আরাফাতের খুনি ইসরায়েল

ইয়াসির আরাফাত
প্যারিসের হাসপাতালে আরাফাত মারা যান ২০০৪-এর ১১ নভেম্বর। তাঁর রোগটা চিহ্নিত করা যায়নি। তাঁর মৃত্যু দুর্ঘটনাও ছিল না, স্বাভাবিকও ছিল না। নির্ভরযোগ্য প্রমাণ বলছে, তিনি গুপ্তহত্যার শিকার। আরাফাত নিজেই বলেছেন, কমপক্ষে ৪০টি হত্যাচেষ্টা তিনি উতরিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে অল্পের জন্য তিউনিসিয়ায় ইসরায়েলি বোমা হামলা থেকে রক্ষা পান। ওই হামলায় মারা যায় ৭৩ জন।
২০০১-এর ডিসেম্বরে ইসরায়েলি মিসাইল রামাল্লায় তাঁর দপ্তরে আঘাত হানে। এর খানিক আগেই তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে যান। ইসরায়েল বুঝিয়ে দিয়েছিল আরাফাত হত্যার নিশানায়। সে সময় তিনি আক্ষরিকভাবেই নিজের দপ্তরে বন্দী ছিলেন। তাঁর স্বাস্থ্য ছিল ভালো। কিন্তু সে সময়ের ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী অ্যারিয়েল শ্যারন চেয়েছিলেন আরাফাতের মৃত্যু। ১৯৮২ সালে প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে শ্যারন বৈরুতে আরাফাতকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পাইকারি হারে ফিলিস্তিনিদের হত্যার জন্য শ্যারন লেলিয়ে দিয়েছিলেন ফ্যাসিস্ট ফ্যালাঞ্জিস্ট বাহিনীকে। শ্যারন ঘোষণা করেছিলেন, ‘সন্ত্রাসবাদ চালাচ্ছেন একজন মাত্র ব্যক্তি, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ইয়াসির আরাফাত।’ তাঁকে হত্যার জন্য শ্যারনের দরকার ছিল ওয়াশিংটনের সবুজসংকেত। ইসরায়েলি এম হেইম র‌্যামন বলেন, ‘শ্যারন চেয়েছিলেন আরাফাতকে সরিয়ে তাঁর জায়গায় নরমপন্থী কাউকে বসাতে। এখন সেটাই হয়েছে।
ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ কার্যত ধ্বংস এবং পশ্চিম তীর ও গাজা ইসরায়েলের প্রায় পূর্ণ দখলে।’ বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু সে সময় ছিলেন শ্যারনের প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি দাবি করেছিলেন, ‘সম্পূর্ণ সামরিক বিজয়।’ তাঁরা চেয়েছিলেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধের সম্পূর্ণ বিনাশ। ওয়াশিংটনের সম্মতি নিয়েই ইসরায়েল আরাফাতকে হত্যার সময় ও পদ্ধতি বেছে নিল। তারা ভেবেছিল, কোনো প্রমাণ থাকবে না। কিন্তু তারা ভুল ভেবেছিল। ইসরায়েলি সাংবাদিক, শ্যারনের একসময়ের বিশ্বস্ত মুখপাত্র ইউরি দান মনে করেন, শ্যারনই আরাফাতকে হত্যা করেছেন এবং জর্জ বুশ এর অনুমোদন দিয়েছিলেন। তিনিই বলেন, আরাফাতকে বিষ প্রয়োগ করা হয়। আরাফাতের দীর্ঘদিনের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ড. আশরাফ আল-কুর্দি ২০০৭ সালে বলেন, আরাফাতের রক্তে এইচআইভি পাওয়া গেছে, কিন্তু তিনি নিহত হয়েছেন বিষের কারণে। মৃত্যুর অল্প কিছু আগে তাঁর শরীরে এইচআইভির ভাইরাস প্রবেশ করানো হয়। ২০০৫-এর সেপ্টেম্বরে কুর্দি বলেছিলেন, যেকোনো চিকিৎসকও আরাফাতের রোগলক্ষণ দেখে বলবেন, তিনি বিষের শিকার। প্যারিসে নেওয়ার আগে তাঁর শরীরের ওজন অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল, মুখ লালচে আর গায়ের রং হয়ে পড়েছিল ধাতব হলুদ।
