্ব দিতেন সব বড় কাজে। এখন নেতারা নেই আছেন শুধু রাজনীতিবিদরা- তারা কেবলি রাজনীতি করেন নিজের জন্য দলের জন্য।
আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের মতো কবিদের মধ্যেও দলাদলি ও বিভক্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ প্রবণতা কি কবিতার জন্য ক্ষতিকর নয়? এ থেকে উত্তরণের কোনো উপায় আছে কি?
: সারাদেশে যখন দলাদলি হয়- সর্বক্ষেত্রে যখন হানাহানি হয়, তখন কবিতা যারা লেখেন তাদের মধ্যেও দলাদলি হানাহানি হবে এটা অনাকাক্সিক্ষত হলেও অসত্য নয়। তবে প্রকৃত কবিতার সঙ্গে এগুলোর কোনো সম্পর্ক নেই। সত্যিকার কবিতার নিজস্ব একটি সংগোপন পথ আছে- সেপথ নির্জন নিঃসঙ্গ এবং শান্তিময়।
কবিতায় যখন রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটে তখন কবিতা কি তার স্বকীয়তা হারায় না? এতে করে কি তার কাব্যগুণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না?
: কবিতা শুধু সে­াগান হয়ে যায়। উচ্চারণ কেবলি চিৎকারের মধ্যে পথ হারায়।
একজন কবি এবং একজন সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য কি?
: সব মানুষই আসলে কবি। যাদের অক্ষরজ্ঞান নেই তারাও। সাধারণ অসাধারণ সব মানুষের মধ্যেই কবিতা সংক্রমিত হতে পারে, হয়। তখন এই সাধারণ সব মানুষের চিত্তেই বৃষ্টি নামে, বাতাস বয়ে যেতে থাকে ক্রমাগত এবং সেই বৃষ্টি আর বাতাস পৃথিবীকে বাঁচায়- মানুষকে উত্তরিত করে এক নতুন চন্দি মায় নতুন শূন্যতায় নতুন শব্দলোকে।
লোকে বলে, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ আপনার বন্ধু। আপনি কি এটাকে সমর্থন করেন? এই বন্ধুত্বের নেপথ্যকথা যদি একটু বলেন-
: সাবেক রাষ্ট্রপতি আমাকে নিজের বন্ধু বলে স্বীকার করেন এটা আমি জানি। এতে সমর্থন করার বা না করার তো কিছু নেই। এরশাদ কিছুদিন আগে মুন্নি সাহা নামে এক ভদ্রমহিলার কাছে একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আমার কবিতা তার ভালো লাগে।
এরশাদ সাহেবের সঙ্গে মিলে আমরা বাংলাদেশে একটা কবিতা উৎসব করেছিলাম, সেই থেকে তার সঙ্গে আলাপ- সেই এশীয় কবিতা উৎসব- এখন তিনি যদি আমার বন্ধু হন তাহলে খুশি হওয়ার কথা তো আমারই। আমি তো তার রাজনৈতিক দলেও যোগ দিতে পারতাম। কিন্তু তিনি তো সেই রকম কোনো কিছুই করেননি।
একজন রাজনৈতিক নেতা কি একজন কবির বন্ধু হতে পারেন?
: মানুষে মানুষে বন্ধুত্ব হয়।
অবশ্য দুটি বেড়াল আছে আমার বাসায়, ওরাও আমার বন্ধু- ওরা আমার কথা বোঝে আমিও ওদের কথা অনুমান করতে পারি।
কবি এরশাদ সম্পর্কে যদি জানতে চাই- তাহলে কীভাবে আপনি শুরু করবেন?
: এই তো বললাম, একজন ভালো মানুষ- যিনি আর একজন মানুষের বন্ধু হতে পারেন।
আপনার একটি কবিতায় আপনি লিখেছেন, ‘প্রেম সেতো একা, এক পক্ষ।’ প্রেম সম্পর্কে আপনার এই মূল্যায়ন কেন? একি একজন কবির অন্তর্গত হাহাকার? নাকি চিরায়ত প্রেমিক সত্তার একান্ত উচ্চারণ?
