সোনাদিয়ায় আসার জন্য ধন্যবাদ by লরেন্স লিফশুল্ৎজ

আমাদের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারও মুখোমুখি হওয়ার মতো ব্যাপারগুলো প্রায়ই অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে যায়। কোনো একটি ঘরের অন্য পাশে কাউকে আমরা দেখি এবং তার সঙ্গে কথায় মগ্ন হয়ে পড়ি।
মেয়েটি খুব সুন্দর করে হাসে। তার চোখ আপনার দিকে তাকিয়ে এমন কিছু দেখে, যা অন্যরা পারে না। সে একসময় একজন মোহনীয় মানুষে পরিণত হয়।

তার কথা আপনি এমনভাবে শুনতে পান, যেভাবে শুনতে অন্যরা ব্যর্থ হয়। বন্ধুত্ব থেকে ব্যাপারটি রূপ নেয় একটি বিশেষ সম্পর্কে। আর যদি তা স্থায়ী হয়, কখনো কখনো সম্পর্কটি আজীবনের অঙ্গীকার ও বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়।
মানবীয় সম্পর্কের মতো একটি স্থান বা দেশের ক্ষেত্রেও আমাদের এ রকম সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে। কোনো কোনো দেশ এমনভাবে আমাদের মনে জায়গা করে নিতে পারে, যা হয়তো আমরা কখনো অনুমানই করিনি। একটি অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক—যাকে আমরা একপর্যায়ে ভালোবাসতে শুরু করি—হয়ে উঠতে পারে টানাপোড়েনে ভরা, জটিল ও খুব কঠিন। আর সে সম্পর্ক অত্যন্ত যন্ত্রণাদায়ক নিজস্ব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়।
আমি যখন প্রথমবার পূর্ব পাকিস্তান সফর করি, তখন দেশটা আমার কাছে ছিল অজানা। কিন্তু আমি জানতাম না, সেই বাংলাদেশ পরবর্তী সময়ে আমার জন্য ওই রকম একটা বিশেষ স্থানে পরিণত হবে। সে হবে আমার শিক্ষক। আমাকে শেখাতে তা অক্লান্ত থাকবে। সেই শিক্ষাগুলো প্রায়ই ছিল বেদনাদায়ক। কখনো কখনো সেসব ছিল বেদনা অসহনীয়—যখন পরিচিত মানুষজন ও বন্ধুরা নিহত বা নির্যাতিত হয়েছিলেন।
এসব কিছুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আমার বন্ধুও হয়ে গিয়েছিল। সে আমাকে জীবনে দেখা সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য একদল মানুষের কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। তাঁদের কেউ কেউ বেদনাদায়ক মৃত্যুবরণ করেছেন, কয়েকজন বছরের পর বছর ধরে কারাবন্দী ছিলেন। আবার কয়েকজন বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) কর্মরত অবস্থায় নীরবে নাম-পরিচয় গোপন রেখে অন্যদের সাহায্য করে গেছেন।

বেশ কয়েকজন ছিলেন সাংবাদিক, যাঁরা সততা অটুট রাখতে নিজেদের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েছিলেন। কয়েকজন ছিলেন সামরিক কর্মকর্তা বা সরকারি চাকরিজীবী, যাঁদের সহায়তায় আমি এমন অনেক ব্যাপার জানতে পারি, যা আগে জানতাম না কিন্তু অনুভব করতাম যে সেগুলো ‘মানুষের জানার অধিকার রয়েছে’।

আমি শিখেছি সরকার যখন দুর্যোগ মোকাবিলায় আগে থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়, তখন কীভাবে একটি দুর্ভিক্ষে জনগণের অনাবশ্যক মৃত্যু ঘটে। আমি দেখেছি মানুষ এমন একটি সমাজের জন্য লড়াই করছে, যা কি না তাদের জন্ম নেওয়া সমাজের তুলনায় অধিক ন্যায়পরায়ণ। তবু, সেই প্রচেষ্টায় তাদের কারাবন্দিত্ব ও মৃত্যুর মতো চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

