বইমেলার আকাশে অনেক তারা

বইমেলা
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের আকাশে একটা বাঁকা চাঁদ। আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। আজ ষষ্ঠী। কমলার কোয়ার মতো আকার নিয়েছে চাঁদটা। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের খিলানগুলোর পাশে বটগাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এই চাঁদ প্রতি ফেব্রুয়ারিতেই উঁকি দেয়। বড় হয়, ছোট হয়। একাডেমি চত্বরে বড় আমগাছটার মুকুল ঝরে পড়ে থাকে মাটিতে, গন্ধে ম-ম করে। এ ফেব্রুয়ারিতে একাডেমির মূল চত্বরে মাত্র একবার গিয়েছি, একটা বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে। অন্য সন্ধ্যাগুলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরেই ঢুঁ মারি।
উদ্যানের ভেতরেই তো আমার প্রিয় প্রকাশনা সংস্থাগুলো—প্রথমা, সময়, অনন্যা, কাকলি, অন্যপ্রকাশ, ইউপিএল, সাহিত্যপ্রকাশ, অনুপম, মাওলা ব্রাদার্স, জ্ঞানকোষ, পার্ল, তাম্রলিপি, জাগৃতি, শ্রাবণ, সন্দেশ, পাঠকসমাবেশ ইত্যাদি। কত প্রকাশক, কজনের নাম বলব! আমার চোখের সামনেই মেলা বড় হলো। সেই যে আশির দশকের শুরুতে বুয়েটে পড়ব বলে ঢাকায় এসেছিলাম। বন্ধুদের নিয়ে যেতাম বাংলা একাডেমির বইমেলায়। পুকুরের পাড়ে একটা স্টলে লেখা: এখানে নির্মলেন্দু গুণকে পাওয়া যায়। তখনই আরেক রসিক কবির ফোঁড়ন, নির্মলেন্দু গুণের ডজন কত? মনে হচ্ছে সেদিনের ঘটনা। আমার প্রথম কবিতার বই খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে বেরিয়েছে, ১৯৮৯ সাল, একটা মাদুরে বইগুলো বিছিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লাম একাডেমি চত্বরে। তখন আমার ওজন ছিল ৫০ কেজি, এখন ওজন ৮০। তখন বয়স ছিল ২৪, এখন ৪৯। প্রথম বই যে বয়সে বেরিয়েছিল, ২৪-এ, তার চেয়ে বেশি বছর তারপর আমি পার করে দিলাম, ২৫ বছর পরে এখন আমার বয়স ৪৯। কিন্তু নিজেকে এখনো সেই হালকা-পাতলা জিনসের নীল রঙের শার্ট পরা এলোমেলো চুলে বড় দাঁতের কিশোরটিই মনে হয়।
মনে হচ্ছে, ওই তো দাঁড়িয়ে আছেন আহসান হাবীব, উন্মাদ সম্পাদক, তাঁর কাছে নিয়ে গেলেন বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের মাহফুজ ভাই, বললেন, ‘এর বই রাখো তোমার স্টলে।’ হাবীব ভাই এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। আমার বই বইমেলার একটা স্টলে শোভা পাচ্ছে। বইমেলার ভেতরেই তখন বসত চায়ের দোকান। অনেকগুলো। হুমায়ূন আহমেদ, শামসুর রাহমান, মহাদেব সাহা—সবাই সেই চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিতেন। মহাদেবদার পাশের চেয়ারে বসেছিলাম। শামসুর রাহমান আর হুমায়ূন আহমেদও একই টেবিলে বসে পড়ায় টেবিলের মর্যাদা হঠাৎ গেল বেড়ে। আমি কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় কবি ফেরদৌস নাহার পাশ দিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলেন, ‘মিটুন তো দেখি একেবারে বড়দের দলে যোগ দিয়ে বসেছ।’ লজ্জায়, সংকোচে কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এসব স্টলে অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিতেন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। বইমেলা থেকে বের হয়েই একবার রাতের ট্রেনে তাঁর সঙ্গে ময়মনসিংহে গিয়েছিলাম কবিতা পড়তে। ভোরের কাগজ বের হলো ফেব্রুয়ারি মাসে। স্টল নেওয়া হলো বইমেলায়। তখন ভোরের কাগজ-এর শেষ পাতায় লিখতে শুরু করলাম বইমেলা প্রতিদিন। এখন সেটাই রেওয়াজ হয়ে গেছে, সব পত্রিকাতেই রোজ বইমেলার খবর ছাপা হয়। ভোরের কাগজ-এ আমিই লিখেছি কয়েক বছর। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আসতেন।
আমি তো ছোট্ট একটা মানুষ, গিয়ে স্যারের আঙুল ধরে ফেললাম। বললাম, ‘স্যার, কেমন লাগছে মেলা? কী কী বই বেরোল।’ হাসলেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে পুরো মেলা হাঁটলেন। কিন্তু প্রশ্নের উত্তর দিলেনই না। সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো না। হাসান আজিজুল হক স্যার এলে তো আমি পোষা বিড়ালের মতো চঞ্চল হয়ে উঠতাম। তখন আমারও দু-একটা বই বেরিয়ে গেছে, কিশোর পাঠকেরা স্যারের সামনেই হয়তো আমার কাছে অটোগ্রাফ চাইছে, আমি লজ্জায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছি, রশীদ হায়দার তাই দেখে বললেন, ‘হাসানকে পেয়ে আনিস যে একেবারে পাগল হয়ে গেলে!’ আরও লজ্জা! আমি কি রশীদ ভাইকেও কম পছন্দ করি নাকি। আশির দশকে মেলায় হাঁটতেন হেলাল হাফিজ। আমি তাঁর সঙ্গে হাঁটতাম। একদিন অনেকক্ষণ হাঁটার পরে রসিকতা করে বললাম, ‘নাহ্, আর বড় কবিদের সঙ্গে হাঁটব না।’ হেলাল ভাই হেসে বললেন, ‘এভাবে বলতে হয় না আনিস।’ সেই হেলাল ভাই এবার বাংলা একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন। অভিনন্দন, হেলাল ভাই। দাদাভাইয়ের কথাও খুব মনে পড়ে। রংপুরে থাকতে কচি-কাঁচার মেলা করতাম বলে ঢাকায় এসে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন আশ্রয়। প্রথম দিকে কচি-কাঁচার আসরে ছড়া-কবিতা ছাপা হতো, পরের দিকে তাঁর সম্পাদিত ইত্তেফাক-এর বিশেষ সংখ্যাগুলোয় ছাপিয়ে দিতে লাগলেন কবিতা। একদিন তিনি হাঁটছেন বর্ধমান হাউসের ঝুলবারান্দার সামনে দিয়ে,
সঙ্গে লুৎফর রহমান রিটন আর আমীরুল ইসলাম, আমি ছুটে গেলাম, ‘দাদাভাই, জানেন, আমার বই অমুক আর অমুক লেখকের মতোই বিক্রি হয়।’ দাদাভাইয়ের মুখের কথা একটু আটকে যেত, বললেন, ‘সেটা তো ভালো খবর হলো না!’ খুব হতোদ্যম হয়েছিলাম। হুমায়ুন আজাদের উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে নিয়মিত। বসতেন আগামীর স্টলে। বেলা তিনটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত স্বাক্ষর দিতেন বইয়ে। কথা বলতেন পাঠকদের সঙ্গে। প্রথমবার যখন তাঁর নারী বইমেলায় এল, নদী থেকে বেরিয়েছিল, প্রথম দিন মলাট ছাড়াই, তাই বিক্রি হয়ে যেতে লাগল। আমি বললাম, ‘স্যার, নারী তো কভার ছাড়াই বিক্রি হয়ে যাচ্ছে।’ তিনি বললেন, ‘নারী তো কভার ছাড়াই ভালো।’ এটা লিখে দিয়েছিলাম বলে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘বেশি স্মার্ট হোয়ো না।’ কিন্তু এত ভালোবাসতেন আমাকে যে পরের দিনই সব ভুলে গিয়ে ডেকে নিলেন কাছে। মুহম্মদ জাফর ইকবালের সঙ্গেও আমার প্রথম পরিচয় বইমেলাতেই। আহসান হাবীব ভাই-ই পরিচয় করিয়ে দিলেন। জাফর স্যার যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন, নতুন লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হতে চান, আহসান হাবীব ভাই আমাকে তাঁর স্টলের সামনে দাঁড় করিয়ে রেখে জাফর ইকবাল স্যারকে ডেকে আনলেন, ‘এই যে আনিসুল হক, নতুনদের মধ্যে যারা...’ সেই যে মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের সঙ্গে খাতির হলো, সেটা আজ অবধি অটুট আছে। হুমায়ূন আহমেদ জনপ্রিয় হয়ে গেলে আর বইমেলায় স্বাভাবিকভাবে আসতে পারতেন না। আসতেন রাত সাড়ে আটটার দিকে। এসে যে স্টলে বসতেন, সেই স্টলে এমন ভিড় হতো যে স্টল ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হতো।
অমনি ভিড় ঠেলে স্যারের কাছে গিয়ে বাচ্চাদের একটা বই কিনে বললাম, স্যার, আমার মেয়ে পদ্যর জন্য অটোগ্রাফ দেন। স্যার লিখলেন, ‘পদ্য, তুমি কেমন আছ?’ একটা লাইন হঠাৎ লিখে ফেলেই তিনি আমাকে বুঝিয়ে দিলেন, কেন একজন মানুষ সবার থেকে আলাদা। মাহমুদুল হককে আমি কখনো বইমেলায় দেখিনি। কিন্তু তাঁর বই কবে আসবে, সাহিত্যপ্রকাশে গিয়ে খুব খোঁজ নিতাম, আরেকজনকে খোঁজ নিতে দেখতাম, আমাদের লেখক বন্ধু ইমতিয়ার শামীমকে। তাঁকে দেখলাম বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণেই, খাটিয়ার মধ্যে শোয়ানো। সমুদ্র গুপ্ত খুব মজার মানুষ ছিলেন। বড় বড় চুল, সাদা, বড় বড় গোঁফ, বইমেলায় হেঁটে বেড়াচ্ছেন! একাকী রৌদ্রর দিকে নামে তাঁর কবিতার বই বেরোল, তাতে কবিতা ছিল, ধুলো নিয়ে, সেটা উদ্ধৃত করে বললাম, মেলায় ভীষণ ধুলো...তিনি পরের দিন বললেন, ‘প্রচারটা কায়দা করে ভালোই দিয়েছিস রে!’ প্রণব ভট্ট ছিলেন এক মজার চরিত্র। কার বই বেশি বিক্রি হচ্ছে, এটা খোঁজ নিয়ে বেড়াতেন বিভিন্ন স্টলে। হুমায়ূন স্যার তাঁকে বই উৎসর্গ করে লিখেছিলেন, ‘তাঁর পুরোটা শরীরজুড়ে কলিজা।’ সত্যি, তিনি আমার বইয়ের বিজ্ঞাপন বিভিন্ন পত্রিকায় তাঁর খরচে প্রকাশ করে দিতেন। শহীদুল জহিরকে আমি কোনো দিনও বইমেলায় দেখিনি, কিন্তু যেবার সেরাতে পূর্ণিমা ছিল বেরোল, সেবার হইচই পড়ে গিয়েছিল। খন্দকার আশরাফ হোসেন কিন্তু ছিলেন বইমেলার নিয়মিত চরিত্র, বই বেরোত, লিটল ম্যাগাজিন বেরোত, টিচার ইন ল কথাটা তিনিই আমাকে শিখিয়েছিলেন আর ফাঁদ বইটা হাতে নিয়েই বলেছিলেন কাফকায়েস্ক। এবার বইমেলায় আমরা তো খুব অনুভব করব মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানেরও অভাব।