: এটা মূল্যায়ন নয়। এটা একজন কবির অন্তর্গত এক হাহাকার। আমার বিশ্বাস পৃথিবীর সব প্রেমিকই আসলে কবি- সে শুধু অকাতরে ভালোবাসতে পারে- ভালোবাসা কিংবা প্রেমের লেনদেন করে না করতে পারে না।
জীবনের অস্তলগ্নে যদি প্রিয় কোনো চরণ লিখে যেতে বলা হয়- তাহলে কোন চরণটি আপনি লিখে রেখে যেতে চান?
: শেষ চরণটি- আর্তনাদের মতো কিছু পঙ্ক্তি।
আপনি একজন কবি, আবার একজন সম্পাদকও। এ দুটি চরিত্রে অভিনয় করতে বলা হলে কোনটিতে আপনি সাবলীল বোধ করবেন?
: এ দুটি চরিত্র থেকে বের হয়ে গিয়ে আমি অভিনয় করব তৃতীয় একটি চরিত্রে- কেননা জীবন তো অভিনয় নয়- অভিনয় জীবনের অভিনয় শুধু। আর কিছু নয়।
অগ্রজ কোনো কবির কবিতা কোনোদিন আপনাকে প্রভাবিত করেছিল কি? সেই কবি এবং তার কবিতা সম্পর্কে যদি বলতেন-
: তেমন কিছু নয়। তবে জীবনানন্দের কবিতা আমাকে আপ্লুত করেছিল প্রবলভাবে। মনে আছে আমার রূপসী বাংলার প্রথম দুটি কবিতা কবিকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল। সেখান থেকে একটি লাইন আমি শামসুর রাহমানকে শুনিয়েছিলাম- ‘দেখিব কাঁঠাল পাতা ঝরিতেছে ভোরের বাতাসে’- সেই শুরু। জীবনানন্দ- অন্য কোনো কবির নাম করতে পারব না।
সমকালীন বিশ্ব কবিতায় বাংলা কবিতার কোনো অবস্থান আছে কি?
: কোনো অবস্থান নয়। আমাদের কবিতাগুলো কোনো ইউরোপীয় ভাষায় রচিত হলে আধুনিক বাংলা কবিতার কমপক্ষে ছ’জন কবি নোবেল পুরস্কার পেত। এ কথা আমি জার্মান কবি গুন্টার গ্রাসকে বলেছিলাম।
তরুণদের মধ্যে কোন কোন কবির কবিতা আপনার ভালো লাগে?
: আমি জানি আমাদের তরুণ কবিদের মধ্যে অনেক ভালো কবি আছেন। কিন্তু আমি তো সবার কবিতা পাঠ করতে পারি না। তবে ষাট আর সত্তর দশকের রফিক আজাদ আর প্রয়াত আবিদ আজাদের নাম বলতে পারি।
বাংলাদেশে পিরিওডিক্যাল পত্রিকার জনক বলা হয় আপনাকে। এ দেশের সবচেয়ে আলোচিত পিরিওডিক্যাল পত্রিকা ‘বিচিত্রা’র প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকও আপনি। বিচিত্রার ধারাবাহিকতায় এ দেশে এখন অনেকগুলো সাপ্তাহিক, পাক্ষিক প্রকাশিত হচ্ছে। এই অর্জনকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
: সাময়িকীর সব সময়ই বর্ণাঢ্য। আমি এক সময় সম্পাদক ছিলাম একাধিক সাময়িকীর, মাসিক পত্রিকার, সাপ্তাহিক পত্রিকার।
আমার খুব ভালো লাগে যখন দেখি নতুন নতুন সুন্দর উজ্জ্বল পত্রিকা সব বুকস্টলে ফুটপাতে।
বৈচিত্র্যওতো একটি পিরিওডিক্যাল পত্রিকা- বৈচিত্র্য বর্ণাঢ্য হোক রং ও তুলিতে লেখায় আর কবিতায়- এই আমার কামনা।
আপনি দুটি গান লিখে তিনটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করেছিলেন। সেই দুটি গান এখনও জনপ্রিয়। এরপর আর কোনো গান লিখেননি কেন?