আমি দেখেছি মানুষ কীভাবে নিজের বিগত বছরের সহযোদ্ধাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং তাদের হত্যা করে। বাংলাদেশে সংঘটিত নির্মমতার বর্ণনা দিতে গিয়ে হয়তো শেক্সিপয়ারও—যিনি আমাদের হ্যামলেট ও ম্যাকবেথ উপহার দিয়েছেন—সমস্যায় পড়ে যেতেন। আমি আরও শিখেছি যে স্বৈরতন্ত্র কতটা জঘন্য সেটি কোনো ব্যাপারই থাকে না, সব প্রতিরোধ উপেক্ষা করে তা শিকড় ছড়িয়ে নেয় এবং অবশেষে দুর্নীতি ও নৃশংসতার আশ্রয় নিয়েও পার পেয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রায় সব সময়ই যা দরকার হয়, তা হলো বড় ধরনের আত্মত্যাগ। বাংলাদেশের কাছ থেকে কঠিন ও যন্ত্রণাদায়ক শিক্ষাগ্রহণের প্রক্রিয়া আমার জন্য কখনো বন্ধ হয়নি। আর সেই সব শিক্ষা আমি এখনো ভুলিনি।

তবু, বিগত বছরগুলোর দিকে যখন ফিরে তাকাই, আমার মনে হয়, প্রথমবার পূর্ব পাকিস্তানের মুখোমুখি হওয়ার ঘটনাটি ছিল অপেক্ষাকৃত নিষ্কলুষ একটি সময়ের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হওয়ার মতো ব্যাপার।

১৯৭০ সালের জুলাইয়ের শেষ দিকে আমি সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করি। তখন আমার বয়স ছিল ২০ বছর। পিঠে একটি ব্যাগ, পায়ে মজবুত একজোড়া চপ্পল আর মনে ছিল অজানার জন্য কৌতূহল। আমি যশোরের পথ ধরলাম। রাত কাটালাম সেখানেই। শিগগিরই জেনে গেলাম, আমি হাজার নদীর দেশে পৌঁছে গেছি। পরের দিন ফেরি ও বাসে চড়ে পৌঁছলাম ঢাকায়। শহরটিতে সেদিনই আমি প্রথমবারের মতো পা রাখি। পুরানো ঢাকার একটি সাশ্রয়ী হোটেলে ঠাঁই নিই এবং আশপাশে ঘোরাঘুরি শুরু করি।

কেউ যদি তখন আমার সামনে বসে বলত, ‘এই জায়গাটা তোমাকে দখল করে নেবে। তোমাকে যেতে দেবে না। প্রতিবার যখন তুমি এখান থেকে চলে যাবে, কিছু একটা তোমাকে আবার ফিরিয়ে আনবে।’ আমি তার জবাবে বলতাম, ‘আমি মোটেই তা মনে করি না।’ কিন্তু, সেই সময় আমি দেশটাকে আসলে ঠিকমতো দেখিনি অথবা দেশটির স্বতন্ত্র চরিত্র বুঝতে পারিনি। সে তখনো আমার সঙ্গে কথা বলেনি। আমি কেবল একনজরে তাকে দেখেছিলাম।

ওই গ্রীষ্মে আমার মনোযোগ ছিল নতুন গন্তব্যের দিকে, ভিয়েতনাম। আমি কেবল সময়টা অতিক্রম করছিলাম। যা-ই হোক, আমি তাড়াহুড়ো করিনি। পূর্ব পাকিস্তানে আমি তিন সপ্তাহ থাকলাম। কিন্তু চট্টগ্রাম থেকে রেঙ্গুনের উদ্দেশে উড়োজাহাজে চড়ার আগে অনুভব করলাম, একদিন আমি এখানে ফিরে আসব। সেই প্রত্যাবর্তন কোন পথে বা কীভাবে হবে, আমি তখনো জানতাম না।

দুই সপ্তাহ আগে ঢাকায়, নিউমার্কেটে, আমার সামনে একটি সুযোগ আসে। এটি আমাকে একটি মোটরসাইকেলের পেছনে চড়িয়ে একটি বাড়িতে নিয়ে যায়, যেখানে আমি আগে কখনো যাইনি। যানটি থেকে নামার কিছুক্ষণ পরই আমি পরিচিত হই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। তিনি নিজের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের স্বাগত জানান। স্পষ্টত, আমার মোটরসাইকেলওয়ালা বন্ধুটি মুজিবের পরিচিত ছিলেন।

বিহারের গ্রামাঞ্চলে আগের বছর আমি কী কাজকর্ম করেছি সে সম্পর্কে তিনি সংক্ষেপে শেখ মুজিবকে জানালেন। আমাকে মোটরসাইকেলে করে নিয়ে যাওয়ার সময়ই বন্ধুটি বলেছিলেন, ‘আমি শেখ মুজিবকে বলেছি যে তুমি বেশ চিত্তাকর্ষক একজন লোক। তোমার সঙ্গে তাঁর আলাপ করা উচিত। আমি বলেছি, তুমি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলে। এখন পৃথিবী ঘুরে বেড়াচ্ছ।’

