ব্যাংক জালিয়াতি- অর্থমন্ত্রী, সবগুলোই আপনার বিষয় by শওকত হোসেন

একটি সহযোগী দৈনিকে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের একটি সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে। ৩ নভেম্বর প্রকাশিত সেই সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রীকে সাম্প্রতিক কেলেঙ্কারি নিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল।
একটি প্রশ্ন হুবহু এ রকম, ‘বিসমিল্লাহ গ্রুপও তো ব্যাংক থেকে জালিয়াতি করে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে’। অর্থমন্ত্রীর উত্তরটা শুনুন, ‘তারা বেসরকারি ব্যাংক থেকে নিয়েছে। ওটা আমার বিষয় নয়।’
সাক্ষাৎকারটি পড়ার পর একবার মনে হয়েছিল ঠিক পড়লাম তো? যতই অবিশ্বাস্য লাগুক না কেন, কথাটা অর্থমন্ত্রীরই। এর অর্থ অর্থমন্ত্রী কেবল সরকারি ব্যাংকের দায়িত্বে, বেসরকারি ব্যাংক তাঁর বিষয় নয়।

বেসরকারি ব্যাংক যদি অর্থমন্ত্রীর বিষয় না হয়, তাহলে তাঁর বিষয় কেবল সরকারি বা রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক। যদি তা-ই হয়ে থাকে তাহলে তো সমস্যা আরও প্রকট। কারণ, এখন অর্থনীতির সবচেয়ে বড় ব্যর্থতার নাম রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক। এই ব্যাংকগুলো দেউলিয়া হওয়ার পথে। বিশ্বব্যাংক গত অক্টোবরে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে পরিষ্কার লেখা আছে, ‘সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশে ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি, বিশেষ করে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি খারাপ হয়েছে ২০০৯ সালের পর থেকে।’ এর অর্থ হচ্ছে খারাপ হয়েছে এই সরকারের আমলেই। খুব সুনির্দিষ্ট করে বললে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সময়ে। দেশের সরকারি ব্যাংকগুলোর পরিস্থিতি এতটা খারাপ আর কখন ছিল তা জানতে যেতে হবে সেই এরশাদের আমলে। তারপর এই ব্যাংকগুলো নিয়ে নানা ধরনের সংস্কার হয়েছে, অনেক প্রকল্প হয়েছে, অনেক অর্থ খরচ হয়েছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এই ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়ার পর্যায়ে নিয়ে গেছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর কথা মানলে এই ব্যাংকগুলো তাঁরই বিষয়। সুতরাং দায়দায়িত্বও তাঁর।
রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলোকে চলার জন্য এখন বাজেটের মাধ্যমে নতুন করে পাঁচ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হচ্ছে। চরম মূলধন ঘাটতির কারণে জনগণের করের টাকায় এই অর্থ দিতে হবে। তবে বিশ্বব্যাংক বলছে, ব্যাংকগুলোর মূলধন ঘাটতি আসলে আরও অনেক বেশি, ২২০ কোটি ডলার। টাকার অঙ্কে ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। নিজের ‘বিষয়’ বানিয়ে সরকারি ব্যাংকগুলোর এই হাল করেছেন অর্থমন্ত্রী।
অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সময়েই সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনাটি ঘটে। সোনালী ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন এক হাজার ১২৫ কোটি টাকা। আর এই ব্যাংকে হল-মার্কের জালিয়াতি করা অর্থের পরিমাণ তিন হাজার ৬০৬ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। অন্য কোনো বেসরকারি ব্যাংকে এই পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ হলে ব্যাংকটি বন্ধ হয়ে যেত। যেমন এক হাজার কোটি টাকারও কম অর্থ জালিয়াতের কারণে বন্ধ হয়েছিল ওরিয়েন্টাল ব্যাংক। সোনালী ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বলেই কেবল টিকে আছে।
