দৈনন্দিন জীবনে মাতৃভাষাচর্চা

আল্লাহ তাআলা মানুষকে কথা বলা, পড়া ও শেখার জন্য বোধগম্য ও জ্ঞানপূর্ণ আলোকিত ভাষা দিয়েছেন। মহান সৃষ্টিকর্তা মাতৃভাষাকেই শিশুর আত্মার সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে গেঁথে দেন। শৈশবে মাতৃক্রোড়ে প্রথম মানবসন্তানের মুখে ফুটে ওঠে ‘মা’ শব্দটি, তা-ই মাতৃভাষা, প্রাণের ভাষা। হূদয়ের ব্যক্ত-অব্যক্ত সব লৈখিক বা মৌখিক ভাষার বহিঃপ্রকাশ দৈনন্দিন জীবনে মায়ের ভাষায় ঘটে থাকে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘পরম করুণাময় (আল্লাহ)। তিনিই কোরআন শিক্ষা দিয়েছেন। তিনিই মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তিনিই তাকে ভাব প্রকাশ করতে বা কথা বলতে (ভাষা) শিখিয়েছেন।’ (সূরা আর-রাহমান, আয়াত: ১-৪) জ্ঞান-বিজ্ঞান, ভাষা-সাহিত্য, শিল্প-সংস্কৃতি, মেধা-মনন, সুপ্ত প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও চিন্তাচেতনায় মানবজাতি যে গৌরবময় অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে, তার মুখে রয়েছে স্রষ্টাপ্রদত্ত বাক্শক্তি বা মাতৃভাষা।
পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের মানুষের যেকোনো ভাষায় কথা বলা তার স্বভাবজাত, জন্মগত, সর্বজনীন ও আল্লাহপ্রদত্ত মানবাধিকার। পরিবেশ, পরিস্থিতি ও অবস্থাভেদে প্রয়োজনীয় কথা বলার ধরন, প্রকার ও বিন্যাস বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। মানুষ সবাক প্রাণী। তার বাগ্যন্ত্র ও মাতৃভাষার ব্যবহার যত সুন্দর ও যথার্থ হবে; ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে শান্তিশৃঙ্খলা এবং নিয়মানুবর্তিতা ততই পরিলক্ষিত হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় কথা বলা বা ভাষা ব্যবহারের সময় সবার সজাগ-সচেতন থাকা উচিত। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা ঘোষণা দিয়েছেন, ‘কথায় কে উত্তম ওই ব্যক্তি অপেক্ষা, যে আল্লাহর প্রতি মানুষকে আহ্বান করে, সৎ কর্ম করে এবং বলে, “আমি তো আত্মসমর্পণকারীদের অন্তর্ভুক্ত।”’ (সূরা হা-মীম আস-সাজদা, আয়াত: ৩৩) মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক আলোচনায় যেসব কথা বলা হবে, তা উত্তম ভাষা ও জ্ঞানসমৃদ্ধ হওয়া বাঞ্ছনীয়। কথা যেন জনকল্যাণকামী ও চমকপ্রদ হয়, মাতৃভাষার মাধুর্য দ্বারা নিজের ও অন্যের উপকার হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর বক্তৃতা ও বাচনভঙ্গি ছিল অতুলনীয়। তিনি বিশুদ্ধ মাতৃভাষার অধিকারী ছিলেন। তাই বিনম্র কণ্ঠে শুদ্ধ কথা সবারই প্রিয়। ইসলামে নরম স্বরে সহজ-সরল ও বিশুদ্ধ ভাষায় কথা বলার দিকনির্দেশনা রয়েছে।
পবিত্র কোরআনে বুদ্ধিমত্তা, উত্তম বাক্য ও ভাষা দ্বারা ইসলাম প্রচারের আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছে, ‘তুমি মানুষকে তোমার প্রতিপালকের পথে প্রজ্ঞা ও সদুপদেশ দ্বারা আহ্বান করো এবং তাদের সঙ্গে সদ্ভাবে আলোচনা করো।’ (সূরা আন-নাহল, আয়াত: ১২৫) জনসমাবেশে বা মজলিসে উপবিষ্ট হয়ে এমন ভাষায় কথা বলা যাবে না, যাতে অন্যের তিরস্কার প্রচ্ছন্ন আছে এবং যা অন্যের মর্যাদার জন্য হানিকর। বরং মানুষের কথাবার্তা ও ভাষার প্রয়োগ এমন হূদয়গ্রাহী ও মনোমুগ্ধকর হওয়া উচিত, যা সঠিক, মার্জিত, রুচিসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ। পরিবার, সমাজ ও জাতির অধিকাংশ সদস্য যদি সাবলীল ভাষা প্রয়োগের দিকে বিশেষ খেয়াল রাখে, তাহলে পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-কলহ, ঝগড়া-বিবাদ, সংঘাত-সংঘর্ষ, হিংসা-বিদ্বেষ, পরচর্চা-পরনিন্দা ও প্রতিশোধপ্রবণতা বহুলাংশে লোপ পাবে এবং মানুষের মধ্যে অযথা শত্রুতা সৃষ্টি হবে না। পবিত্র কোরআনে এমন শুভদ শিক্ষা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সঠিক কথা বলো। তাহলে তিনি তোমাদের কর্মকে ত্রুটিমুক্ত করবেন এবং তোমাদের পাপ ক্ষমা করবেন।’ (সূরা আল-আহজাব, আয়াত: ৭০-৭১) দৈনন্দিন জীবন পরিচালনায় নরম, বুদ্ধিদীপ্ত ও প্রাণস্পর্শী কথা বলা উচিত। মাতৃভাষায় বাক্যালাপের মাধ্যমে স্বজাতির সঙ্গে নর-নারীর ভাবের আদান-প্রদান হয়। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার প্রতিটি মুহূর্ত ভাগাভাগি করা যায়। তাই মানুষ যখন কথা বলবে, তখন সুস্পষ্ট উচ্চারণে আস্তে আস্তে বলবে। অযথা চিৎকার করে মাত্রাতিরিক্ত কথা বলা নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক। পবিত্র কোরআনে সাবধান করা হয়েছে, ‘তুমি সংযতভাবে পদক্ষেপ করবে এবং তোমার কণ্ঠস্বর নিচু করবে! কেননা, স্বরের মধ্যে গর্দভের স্বরই সর্বাপেক্ষা অপ্রীতিকর।’ (সূরা লুকমান, আয়াত: ১৯)
মানুষ যে মাতৃভাষা বা কথা মুখ থেকে বের করে, এর ওপর আল্লাহর ফেরেশতারা সাক্ষী থাকেন। মানুষ যখন একটি মিথ্যা কথা মুখে উচ্চারণ করে, তখন তার কাঁধের ফেরেশতাদ্বয় তার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। তাই মানুষকে সতর্ক করে বলে দেওয়া হয়েছে, ‘মানুষ যে কথাই উচ্চারণ করে, তা লিপিবদ্ধ করার জন্য তৎপর প্রহরী তার সন্নিকটেই রয়েছেন।’ (সূরা কাফ, আয়াত: ১৮) এ জন্য প্রত্যেক মানুষের উচিত মুখ থেকে বেফাঁস কোনো কথা বের করার আগে এর পূর্বাপর সব দিক চিন্তাভাবনা করা। গুরুজনেরা যথার্থই ধর্মের উপদেশবাণী প্রচার করে বলেন, ‘সদা সত্য কথা বলিবে, কখনো মিথ্যা বলিও না।’ মানুষকে মাতৃভাষা দান করা হয়েছে সঠিক মনোভাব প্রকাশের জন্য। এর জন্য প্রথমে কথাবার্তার উদ্দেশ্য ও অর্থ নির্ণয় করা এবং যথার্থতা প্রতিপন্ন করা প্রয়োজন। এরপর উত্তম ও উপযোগী পন্থায় মনের ভাব প্রকাশ করা উচিত। এটাই হচ্ছে নিরর্থক ও মিথ্যা বাক্যালাপ থেকে বেঁচে থাকার সহজ উপায়। দৈনন্দিন জীবনে মিথ্যাচারিতা, অপবাদ, দোষারোপ, কলঙ্ক রটানো, অসাক্ষাতে নিন্দা ও প্রতারণামূলক অন্যায় কার্যকলাপ কমবেশি প্রায়ই ঘটছে। বাক্যালাপে সদাচার ও মিথ্যাচার উভয়ই মানুষের ভেতর তথা মনোভাব ও অভিব্যক্তির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কযুক্ত। মানুষের কথাবার্তা, কাজকর্ম, ভাষার ব্যবহার ও আচার-আচরণে এগুলো প্রকাশ পায়। তাই ইসলামের দৃষ্টিতে বাক্যালাপে প্রকাশ্যে বা গোপনে কথায় কাজে ভারসাম্যপূর্ণ মাতৃভাষা ব্যবহার ও প্রয়োগে সামঞ্জস্য থাকা দরকার।
ড. মুহাম্মদ আবদুল মুনিম খান: বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক, গবেষক ও কলামলেখক।
dr.munimkhan@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.