পরবর্তী দুই ঘণ্টা আমি ও শেখ মুজিব কথা বললাম। প্রথমে তাঁর উপরতলায় পড়ার ঘরে, পরে তিনি আমাকে মধ্যাহ্নভোজের প্রস্তাব করলেন। আমরা কোনো বাধা ছাড়াই কথা বলেছিলাম। সেখানে আর কোনো দর্শনার্থীও ছিল না।

আওয়ামী লীগের কর্মসূচি সম্পর্কে আমি তাঁর কাছে জিজ্ঞেস করলাম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কখনো অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের সুযোগ দেবে কি না, সে ব্যাপারেও তাঁর মতামত জানতে চাইলাম। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন জয়প্রকাশ নারায়ণ ও গান্ধীর অনুসারীদের কথা, যাঁদের সঙ্গে বিহারে আমি কাজ করেছিলাম। মুজিব আগ্রহী ছিলেন গ্রামোন্নয়ন কর্মসূচিগুলো সম্পর্কে, যেগুলো তখন পরিচালনা করছিল ‘সর্বদয়া আন্দোলন’। আমি তাঁদের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। ওই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণের সহযোগীরা ভারতের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলোর কয়েকটির উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করছিলেন।

মুজিব সেদিন বেশ ভারমুক্ত ছিলেন। অনেক প্রশ্নের অবতারণ ও উত্তরের মধ্য দিয়ে বিকেলটি শান্তভাবে কেটে গিয়েছিল। সেই দিনগুলোতে ঢাকা ছিল একটি শান্ত ও ধীরগতির শহর। বিভিন্ন বিষয়ে চিন্তাশীল আলোচনার জন্য মানুষের কাছে তখনো সময় ছিল। বাস্তবিক ‘বাঙালি আড্ডা’ তখনো তার সেরা সময়ে অবস্থান করছিল। (শেখ মুজিবু রহমানের সঙ্গে আলোচনার বিশদ বিবরণ দেখুন: ‘ইন কনভারসেশন উইথ লরেন্স লিফশুলৎজ’, দ্য ডেইলি স্টার, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১১)।

সেই সময়, জুলাই ১৯৭০-এ, আমার সুদূর কল্পনাতেও ছিল না যে চার বছর পর আমি ঢাকায় বসবাস করব; এ শহরটা হয়ে যাবে একটি রাজধানী—পূর্ব পাকিস্তানের নয়, বরং একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশের। আসলে, ১৯৭৪ সালের গ্রীষ্মে আমি ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর আবাসিক প্রতিনিধি হিসেবে পার করে দিয়েছিলাম প্রায় একটি বছর। এটা ছিল নয়াদিল্লিতে গিয়ে রিভিউর দক্ষিণ এশিয়া প্রতিনিধির দায়িত্ব নেওয়ার পথে এগিয়ে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া।

সে সময় আমি অন্যান্য ‘অনাকাঙ্ক্ষিত’ কাহিনির মধ্যে রংপুরের দুর্ভিক্ষ এবং একটি প্রজন্মের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যার প্রভাব নিয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন করে পরিচিতি অর্জন করি। বেশ কয়েকবার রিভিউ নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৭৪ সালের আগস্টে ‘অজুহাতের বন্যা’ (‘আ ফ্লাড অব এক্সকিউজেস’) শীর্ষক প্রচ্ছদ রচনা নিয়ে একটি সংখ্যা প্রকাশিত হলে সেটিও নিষিদ্ধ করা হয়। সেই সপ্তাহে আমি তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের একটি সংবাদ সম্মেলনে যোগ দিই। আমরা হাত মেলাই। তিনি বলেন, ‘আমি জানি এ সপ্তাহে রিভিউ নিষিদ্ধ হয়েছে। এই সিদ্ধান্তে আমার সম্মতি ছিল না। আমি আপনাকে জানাতে চাই, আপনি একটি ভালো নিবন্ধ লিখেছেন। এটা সমালোচনামূলক হলেও সৎ। অনুগ্রহ করে একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে আসুন।’

আমি তাঁর মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ইঙ্গিত দিলাম, বাংলাদেশে ফিরে অবশ্যই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাব। আমার নয়াদিল্লি যাওয়ার দেরি ছিল না।