বিষটা ধীরে ধীরে কাজ করছিল। অক্টোবরের ১২ তারিখে খাওয়ার পরই আরাফাতের বমি হয় এবং তলপেটে ব্যথা হয়। ঘণ্টা খানেক আগেই তিনি ছিলেন সম্পূর্ণ সুস্থ। তিউনিসিয়া থেকে ডাক্তাররা এলেন, তাঁরাও রোগটা ধরতে পারলেন না। ২৯ তারিখে হেলিকপ্টারে করে তাঁকে জর্ডানে নেওয়া হলে অপেক্ষারত ফরাসি বিমান তাঁকে প্যারিসে নিয়ে যায়। ফরাসি ডাক্তাররাও রোগ ধরতে ব্যর্থ হন। ৩ নভেম্বর কোমা এবং ৪ নভেম্বর মৃত্যু। অথচ কোনো ময়নাতদন্ত করা হলো না। মৃত্যুর কারণ ঘোষিত হলো না। চিকিৎসার কাগজপত্রও থাকল অপ্রকাশিত। ২০১২ সালে স্ত্রী সুহা আরাফাতের লাশ তোলার আদেশ দেন। সুইস, ফরাসি ও রাশিয়ার বিজ্ঞানীদের তাঁর দেহের উপাদান পরীক্ষার জন্য দেওয়া হয়। আল-জাজিরা টেলিভিশন প্রচার করে: ‘নয় মাসের অনুসন্ধান বলছে, আরাফাত হয়তো পোলোনিয়াম বিষে মারা গেছেন।’ তাঁর ব্যক্তিগত ব্যবহার্য সবকিছু পরীক্ষা করে পোলোনিয়াম বিষ মেলে। পোলোনিয়াম উচ্চমাত্রার তেজস্ক্রিয় পদার্থ। এটা হাইড্রোজেন সায়ানাইডের থেকে ১০৯ গুণ বিষাক্ত। এটা শরীরে তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে মেরে ফেলে। কিন্তু হাসপাতালের যন্ত্রে তা ধরা পড়ে না। তবে সুইজারল্যান্ডের রেডিওফিজিক (এসআ৬র) সংস্থা আরাফাতের জিনিসপত্র, রক্ত, মূত্র,
লালা ও ঘামের নমুনা পরীক্ষা করে সেসবে অস্বাভাবিক মাত্রার পোলোনিয়াম পায়। এবং তা আরাফাতের শরীরে প্রাকৃতিক উৎস থেকে আসেনি। ফরাসি চিকিৎসক ড. ফ্রাঁসোয়া বকুদ বলেন, ‘আমি নিশ্চিত করে বলছি, আমরা আরাফাতের শরীরে পোলোনিয়ামের ব্যাখ্যাতীত আধিক্য পেয়েছি।’ এ বছরের ৬ নভেম্বর আল-জাজিরায় ব্রিটেনের শীর্ষ ফরেনসিক বিজ্ঞানী ও সাবেক গোয়েন্দা ডেভ বার্কলে বলেন, ‘আরাফাত পোলোনিয়ামের বিষক্রিয়ায় মারা গেছেন। আমরা তাঁকে হত্যার বন্দুকটা পেয়েছি, কিন্তু তা কার হাতে ধরা, তা এখনো পাইনি।’ মৃত্যুর পর মাহমুদ আব্বাসকে দিয়ে ইসরায়েল তাঁর মৃত্যুর কার্যকারণ ধামাচাপা দিতে সক্ষম হয়। অন্যদিকে ফরাসি চিকিৎসকদের বলা হয়েছিল চুপ থাকতে। ইসরায়েল বারবার প্রকাশ্যে আরাফাতকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে। তাঁকে হত্যার কারণ ও সক্ষমতাও তাদের আছে। আর আরাফাতই প্রথম নেতা নন, যাকে ইসরায়েল হত্যা করেছে।
ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ গুপ্তহত্যায় বিশ্বের সেরা। দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা সফল। ১৯৯৭ সালে আম্মানে হামাসের রাজনৈতিক নেতা খালেদ মিশালের কানে তারা বিষ স্প্রে করে। কিন্তু তিনি বেঁচে যান। ২০০৫-এর ফেব্রুয়ারিতে রেকর্ড করা ভিডিও ও অডিও সাক্ষ্যপ্রমাণ দেখায় যে লেবাননের প্রধানমন্ত্রী রফিক হারিরিকেও তারা হত্যা করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এর জন্য সিরিয়াকে দোষী করে। পরে হিজবুল্লাহকেও দোষারোপ করা হয়। কিন্তু দেখা গেল, হারিরিকে হত্যার সম্পূর্ণ দায়দায়িত্ব ইসরায়েলের। অথচ কেউ তাদের জবাবদিহি চাইছে না। দশকের পর দশক ধরে তারা রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা চালিয়ে আসছে, করে যাচ্ছে যুদ্ধাপরাধ, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তারা ফিলিস্তিনিদের ওপর চালাচ্ছে স্লোমোশন জেনোসাইড। গত ৫ নভেম্বর সুহা আরাফাত এসআরের রিপোর্ট হাতে পান: ‘আমি ইয়াসিরের শোকে নতুন করে পড়লাম, যেন এইমাত্র শুনলাম তিনি মারা গেছেন।’
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ। কাউন্টারপাঞ্চ থেকে নেওয়া।
স্টিফেন লেন্ডম্যান: মার্কিন সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.