হল-মার্ক কেলেঙ্কারির পর থেকে অর্থমন্ত্রী বলেই চলেছেন যে তিন বা চার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি বড় কিছু নয়। সামগ্রিক ব্যাংকিং খাতের আকারের তুলনায় চার হাজার কোটি টাকা সামান্য। আর এ নিয়ে গণমাধ্যম বাড়াবাড়ি করেছে বলেও মন্তব্য করেছিলেন তিনি। এ ধরনের মন্তব্য অর্থমন্ত্রী আরও করেছেন। যেমন, হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা জানাজানি হয়ে গেলে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৪৬(৬) ধারা অনুযায়ী সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের অনুরোধ করে অর্থমন্ত্রীর কাছে একটি প্রতিবেদন পাঠায়। হল-মার্ক কেলেঙ্কারির দায় পর্ষদের ওপর বর্তায়, উল্লেখ করেই সেই প্রতিবেদনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর পর্ষদ পুনর্গঠনের কথা বলেছিল। এই ধারায় বলা আছে, সরকার মনোনীত বা নিযুক্ত কোনো চেয়ারম্যান, পরিচালক বা প্রধান নির্বাহীর আচরণ সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করতে পারবে এবং সরকারও তা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। অথচ এই চিঠি পাওয়ার পরই অর্থমন্ত্রী সোনালী ব্যাংকের পর্ষদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা তো নিলেনই না, বরং বললেন, ‘এটা তাদের দায়িত্ব নয়।’ অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকের দায়িত্ব কেবল অর্থমন্ত্রীর একার। আর সেই দায়িত্ব নেওয়ার ফল আমরা সবাই দেখেছি।
এই সরকারের সময়ে হল-মার্ক একমাত্র কেলেঙ্কারি নয়, এর চেয়েও বড় কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। আর সেটি হলো শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি। শেয়ারবাজারের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা হচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সংস্থাটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন। উভয়ে মিলেই চরম ব্যর্থ। লাখ লাখ বিনিয়োগকারী এখনো ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কেবল যে কেলেঙ্কারি ঠেকাতে ব্যর্থ তা নয়, কেলেঙ্কারির পর দায়ী কারসাজিকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে ব্যর্থ হয়েছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী। কেলেঙ্কারি ঘটার পর সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করেছিল সরকার। সেই কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদনও দিয়ে দেয়। সেখানে অনেকগুলো কারসাজির ঘটনা এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নাম দিয়ে বলা হয়েছিল, সরকারের উচিত হবে অধিকতর তদন্ত করা। সেখানে বলা ছিল, ‘১৯৯৬ সালের শেয়ার তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন বাস্তবায়ন দূরের কথা, বিবেচিত হয়েছে কি না সে প্রশ্ন রয়েছে। ব্যবস্থা নেওয়া হলে পরিস্থিতি অন্য রকম হতো। বর্তমান কমিটি অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যেও উল্লেখযোগ্য তথ্য সংগ্রহ করেছে, দুর্নীতি-অনিয়ম সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে, নমুনা পরিদর্শন করেছে এবং সে অনুযায়ী সুপারিশ প্রণয়ন করেছে। এসবের যুক্তিযুক্ত পরিণতি থাকা উচিত।’
মজার বিষয় হলো, তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর সেই প্রতিবেদনের বিপক্ষে চলে গেলেন অর্থমন্ত্রী। প্রথম দিনই বলেছিলেন প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে। এর এক দিন পর বললেন কিছু নাম সম্পাদনা করে প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন, আর এখন বলছেন কিছু ব্যক্তির নাম দিয়ে অন্যায় করেছে ইব্রাহিম খালেদ কমিটি। সর্বশেষ সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘ইব্রাহিম খালেদ মনগড়া বিভিন্ন ব্যক্তির নাম জড়িয়েছেন।’ এসব কথাবার্তার ফল হচ্ছে বাজার এখনো দাঁড়াতে পারেনি, আর কারসাজিও চলছে। আর সবাই স্বীকার করছেন যে ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে হুমকির নাম শেয়ারবাজার। আর এর দায় অবশ্যই অর্থমন্ত্রীকে নিতে হবে।