এক বছর বাদে, সেই মৃদু গ্রীষ্মের দিনে মুজিবের সঙ্গে তাঁর পড়ার ঘরে শান্ত আলাপচারিতার পাঁচ বছর পর, আমাকে আবার ঢাকায় ফেরার নির্দেশ দেওয়া হয়। আমি মুজিব হত্যাকাণ্ডের ওপর প্রতিবেদন করার দায়িত্ব পাই সেই বাড়িটিতে গিয়ে, যেখানে পাঁচ বছর আগে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেটি ছিল আরেকটি অজানা অভিযাত্রার শুরু, যা আমি এখনো শেষ করিনি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাজউদ্দীনের সঙ্গে আমার আর কখনো দেখা হয়নি, যেমনটা তাঁকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। মুজিবের মৃত্যুর পর আমি ঢাকায় ফিরেছিলাম, কিন্তু তাজউদ্দীন তখন কারাবন্দী। তাঁর পরিণতি নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা একই রকম সতর্কভাবে পরিকল্পনা করছিল, যেমনটা তাঁরা মুজিবকে নিয়ে করেছে। পরবর্তী সময়ে আমি যখন ঢাকা যাই, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের সুরক্ষিত প্রকোষ্ঠে তাজউদ্দীনকে তত দিনে নির্মমভাবে খুন করা হয়েছে।

আমি নানা জায়গায় গিয়েছি এবং বিভিন্ন বিষয়ে অনেক বই লিখেছি। হিরোশিমার পর আমি বসনিয়া নিয়ে বই লিখেছি; লিখেছি আরও বহু কিছু নিয়ে। তবু বাংলাদেশের ইতিহাসের সেই সংকটময় দিনগুলোর বিবরণ আমি এখনো মন থেকে মুছে ফেলতে পারিনি। লোকজন নতুন নতুন তথ্য নিয়ে আমার দরজায় হাজির হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনা নিয়ে এমন বহু জটিল প্রশ্ন রয়ে গেছে, যেগুলোর উত্তর এখনো দেওয়া হয়নি। ধাঁধার সমাধানের কাজ এখনো বাকি রয়েছে।

অনেক প্রশ্নের জবাব আমরা বিগত বছরগুলোতে দিয়েছি, কিন্তু সবগুলোর নয়। সেই পুরোনো গল্পই লোকে বলে। তবু, যেমন মার্কিন ঔপন্যাসিক উইলিয়াম ফকনার একবার লিখেছিলেন, অতীত কখনো মরে না, এমনকি তা অতীতও হয় না।

বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির অনেক রেখাচিত্রই তৈরি হয়েছে ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৭৬ ও ১৯৭৭ সালের নানা ঘটনার আলোকে। শাহবাগ ও হেফাজতের উৎসমুখগুলোও কি সেই সময়ের ঘটনাবলির মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায় না?

১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় এবং ১৯৭১ সালের সামরিক অভিযানে আগে সেই ‘নিষ্কলুষ গ্রীষ্মে’ পূর্ব পাকিস্তান নিয়ে আমার সর্বশেষ যে স্মৃতিটি রয়েছে, তা কক্সবাজারে একটি ভ্রমণের।

সাগর থেকে উঠে এসে সৈকতে বসে আমি একটি চিঠি লিখছি। মনে পড়ে, দিনটি ছিল সুন্দর। মৃদু বাতাস, স্বচ্ছ আকাশ আর শান্ত জলরাশি আমাকে দিগন্তের দিকে হাতছানি দিচ্ছে।

প্রায় ১২ বছর বয়সী এক কিশোর আমার কাছে এসে বসে ইংরেজি, উর্দু ও বাংলার মিশ্রণে আমার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করল। আমি বাংলা বলতে পারতাম না, কিন্তু আমার হিন্দি ছিল অনর্গল। সে আমাকে বোঝাতে পারল যে, সোনাদিয়া নামে একটি সুন্দর দ্বীপ আছে। আর উপকূল থেকে সেটি বেশি দূরে নয়।

ভাঙা ভাঙা ভাষাতেই আমাদের আলাপ চলছিল। সে আমাকে বলল, তার পরিবার বছরের ওই সময়টায় সেখানেই থাকে। জায়গাটি খুব সুন্দর। আমার সেটা দেখা উচিত। কাছাকাছি কয়েকটি মাছ ধরার নৌকা দেখিয়ে ছেলেটি বলল, আমরা এগুলোর কোনো একটিতে চড়ে সোনাদিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করতে পারি।

