‘ডিসেম্বর অন যশোর রোড’

যশোর রোড পেছনে ফেলে নাভারন মোড় হয়ে সাতক্ষীরা-যশোর আঞ্চলিক সড়কে ঢুকতেই চালক ইব্রাহিম আলীর মুঠোফোন বেজে ওঠে। কার সঙ্গে কী আলাপ করলেন, বোঝা গেল না। কিন্তু সাফ জানিয়ে দিলেন, আর যাওয়া যাবে না। গত ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যশোরে পৌঁছে সেখানেই রাত কাটাই। ১৬ ডিসেম্বর সকালে সাতক্ষীরায় যাওয়ার উদ্দেশে বেরিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হলো। হরতাল-অবরোধ কিছুই নেই; তবু গণপরিবহন চলাচল করছে না। কাজেই ভাড়ায় প্রাইভেট কারই ভরসা। যত দূর যেতে পারবেন, সেখানেই নেমে যাব—এ শর্তে রাজি হলেন ইব্রাহিম আলী। ইব্রাহিমের গাড়ি ছেড়ে সাতক্ষীরায় পৌঁছার উপায় খুঁজছি যখন, তখনই ঢাকা থেকে এক বন্ধুর ফোন পাই। সে জানতে চাইল, দলে দলে মানুষ নাকি দেশ ছেড়ে যাচ্ছে? বন্ধুকে আশ্বস্ত করি, এমন কিছু ঘটেনি। বন্ধুর ফোন আমাকে মনে করিয়ে দেয় এলেন গিন্সবার্গের কবিতা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। ১৬ ডিসেম্বর কোনোরকমে সাতক্ষীরা শহরে পৌঁছলেও শহরের বাইরে যাওয়ার কোনো উপায় করা গেল না। সহকর্মী কল্যাণ ব্যানার্জি বললেন, ‘যেসব গ্রামে আপনি যেতে চান, সেগুলো সাংবাদিকদের জন্য পুরোই অনিরাপদ এখন। তা ছাড়া যে লোকদের সঙ্গে কথা বলতে চান, তাঁদের গ্রামে পাওয়া যাবে না। অপেক্ষা করেন, সন্ধ্যায় বের হব। সাতক্ষীরা শহরেই আছে গ্রাম থেকে বিতাড়িত অনেক মানুষ।
আপাতত আমরা যৌথ বাহিনীর অভিযানের খবর সংগ্রহ করি।’ পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের উদ্দেশে বেরিয়ে জানতে পারি, ১৬ ডিসেম্বর সরকারি আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া আর কোনো আয়োজন হয়নি। এ পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য সাংবাদিকেরা স্পষ্টতই জামায়াতে ইসলামীকে দায়ী করলেন। তাঁদের মতে, ক্ষেত্রবিশেষে বিএনপিও যুক্ত হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের তাণ্ডবে। সাংবাদিক মোস্তাফিজুর রহমান বললেন, গত ২৮ ফেব্রুয়ারির পর থেকে এক দিনের জন্যও মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে গ্রামের বাড়ি কুলিয়ায় যেতে পারেননি তিনি। গেলে কী হবে—এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, হয়তো কিছুই হবে না। তবে ১৮-দলীয় জোটের অবরোধ-হরতালে একজন সাংবাদিককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। হামলার শিকার হয়েছেন ১২ জন সাংবাদিক ও দুজন সংবাদপত্রসেবী। সাংবাদিকদের ওপর একের পর এক হামলার ঘটনায় উৎকণ্ঠিত হয়ে প্রেসক্লাবের পক্ষ থেকে জেলার সাংবাদিকদের সবাইকে সাবধানে চলতে, বিশেষ করে রাতে একা না চলার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে। প্রেসক্লাব থেকে বেরিয়ে শহরেই কথা হলো গ্রাম থেকে পালিয়ে আসা একজন পল্লিচিকিৎসকের সঙ্গে। বহু বছর ধরে দল-মত-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে এলাকার মানুষকে সেবা করে আসছেন যে মানুষটি, তাঁর বিশ্বাস ছিল, আর যা-ই হোক, আক্রান্ত হবেন না তিনি। তাঁর বিশ্বাস ভঙ্গ হলো ১২ ডিসেম্বর রাতে।
