জাতীয় মশকরা by সাজেদুল হক

বেইলী রোডেও এমন নাটক কখনও মঞ্চস্থ হয়েছে কিনা- তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। নাটকপ্রবণ বাংলাদেশের রাজনীতিতে সোমবার যা ঘটে গেল তা একেবারেই অভিনব।
সুনিশ্চিত করে বলতে গেলে, অভিধানের কোন শব্দই আসলে এ নাটককে কাভার করে না। ‘সংবিধান, সংবিধান’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলা মহাজোট সরকার সংবিধান নিয়ে কি তামাশাটাই না করলো! তবে মশকরা এখনও শেষ হয়নি। এ লেখার ২৪ ঘণ্টা আগে আমরা জানতাম, মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রধানমন্ত্রী যাদের নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় রাখতে চান তাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করবেন না। বাকিদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে প্রেসিডেন্টের কাছে পাঠিয়ে দেবেন। যেখানে সংবিধান অনুযায়ী যে কোন সময় মন্ত্রিসভা পুনর্গঠনের এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর রয়েছে সেখানে পদত্যাগের এ ক্যামেরা শো’র কি প্রয়োজন ছিল সে প্রশ্ন এরই মধ্যে উঠেছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞরা সাফ জানিয়ে দেন, পদত্যাগপত্র গ্রহণ করা না করার কোন এখতিয়ার প্রধানমন্ত্রীর নেই। পদত্যাগপত্র দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই মন্ত্রীদের পদত্যাগ কার্যকর হয়ে যায়। অবশ্য এটা বোঝার জন্য সংবিধান বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সংবিধানের ৫৮(১) অনুচ্ছেদ একেবারেই স্পষ্ট। ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, ‘প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত অন্য কোন মন্ত্রীর পদ শূন্য হইবে, যদি- ক) তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন।’ পদত্যাগের পরও মন্ত্রীদের চেয়ারে বসে থাকা নিয়ে যখন বিতর্ক তুঙ্গে তখন আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের বক্তব্য বিস্ময়কর। গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি জানান, মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর হাতে যা দিয়েছেন তা আদতে পদত্যাগপত্রই নয়, কেননা তা প্রেসিডেন্ট বরাবর দেয়া হয়নি। আইনমন্ত্রীর ভাষায়, এটা পদত্যাগই না। এটা আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। যদিও এ কিসের আনুষ্ঠানিকতা ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ তা বলতে পারেননি অথবা বলতে চাননি। সরকারে যোগ দেয়ার আগে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদের সংবিধান নিয়ে দেয়া বিভিন্ন মতামত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হতো। তিনি এখন বলছেন, মন্ত্রীরা কেউ পদত্যাগ করেননি, তারা অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন। যে পদত্যাগপত্র দেয়া হয়েছে, তা সংবিধান অনুযায়ী হয়নি। তাহলে সোমবার মন্ত্রীরা প্রধানমন্ত্রীর হাতে যে পত্র দিয়েছেন, তাকে কি বলা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আপনারা যা খুশি বলতে পারেন। যদিও সরকারের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু আমাদের হাইকোর্ট দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, সংবিধান অনুযায়ীই মন্ত্রীরা পদত্যাগ করেছেন। এব্যাপারে প্রয়োজন হলে আদালতে যাওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন। দুই মন্ত্রীর এই পরস্পরবিরোধী মন্তব্যে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে তাদের কে সঠিক?

শাসনতন্ত্র অথবা সংবিধান প্রণয়নে বিলম্বকে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান ব্যর্থতা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে ওই ব্যর্থতা গ্রাস করেনি। মহান মুক্তিযুদ্ধের এক বছরের মধ্যেই আমরা সংবিধান প্রণয়ন করতে পেরেছিলাম। ৩০ লাখ মানুষের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পাই এ দলিল। যদিও তা বদলে ফেলতে সময় নেয়নি বাঙালি জাতি। স্বাধীনতার চার বছরের মধ্যেই সংবিধানের খোলনলচে পুরো বদলে ফেলা হয়। এতে নেতৃত্ব দেন স্বয়ং জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। এ দলিল নিয়ে পরে অবশ্য অনেক রক্তক্ষয় হয়। রাজনীতির মাঠে স্বাধীন বাংলাদেশে যত প্রাণ গেছে তার বেশির ভাগই গেছে সংবিধান নিয়ে সংঘাতে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এখন যে সংঘাত চলছে তারও মূলে সংবিধান থেকে চুল নড়া, না নড়া নিয়ে। সংবিধান লঙ্ঘনের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধানের কথা পবিত্র সংবিধানে বলা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের সঙ্গে মশকরার শাস্তি কি- তা আমাদের এ মহান গ্রন্থে বলা নেই।

No comments

Powered by Blogger.