ওর সুন্দর প্রস্তাবে আমি সায় দিলাম। সৈকতের পাশেই কয়েক মিনিটের দূরত্বে একটি কেবিনে আমি অবস্থান করছিলাম। যত দূর মনে পড়ে, আশেপাশে মাইলের পর মাইল এলাকার মধ্যে আমিই ছিলাম একমাত্র বিদেশি পর্যটক। সম্ভবত কয়েক শ মাইলের মধ্যে আমার মতো আর কেউ ছিল না। আমি আমার ক্যামেরা ও কিছু জিনিসপত্র সঙ্গে নিলাম। কেবিনটি তালাবদ্ধ করে আমার কিশোর বন্ধুর সঙ্গে হেঁটে সেই মাছ ধরার নৌকাগুলোর একটিতে চড়লাম।

তীরে যারা মাছ নামিয়ে রাখছিল, ছেলেটি নিশ্চয়ই তাদের কাছে চেনা ছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা নৌকায় সোনাদিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করলাম। কতক্ষণ লেগেছিল, সেটি মনে নেই। নৌযাত্রার অভ্যাস আমার ছিল। মনে পড়ে, প্রাচীন নকশায় তৈরি ছোট সেই নৌকাটিতে চড়ে সাগরের মধ্যে গিয়ে নিখাদ আনন্দ হচ্ছিল। নৌকাটি চলছিল সুন্দরভাবে।

আমরা যখন সোনাদিয়ায় পৌঁছালাম, ছেলেটি আমাকে নিয়ে গেল দ্বীপের একটা অংশে। সেখানে গ্রামের মতো একটি জনপদ। গ্রামের চেয়ে আসলে সেটি কোনো ক্যাম্পের মতো দেখতে ছিল বেশি। সারিবদ্ধভাবে রাখা অনেক জাল। সেগুলো ঠিকঠাক করা হচ্ছিল। সেখানে ছিল প্রায় ১০০ জন মানুষ। আমরা পানির কাছাকাছি ছিলাম। নৌকাগুলোর লোকজন সেখানে কাজ করছিল। ছেলেটি আমাকে তার পরিবারের সদস্যদের কাছে রেখে গেল। পরদিন পর্যন্ত তাকে আর দেখা গেল না। আমি রাত কাটালাম জেলেদের সঙ্গে।

তাদের অনেকেই আমার হিন্দির সঙ্গে যোগাযোগের উপযোগী বেশ ভালো উর্দু জানত। তারা আমাকে ভালো খাওয়াল। নিজেকে আমি একজন সম্মানিত অতিথি বলে অনুভব করলাম। সবচেয়ে অসাধারণ লেগেছিল ওই জনবসতির রাতের দৃশ্যটি, যখন জাল ও চালাঘরের চারপাশে তেল ও কেরোসিনের বাতি জ্বলে উঠেছে। মনে হলো, আমি এমন একটা জায়গায় রয়েছি, এক হাজার বছর আগেও যা দেখতে একই রকম ছিল। গোটা বসতিজুড়ে জ্বলছিল মিটমিট করে কমলা রঙের আলো। ছায়াগুলো নড়াচড়া করছিল খুব সতর্কভাবে।

আমার সেই কিশোর পথপ্রদর্শক হাজির হলো পরের দিন। জিজ্ঞেস করল, আমি কক্সবাজারে ফিরে যেতে চাই কি না। আমি সেই দ্বীপে তার পরিবারকে আমার সালাম জানালাম। সে দ্রুত একটা নৌকার ব্যবস্থা করল, যেটা আমাদের তীরে নিয়ে যাবে।

আবার সৈকতে দাঁড়িয়ে আমি তাকে ধন্যবাদ দিলাম। ভাবলাম, ওই সুন্দর দ্বীপে—যার বর্ণনা দিতে সে তিনটি ভাষা থেকে শব্দ চয়ন করেছিল—এই চমৎকার ভ্রমণের ব্যবস্থা জন্য তাকে কিছু টাকাপয়সা দেওয়া উচিত। সে আমার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল। ‘টাকার দরকার নেই,’ সে বলল। তার পর নিজের বুকে হাত রেখে বলল, ‘সাহেব, সোনাদিয়ায় আসার জন্য ধন্যবাদ।’

আমি কেন বাংলাদেশে ফিরে যাব? তার কারণ অনেক। তবে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণটি হচ্ছে, আবার সোনাদিয়া দেখার ইচ্ছা। হ্যাঁ, একদিন আমি নিশ্চয়ই সেখানে যাব।

ইংরেজি থেকে অনূদিত

No comments

Powered by Blogger.