ভারতের দৃষ্টিতে সরকারের এক মাস

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশে যে তুলকালাম হয়ে গেল, দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সম্ভবত তা নজিরবিহীন। প্রায় একতরফা নির্বাচন ঠেকাতে বিরোধীদের যাবতীয় কৌশল ব্যর্থ হওয়ার পর দেশের বিরোধী রাজনীতি এ মুহূর্তে একটু থমকে গেছে। গত কয়েক মাসের তুমুল আন্দোলন ও আন্দোলনের নামে জোটবদ্ধ সহিংসতা শেষে এ মুহূর্তের বাংলাদেশ আপাতত হাঁপাতে হাঁপাতে জিরিয়ে নিচ্ছে। নির্বাচনের পর একটা মাস দেখতে দেখতে কেটে গেল। এই এক মাসে নির্বাচন নিয়ে দেশ ও বিদেশে কম হইচই হলো না। ভোট সাঙ্গ হওয়ার পরপরই ভারতের প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশ সরকারকে আশ্বস্ত করল। ভারত এ নির্বাচনকে ‘সাংবিধানিক ও বৈধ’ বলার পাশাপাশি স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দেয়, হিংসা কখনো নির্ণায়ক হতে পারে না। সব রাজনৈতিক দল বা অধিকাংশের যোগদানের মধ্য দিয়ে দ্রুত আরেকটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের যে দাবি পশ্চিমা দুনিয়া থেকে উঠেছে, ভারত তেমন কোনো অভিপ্রায় প্রকাশ করেনি। শুধু বলেছে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে তার মতো করে চলতে দেওয়া দরকার এবং বাংলাদেশের জনগণই সে দেশের নির্ণায়ক ভূমিকায় থাকবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আশ্বস্ত করে ভারতের মতোই তাঁর সরকারের পাশে সমর্থন উজাড় করে একে একে দাঁড়িয়ে পড়ল রাশিয়া ও চীন। দক্ষিণ এশিয়ায় যে তিন বৃহৎ শক্তির প্রভাব ও স্বার্থ অন্য সবার চেয়ে বেশি,
সেই তিন শক্তির সমর্থন সদ্য নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রীকে স্বস্তিই শুধু এনে দেয়নি, তাঁর বিরুদ্ধ-শক্তিদেরও বেশ কিছুটা হতোদ্যম করেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ আরেকটা নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে ঠিকই, কিন্তু শেষ বিচারে তারাও কিন্তু লাগামছাড়া সহিংসতাকে সমর্থন করতে পারেনি। তাদের দাবি বিরোধীদের ভেঙে যাওয়া মনোবল বাড়াতেও বেশ ব্যর্থ। নির্বাচন ঠেকাতে ব্যর্থ হওয়া যদি বিরোধীদের প্রথম হার হয়ে থাকে, দ্বিতীয় হোঁচট তাহলে কূটনৈতিক লড়াইয়ে। সব মিলিয়ে দুই রাউন্ড লড়াই শেষে শাসকগোষ্ঠী বিরোধীদের চেয়ে দুই কদম এগিয়ে গেছে। সাধারণ নির্বাচনের রেশ থাকতে থাকতেই বেজে উঠেছে দেশের উপজেলা নির্বাচনের প্রথম পর্বের দামামা। এই নির্বাচনের দিকে অতীব আগ্রহে তাকিয়ে রয়েছে ভারত। কারণ, ভারত মনে করছে, বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতির গতি কোন খাতে বইবে, কয়েক দফার এই নির্বাচন তা ঠিক করে দিতে পারে। ভারতের যাঁরা বাংলাদেশের রাজনীতিকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেন, যাঁরা নীতি নির্ধারণে সহায়ক হন, তাঁদের ধারণাও এমন যে, ভোট বর্জন করে বিএনপি নিজেদেরই বিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছে এবং ভবিষ্যতের সমস্যাও সৃষ্টি করেছে। বিএনপি অতিমাত্রায় পশ্চিমা দুনিয়ার ওপর ভরসা করেছিল। ভেবেছিল, তারা বাংলাদেশ সরকারকে বাধ্য করাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মেনে ভোটে যেতে।