জামায়াতের নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের খবর প্রচার হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর দিবাগত রাত দেড়টায় হামলা হলো তাঁর বাড়িতে। তিনি শারীরিক নির্যাতনের শিকার হলেন। বাড়িঘরে ভাঙচুর ও আগুন দেওয়া হলো। পরিবার-পরিজন নিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে এলেন সাতক্ষীরা শহরে। সেই থেকে শহরেই আছেন। বিজয় দিবসের ওই রাত আমার কেটেছে ঘোরে। পরের দুই দিন সাতক্ষীরার দেবহাটা ও কালীগঞ্জ উপজেলায় যাওয়ার চেষ্টা করে অবরোধের কারণে ব্যর্থ হই। পরে দেবহাটায় যাওয়ার উপায় বাতলে দিলেন মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ ঘোষ। কিন্তু নিজে গেলেন না। তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে চাইলে শহরের একটি আবাসিক হোটেলে দেখা করতে বলেন। ওই হোটেলের অভ্যর্থনাকক্ষে দীর্ঘ আলাপচারিতায় বারবার আক্ষেপ করে বলছিলেন, ‘একাত্তরে যুদ্ধের ময়দানে মরে গেলাম না কেন? তাহলে শহীদের মর্যাদা পেতাম।’ দেবহাটা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক সভাপতি সুভাষ ঘোষ। একসময় আওয়ামী লীগ করতেন। দলের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন বলে জানান। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সঙ্গেও আগের মতো নিবিড়ভাবে যুক্ত নন তিনি। মাছের ঘেরে মাছ চাষ এবং গাজীরহাটের মাছের আড়ত নিয়ে ব্যস্ত দিন কাটছিল তাঁর। আড়ত বন্ধ। ঘেরে মাছ আছে, কিন্তু ধরতে পারছেন না। উড়ো খবর, তাঁদের ঘের লুট করা হবে। অবস্থাপন্ন পরিবারের সন্তান সুভাষ।
ব্যবসা-বাণিজ্য করে আয়-উন্নতি কিছুটা বাড়িয়েছেন। ১৯৯১ সালে পুরোনো বাড়ি ভেঙে তৈরি করেছেন সুরম্য একটি দোতলা বাড়ি। ওই বাড়িতে তাঁরা পাঁচ ভাই পরিবারের ২১ জন সদস্যকে নিয়ে বাস করতেন। কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পরের দিন ১৩ ডিসেম্বর সকালে চোখের সামনে বাড়িটি পুড়ে যেতে দেখলেন সুভাষ। গানপাউডার ছড়িয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় হামলাকারীরা। বাড়ি ছেড়ে আসার সময় পরিধানের বস্ত্রটি ছাড়া তাঁদের আর কিছুই ছিল না। সুভাষ ঘোষ বলেন, ‘কবে যে গ্রামে যেতে পারব, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। আদৌ যাব কি না, তা-ও জানি না। যে বাড়ি থেকে পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে এসেছি, সেই বাড়িতে যাই কী করে?’ সুভাষ আরও বলেন, জামায়াত-বিএনপি এটা করতেই পারে। কিন্তু এই পরিস্থিতির জন্য দায় নিতে হবে সরকারি দলের মন্ত্রী, সাংসদ ও নেতাদের। তাঁর বক্তব্য স্পষ্ট, হিন্দুরা দেশে থাকলে আওয়ামী লীগের জন্য ভোট। আর দেশ ছেড়ে গেলে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত—সবার জন্যই জমি। তাঁদের গ্রামের তিনটি পরিবার এরই মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে গেছে—এ তথ্য জানিয়ে সুভাষ বলেন, ‘জানি না, আমার নিয়তি কী হবে? যুদ্ধ করে যে দেশটা স্বাধীন করেছিলাম, সেই দেশ ছেড়ে পালাতে হবে?’ একটু অবস্থাপন্ন হিন্দুরা হয়তো পালিয়ে অন্য কোথাও গিয়ে আবাস গড়তে পারবে, কিন্তু নির্বাচনের দিন সহিংসতার শিকার হওয়া যশোরের অভয়নগরের চাঁপাতলার মালোপাড়ার নিম্নবর্গীয় মানুষগুলো কোথায় যাবে? ফলে, নিত্য অপমান, নিরাপত্তাহীনতা আর অধিকারহীনতার মধ্যে টিকে থাকার কায়দা রপ্ত করে নিতে হবে তাদের।
রাজীব নূর: সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.