প্রণব মুখার্জি রাষ্ট্রপতির শপথ নেওয়ার আগে ভারতের অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ভারতের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হওয়ার খবরটি প্রচারের পরপরই অর্থমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সফলতা ও ব্যর্থতা নিয়ে নানা বিশ্লেষণ শুরু হয়। ২০১২ সালের ১৬ মে রয়টার্স যে বিশ্লেষণটি প্রকাশ করে সেটির শিরোনাম ছিল, ‘ভারত একজন ভালো অর্থমন্ত্রী বেছে নেওয়ার সুযোগ পেল।’ প্রণব মুখার্জিকে বলা হচ্ছে, ভারতের সবচেয়ে ব্যর্থ অর্থমন্ত্রী। ব্যর্থ কারণ, তাঁর সময় রুপি ব্যাপকভাবে মূল্যমান হারিয়েছে, বাজেট ঘাটতি রেকর্ড ছুঁয়েছে, ভর্তুকির বিপুল ব্যয় ঠেকানো যায়নি, বড় ধরনের সংস্কারও হয়নি, প্রবৃদ্ধিও কমছে।
আমাদের অর্থমন্ত্রীর সময় সে রকম কিছু হয়নি। বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণেই আছে, প্রবৃদ্ধিও বেড়েছে, যদিও ভর্তুকি অনেক বেড়েছে। মাঝে টাকা মূল্যমান হারালেও এখন স্থিতিশীল। সুতরাং এসব দিক থেকে আবুল মাল আবদুল মুহিতকে মোটেই ব্যর্থ বলা যাবে না। তবে একটি ব্যর্থতার কথা অর্থমন্ত্রী নিজেও অনেকবার বলেছেন। সেটি হলো বেসরকারি বিনিয়োগ আনতে পারেননি তিনি। আর যে ব্যর্থতাগুলো অর্থনীতিতে চিরস্থায়ী প্রভাব ফেলছে সেগুলোর কথা কখনোই স্বীকার করেননি তিনি। যেমন, তাঁর সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংকগুলো দেউলিয়ার পথে চলে গেছে, হল-মার্কের মতো দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে, শেয়ারবাজারে হয়েছে বৃহত্তম কেলেঙ্কারি, পদ্মা সেতুর জন্য ঋণচুক্তি করেও তা বাতিল করেছে সবগুলো দাতা, আবার গ্রামীণ ব্যাংক নিয়েও একের পর এক পদক্ষেপে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনাও কুড়িয়েছেন তিনি।
পিটার আলেকজান্ডার ওয়ালশ ১৯৮৪ থেকে ১৯৯০ সময় পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৯৫ সালে তাঁর একটি আত্মকথা ধরনের বই প্রকাশ পায়। এই বইটির নাম কনফেশনস অব ও ফেইলড ফিন্যান্স মিনিস্টার। সেখানে তিনি তাঁর নিজের দুটি ব্যর্থতার কথা লিখেছিলেন। যেমন তিনি সরকারের অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ব্যয় কমাতে পারেননি এবং সরকারের অপ্রয়োজনীয় হস্তক্ষেপও ঠেকাতে পারেননি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত একজন সুলেখক। অর্থনীতি, রাজনীতি ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাঁর বেশ কিছু বই রয়েছে। জানি না, অর্থমন্ত্রী থাকার সময়টা নিয়ে তিনি কিছু লিখবেন কি না। তিনি একসময় এরশাদেরও অর্থমন্ত্রী ছিলেন। এরশাদের পতনের পর ১৯৯১ সালে তিনি লিখেছিলেন একটি বই, বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও জাতীয় ঐকমত্য। সেখান থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিই:
‘বাংলাদেশে ব্যাংক ঋণ পরিশোধ না করাটা এখন এক রকম সার্বজনীন অভ্যাস। বড় বড় ব্যবসায়ী, সফল শিল্পপতি বা গ্রামীণ মাতব্বর কেউই ঋণ পরিশোধ করে না। তার ফলে উদ্যোগী লোকেরা বা গরিব চাষিরা কোন ঋণ পায় না, সুস্থ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলতে পারে না।...ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ ব্যক্তিরা গোষ্ঠী হিসাবে সরকারের সহযোগী, তাই এদের মর্জিই হলো সরকারের প্রচেষ্টা। বিশেষ গোষ্ঠীকে নিজের দলে রাখতে গেলে স্বভাবতই দেশের বা জনতার স্বার্থ বিসর্জন দিতে হয়।’
আবুল মাল আবদুল মুহিতের এই কথাগুলো কেউ যদি সন-তারিখ না জেনে পড়েন আর ভাবেন কথাগুলো ২০১৩ সালেরই, তাতে খুব বেশি অবাক হওয়ার কিছু নেই। পরিস্থিতি আসলে এখন এ রকমই। কেন এমন হলো, অর্থমন্ত্রী কি একদিন লিখবেন?
শওকত হোসেন সাংবাদিক।
massum99@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.