এ অন্ধ নির্ভরতা তাদের পক্ষে যে সহায়ক হয়নি, নির্বাচন কেটে যাওয়ার পর এখন তা বোধগম্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নবনির্বাচিত সরকারের কূটনৈতিক স্বীকৃতিপ্রাপ্তি ঠেকানো যায়নি। আরও একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবি তোলা সত্ত্বেও পশ্চিমা দুনিয়া এ কথা জানিয়ে দেয় যে তারা এই সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে। দ্রুত নির্বাচনের দাবিও ক্রমে আবছা হয়ে আসছে। ফলে দল রাখতে শেষ পর্যন্ত উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত একরকম বাধ্য হয়েই বিএনপিকে নিতে হয়েছে। এই সিদ্ধান্তই কিন্তু বুঝিয়ে দিচ্ছে, বিরোধীদের ভোট বর্জনের আগের সিদ্ধান্তটি কত বড় ভুল ছিল। কারণ, এক মাস আগের পরিস্থিতির সঙ্গে আজকের অবস্থার মৌলিক কোনো পরিবর্তন কিন্তু ঘটেনি। এক মাস আগে নবম সংসদের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন শেখ হাসিনা, দশম সংসদের প্রধানমন্ত্রীও তিনি। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি হাসিনা মানেননি, সংশোধিত সংবিধান অনুযায়ী তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বেই ভোট হয়েছিল, এবারও উপজেলা নির্বাচন হবে তাঁরই শাসনামলে। বিএনপি যে যুক্তিতে সাধারণ নির্বাচন বর্জন করেছিল, অবস্থা অপরিবর্তিত থাকায় সেই একই যুক্তিতে উপজেলার ভোটও তাদের বর্জন করা উচিত। কিন্তু তা না করায় প্রশ্ন উঠতেই পারে, বিএনপির কোন অবস্থানটা ঠিক আর কোনটা ভুল। আগেরটা ঠিক হলে এবারেরটা ভুল, নয়তো আগেরটা ভুল হলে এবারেরটা ঠিক। দ্বিতীয় প্রশ্নটিও এরই পিঠাপিঠি এসে পড়ছে। উপজেলা নির্বাচন শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও অবাধ হলে সরকার বা নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্বের আশঙ্কা বা অভিযোগ আর ধোপে টিকবে না। সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দ্রুত আরও একটি নির্বাচনের দাবির যৌক্তিকতাও ফিকে হয়ে যাবে। ওই দাবিতে আন্দোলন অযৌক্তিক হয়ে পড়বে।
উপজেলার ভোট শান্তিপূর্ণ হলে একরকম, না হলে অন্য রকম। বাংলাদেশের রাজনীতির পরবর্তী প্রবাহ অনেকটাই নির্ভর করছে ভোট কেমন হয় তার ওপর। ভারতের নজরও সেদিকে। ভোট-পরবর্তী এই এক মাসে ভারতের নজরে বেশ কয়েকটি বিষয় এসেছে। যেমন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের মধ্য দিয়ে পূর্বতন সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের ক্ষোভে প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। দুর্নীতিগ্রস্তদের বেশির ভাগকে বাদ দিয়ে স্বচ্ছ ভাবমূর্তির মানুষদের তিনি দায়িত্বে এনেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, বিরোধীদের হতোদ্যম করে কথায় কথায় হরতালের ডাক দেওয়ার মারাত্মক প্রবণতা বন্ধ করেছেন। এতে সাধারণ মানুষ হাঁফ ছেড়ে বাঁচছেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দিকে নজর দেওয়ায় রাজনৈতিক-অসামাজিক অপকর্মের হার কমছে। ভারত খুব আগ্রহের সঙ্গে নজর রাখছে বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের গতি-প্রকৃতির ওপর। জামায়াতের সহিংসতা বন্ধে সরকারের কঠোর মনোভাব কত দিন বজায় থাকে এবং বিএনপিও কত দিন তাদের আগের মতো গুরুত্ব দেয়, তার ওপরও দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি অনেকখানি নির্ভর করবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া চালিয়ে যাওয়া ও তাদের শাস্তিদান নতুন সরকারের অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার থেকে সরকারকে সরাতে চাপ সৃষ্টির শেষ নেই। পাকিস্তান ইতিমধ্যেই নানাভাবে চাপ দিতে শুরু করেছে।
