সালিসের পর খুন হন খায়রুল by কমল জোহা খান ও আব্দুল্লাহিল ওয়ারিশ

যুবলীগের নেতা তৈয়ব আলীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব নিরসনে সালিস বৈঠকে বসেও প্রাণে রক্ষা পাননি আওয়ামী লীগের নেতা ও পরিবহন ব্যবসায়ী খায়রুল আলম মোল্লা।
সালিস থেকে বের হওয়ার পরপরই তাঁকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে মতিঝিলের সমবায় ব্যাংক ভবনের তিনতলায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদের কার্যালয়ে ওই সালিস বসে। সেখান থেকে বের হয়ে ভবনের দোতলায় আসার পর দুর্বৃত্তদের ছুরিকাঘাতে খুন হন খায়রুল। ঘটনার পর থেকে তৈয়ব আলী পলাতক রয়েছেন।

খায়রুল আলমের ব্যক্তিগত গাড়ির চালক মো. আবুল কালাম প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, রুট কমিটি গঠন, আন্তজেলা টোল ও সিটি কমিশনসহ কয়েকটি বিষয় নিয়ে ৭৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সাবেক নেতা তৈয়ব আলীর সঙ্গে খায়রুল আলমের দ্বন্দ্ব ছিল। এসব দ্বন্দ্ব নিরসনে বিকেলে সমবায় ব্যাংকের অফিসে একটি সালিস বসে। সালিসে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও যুবলীগের নেতা মহিউদ্দিন আহমেদের অফিস কক্ষের বৈঠকে তৈয়বও উপস্থিত ছিলেন। বিকেল পাঁচটার দিকে সালিস শুরু হয়।

গাড়িচালক আবুল কালাম বলেন, বিকেল পৌনে পাঁচটার দিকে তিন যুবকসহ তৈয়বকে সমবায় ব্যাংক ভবনে তিনি ঢুকতে দেখেন। তিনি বলেন, তিনি তৈয়বকে দীর্ঘদিন ধরে চেনেন।

আবুল কালাম বলেন, তৈয়বকে দেখে তিনি তাঁকে সালাম দেন। কিন্তু সালামের উত্তর না দিয়ে ওই তিন যুবককে নিয়ে তৈয়ব ভবনের ভেতর চলে যান। তিনি বলেন, ‘১২ বছর ধরে খায়রুল স্যারের গাড়ি চালাই। সায়েদাবাদ টার্মিনালের প্রায় সবাইকেই চিনি। তবে তিন যুবককে আগে কখনো সায়েদাবাদ এলাকায় দেখিনি।’

আবুল কালাম বলেন, ‘আমাকে সাড়ে পাঁচটার দিকে খায়রুল স্যার ফোন করে গাড়িটি মধুমিতা হলের পেছনে খোকনের গ্যারেজে রাখতে বলেন। এর ১০ মিনিট পর বস আবার ফোন করেন। কিন্তু তাঁর কোনো কথা শুনতে পাইনি। আমি বিষয়টি ম্যাডামকে (খায়রুল আলমের স্ত্রী) জানাই। পরে ম্যাডাম আমাকে ঢাকা মেডিকেলে যেতে বলেন।’

সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘যতটা জানি, রুট কমিটি থেকে চার-পাঁচ মাস আগে তৈয়বকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সেই দ্বন্দ্ব মেটাতে আমার অফিসে খায়রুল ও শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা বাবুল আসার পর  তৈয়ব এসেছিলেন।’

মহিউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, ‘খায়রুলের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে রাজনীতি করি। তাই আমাকে সাক্ষী রেখে তাঁরা কথা বলছিলেন। তৈয়বকে রুট কমিটিতে ফেরানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। সিদ্ধান্ত তাঁরাই নিয়েছিল। কারণ, আমি তো পরিবহন ব্যবসায়ী নই।’

খুব ঘনিষ্ঠজনদের সহায়তা এবং পরিকল্পনায় খায়রুল আলম খুন হন বলে মনে করছে পুলিশ ও তাঁর পরিবার। এর পেছনে ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের বিষয় থাকতে পারে। এমন ধারণা নিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে এ ক্ষেত্রে ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের পরপরই ঘটনাস্থল থেকে গুরুত্বপূর্ণ আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। গতকাল রাতে এবং আজ বেশ কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে বলে পুলিশ সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে তদন্তের স্বার্থে এই মুহূর্তে তাঁদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। সন্ধ্যায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত পরিবারের পক্ষ থেকে ঘটনায় কোনো মামলা করা হয়নি। কেবল পুলিশ নয়, র্যাব, সিআইডি ও ডিবি এই ঘটনার তদন্ত করছে।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) সহকারী কমিশনার জুয়েল রানা জানিয়েছেন, ব্যবসায়িক ও রাজনৈতিক আধিপত্য এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের বিষয় মাথায় রেখে এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের প্রায় ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা করেনি খায়রুল আলমের পরিবার। মতিঝিল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বি এম ফরমান আলী প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, পরিবারের সদস্যদের মামলা করার কথা রয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত (সন্ধ্যা সাতটা) কোনো মামলা হয়নি।

সায়েদাবাদ আন্তজেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘খায়রুল আলমের কারও সঙ্গে রাজনৈতিক শত্রুতা বা দ্বন্দ্বের প্রশ্নই আসে না। উনি তো আর সংসদ নির্বাচন করতেন না যে তাঁর কারও সঙ্গে দ্বন্দ্ব থাকবে।’ তিনি আরও বলেন, খায়রুল আলম সব সময় সোজাসাপটা কথা বলতেন। সত্য কথা বলতেন। কাউকে ভয় করতেন না। যারা তাঁর কাছ থেকে সুবিধা করতে পারেনি তারাই এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে।

আবুল কালাম আরও জানান, গতকাল খায়রুল আলমের সঙ্গে থাকা তৈয়ব আলীকে পাঁচ-ছয় মাস আগে সংগঠনবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ নির্দিষ্ট করে জানাতে পারেননি তিনি।

সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল ঘুরে জানা যায়, তিশা এক্সক্লুসিভ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন নিহত খায়রুল আলম মোল্লা। ঢাকা লাকসাম রুটে বাসগুলো চলাচল করত। তিনি সায়েদাবাদ আন্তজেলা বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। ধোলাইপাড় এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা হওয়ার কারণে সায়েদাবাদ এলাকায় বেশ প্রভাব ছিল খায়রুল আলম ও তাঁর পরিবারের।

দুপুরে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে কথা হয় খায়রুল আলমের ব্যবসায়িক অংশীদার ও তিশা ভিআইপি পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকতার হোসেন প্রথম আলো ডটকমকে বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের কিছুক্ষণ আগে বিকেল পাঁচটা ৩১ মিনিটে খায়রুলের সঙ্গে আমার মুঠোফোনে কথা হয়। তখন তিনি মতিঝিলে সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিনের কক্ষে ছিলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে আমার দুবাই থেকে বাসের যন্ত্রাংশ আনার ব্যাপারে কথা হয়। পরে তাঁর মৃত্যুর খবর শুনতে পাই।’

একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, খায়রুলকে যেভাবে ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তাতে মনে হয় কোনো পেশাদার খুনি এ কাজ করতে পারেন।

খায়রুল আলমের ভাগনে মো. রাজীব জানান, খায়রুল আলমের মেয়ে বন্ধনের আজ রাতে অস্ট্রেলিয়া থেকে দেশের ফেরার কথা রয়েছে। এরপর লাশ দাফনের সময় নির্ধারণ করা হবে এবং মামলার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

No comments

Powered by Blogger.