: আধুনিক বাংলা গানের অবস্থা খুব ভালো নয়, এমনি ধারণা আমার দীর্ঘদিনের। সিনেমার গান সম্পর্কে আরও বেশি। উর্দু গান-গজল সবই লিখেছেন এবং এখনও লিখছেন উর্দু সাহিত্যের সত্যিকার ভালো ও প্রসিদ্ধ কবিরা। বাংলা গানের বেলায় তেমনটি হয়নি- সিনেমার গানও তাই। রবীন্দ নাথ আর নজরুল ঐতিহাসিক ব্যতিক্রম। সেই ধারায় দ্বিজেন্দ লাল এবং সমগোত্রীয় অন্যরা। যেমন রজনীকান্ত।
সুতরাং গান লেখার জন্য না আমার কোনো মানসিক প্রস্তুতি ছিল না ইচ্ছা।
এমনি সময় অনুরোধ এল বন্ধু আলমগীর কবিরের কাছ থেকে এবং গান দুটি লিখেও ফেললাম। পুরস্কারগুলো পেয়ে গেলাম। পরে আরও গান লিখিনি কেননা আর কেউ অনুরোধ করেননি।
আপনার একটি কবিতায় আপনি ত্রিশ লাখতম জন্মদিনের কথা বলেছেন। আপনার এই ধারণার পেছনে নিশ্চয়ই কোনো দার্শনিকতা কাজ করেছে- কি সেই দার্শনিকতা- জানতে চাই।
: আমার একটি কবিতায় (অন্ধকারের ওপারে, বাতাসের কাছে) আমি বহুদিন আগে লিখেছিলাম-
আমরা কেউ মরি না
না মানুষ না বৃক্ষ না কীটপতঙ্গ না পাখি
কেউ মরে না, না পৃথিবী না চন্দ
না সূর্য না ঘাসফুল না লতাগুল্ম
না সৌরমণ্ডল না নক্ষত্র না নীহারিকাপুঞ্জ
কেউ মরে না আমরা কেউ মরি না
একটি অন্তহীন মৃত্যুহীন বিলয়হীন
সমাপ্তিহীন জীবনের অংশ হয়ে
আমরা বেঁচে থাকি বেঁচে আছি
এবং এই বেঁচে থাকার
কোনো অতীত নেই বর্তমান নেই ভবিষ্যৎ নেই
একটি সময়হীনতার স্থির কেন্দ্র বিন্দুতে
আমরা বেঁচে আছি সবাই।
এই যে মৃত্যু তার মধ্যে নিহিত আছে আমার ত্রিশ লাখতম জন্মদিনের উচ্চারণ। একটি চিরকাল বিস্মৃত মহাজীবন তার সঙ্গে নিশ্চয়ই একটি নিশ্চিত দর্শন আছে। কিন্তু সে কথা বলতে একটি সম্পূর্ণ গ্রন্থের রচনা শুরু করতে হবে। তার জন্য অন্য সময়, ভিন্ন পরিসর প্রয়োজন।
আশির দশকে ঢাকাতে আপনাদের প্রচেষ্টায় ‘এশীয় কবিতা উৎসব’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে উৎসবের সে­াগান ছিল ‘কবিতা বিপন্ন বিশ্বকে বাঁচাবে’। আজকে বিশ্বব্যাপী হানাহানি সন্ত্রাসের এ মুহূর্তে আপনি কি মনে করেন সেই সে­াগানটি আবার তুলে ধরার প্রয়োজন এসেছে? কবিতা দিয়ে সহিংসা-সন্ত্রাসরোধ কীভাবে সম্ভব?
: কবিতাকে আমরা যদি গ্রহণ করতে পারি সঠিকভাবে, উপলব্ধি করতে পারি প্রার্থনার মতো- তাহলে অনেক কিছুই সম্ভব। আমি এখনও বিশ্বাস করি- ‘কবিতা বিপন্ন বিশ্বকে বাঁচাবে’।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান- এ দু’জন সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
: একজন কবি হিসেবে আমার কোনো সুযোগ নেই এদের মূল্যায়ন করার। আমি শুধু জানি এরা দু’জনই ছিলেন অসম্ভব দেশপ্রেমিক। অসামান্য মানব আর মানবতাপ্রেমিক।

No comments

Powered by Blogger.