ভারতও তার মতো করে সচেষ্ট। জামায়াতকে কোনো রকম রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসর হাসিনা সরকার দিক, এটা ভারতের কাম্য নয়। জামায়াত দমনে হাসিনা সরকারের পাশে থাকার বিষয়ে ভারতের বিন্দুমাত্র দোলাচল নেই। জামায়াত দমন কর্মসূচি ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-প্রক্রিয়া চালু রাখা সত্ত্বেও ইসলামি দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রিজ (ওআইসি) শেখ হাসিনার সরকারকে অভিনন্দন জানিয়েছে। ভারত মনে করছে, নতুন সরকারের এটাও একটা বড় কূটনৈতিক সাফল্য। গণতন্ত্রে মানুষের আস্থা অর্জনই প্রথম ও শেষ কথা। সেই আস্থা অর্জনের প্রথম ধাপ হলো বিশ্বাসযোগ্য ও ভরসাযোগ্য একটা সরকার গঠন। হাসিনা একেবারে প্রাথমিক এ কাজে সফল বলে ভারত মনে করছে। তাঁর দ্বিতীয় কাজ হওয়া উচিত আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি। ভোটে জেতার পর হাসিনা দেশের সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় যেভাবে তৎপর হয়েছেন ও এ প্রবণতা বন্ধে যে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক বার্তা দিয়েছেন, ভারত তাতে খুশি। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশিই চলে আসে সুপ্রশাসনের প্রশ্ন। এই সুপ্রশাসন নিশ্চিত করতে গিয়ে তাঁকে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলকেও শাসন করতে হবে। ভারত মনে করে, যে যে বিষয়ে হাসিনাকে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে, সেগুলোর অন্যতম হলো এত দিন নিজের দলের বিভিন্ন সংগঠনে লাগাম না টানা। দীর্ঘ মেয়াদে মানুষের মন জেতার জন্য এই দিকে তাঁর নজর দেওয়া আবশ্যিক। মন্ত্রিসভায় যা করেছেন,
সংগঠনেও তা করা প্রয়োজন। প্রশাসনিক এসব অবশ্য কর্তব্যের মধ্য দিয়েই প্রধানমন্ত্রীকে উজ্জ্বল করে তুলতে হবে দেশের অর্থনীতির চালচিত্রটা। দেশের স্বাধীন ‘থিঙ্ক ট্যাঙ্ক’ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের হিসাব অনুযায়ী লাগাতার রাজনৈতিক অসন্তোষের দরুন গত বছরে আনুমানিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৬ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার। বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর পরিমাণও নানা কারণে কমে গেছে। বিদেশে কর্মসংস্থানের সংখ্যাও কমেছে। লাগাতার আন্দোলনের ডাক, আন্দোলনের নামে সহিংসতা, মানুষ খুন, হরতাল, সম্পত্তি নষ্ট দেশের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হারে কোপ মেরেছে। প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ থেকে কমে ৫ দশমিক ৭ শতাংশে দাঁড়াবে বলে অনুমান। হাসিনাকে এই দক্ষিণমুখী প্রবাহকে রুখে উত্তরমুখী করে তুলতে হবে। কাজটা কঠিন কিন্তু অসম্ভব নয় বলেই ভারত মনে করে। নির্বাচনের পর গত এক মাসে দেশ আবার স্বাভাবিক হওয়ার দিকে অনেকখানি এগিয়েছে। এই গতি অব্যাহত রাখাই হাসিনার প্রথম ও প্রধান কাজ হওয়া উচিত বলে ভারত মনে করছে। তাহলে বেশির ভাগ দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে দেশের সংসদের পরবর্তী নির্বাচনের পশ্চিমা ও প্রধান বিরোধী দলের সম্মিলিত দাবি কত দ্রুত পূরণ হতে পারে? সরকারের প্রথম মাসপূর্তির প্রাক্কালে ভারত মনে করে, একমাত্র বাংলাদেশের মানুষই তা ঠিক করবেন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি।

No comments

Powered by Blogger.