সেই কবে বাংলা একাডেমি স্টল থেকে কিনেছিলাম তাঁর গঙ্গাঋদ্ধি থেকে বাংলাদেশ। তাঁর বইটা, আমরা কি যাব না তাদের কাছে যারা শুধু বাংলায় কথা বলে, খুব নাড়া দিচ্ছে। আমরা সবকিছুতে ইংরেজিতে ফিরে যাচ্ছি। বিয়ের আমন্ত্রণপত্র থেকে শুরু করে দোকানের নামফলক। কিন্তু খুব বিস্মিত হয়েছি, প্রশাসনের প্রশিক্ষণেও ইংরেজিরই চল দেখে। এখনো বইমেলায় মাঝেমধ্যেই আসেন সৈয়দ শামসুল হক ও আনোয়ারা সৈয়দ হক। পাশে গিয়ে দাঁড়াই। ছবি তুলি। কী যে ভালো লাগে। আনিসুজ্জামান স্যারকে আসতে হয়, চেয়ারম্যান হিসেবে, আবার অনুরোধের ঢেঁকি গিলতে, বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করতে। কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী, হাশেম খান এলেই বুঝতে হবে, সেরা স্টলের পুরস্কারের বিচার চলছে। মুনতাসীর মামুন স্যারের সঙ্গ খুব মজার, আগে সময় প্রকাশনীতে কিছুক্ষণ সময় কাটানোর পরে একটা ঢাউস বই বিক্রি হলেই ফরিদ আহমেদকে বলতেন, ‘ফরিদ, এবার মনে হয় এক কাপ চা খাওয়ার দাম উঠেছে।’ আমরা দুজনই ফরিদ আহমেদের কিপ্টেমি নিয়ে খুবই রসিকতা করি, ফরিদ ভাই সহ্য করেন। আসাদুজ্জামান নূর অনেক আগে থেকেই বইমেলায় নিয়মিত আসেন এবং বই কেনেন। আবুল মাল আবদুল মুহিতও আসতেন কেডস পরে, বৈকালিক হাঁটার কাজটাও সারতেন, বইও কিনতেন। মন্ত্রী হওয়ার পরে তো তাঁদের পেছনে ভিড় লেগে থাকবে।
যেমন নিরিবিলি হাঁটতে দেখা যাবে রামেন্দু মজুমদারকে। এক আধবার আসবেন আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ। কিছুক্ষণ বসবেন। তারপর চলে যাবেন। মুহম্মদ জাফর ইকবাল এলে তো পেছনে তাঁকে মৌচাকের মতো ঘিরে ধরবে কিশোর-তরুণেরা। ইমদাদুল হক মিলন সম্পাদক হয়ে যাওয়ার পর কম সময় পান, তবু বলি, মিলন ভাই, বইমেলায় সময় দিন, আসুন। যেমন সেলিনা হোসেন, সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, মঈনুল আহসান সাবের, নাসরীন জাহান, তবক দেওয়া পান মুখে আসাদ চৌধুরীকে না দেখলে মনে হবে বইমেলা অসম্পূর্ণই রয়ে গেল। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই বইমেলা হোক। সব স্টল সামনেরবার শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই থাকুক। এমনকি উদ্যানের উন্মুক্ত মঞ্চ ও গ্যালারিটাও নিয়ে নেওয়া হোক মেলার ভেতরে, সেখানে অনুষ্ঠান হোক। বড় লেখক ও আলোচকেরা একাডেমি প্রাঙ্গণে সেমিনার করে ওই পাশে যদি পদধূলি না দেন, তাহলে কেমন করে হবে? বইমেলায় যাই। সন্ধ্যার আকাশে চাঁদ ওঠে। একদিন যে লেখকেরা-কবিরা এই মেলায় নিয়মিত আসতেন, আজ আর আসেন না, তাঁদের কথা মনে পড়ে। কিন্তু আকাশভরা অনন্ত নক্ষত্রবীথি দেখলে মনে হয়, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে শামসুর রাহমান—প্রত্যেকেই তো আছেন মেলায়। বই থাকা মানেই তো লেখকদের উপস্থিতি।
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.