মন্ত্রীবিহীন প্রধানমন্ত্রী by শহীদুল্লাহ ফরায়জী

বর্তমান বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী ছাড়া মন্ত্রিসভায় আর কোন সদস্য নেই। কারণ রাষ্ট্রীয় অতীব ও জরুরি প্রয়োজনেই প্রধানমন্ত্রী ৫৮(২) অনুচ্ছেদ
মোতাবেক মন্ত্রীদের পদত্যাগের অনুরোধ করেছেন। তারা যেন পদত্যাগপত্র পেশ করে মন্ত্রী পদ শূন্য করে দেন এটাই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায়। সংসদীয় ব্যবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা থাকবে এবং প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বা তার কর্তৃত্বে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা প্রযুক্ত হবে। যা সংবিধানের ৫৫(১) ৫৫(২) নিশ্চিত করেছে। সুতরাং, সরকারের সর্বোচ্চ নির্বাহী প্রধানমন্ত্রীর অভিপ্রায় পূরণে যে সকল মন্ত্রী পদত্যাগে অসমর্থ হবেন তাদের নিয়োগের অবসান করার জন্য প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দেবেন মাননীয় রাষ্ট্রপতিকে। এখানে মন্ত্রী পদের অবসান করানোই বাধ্যতামূলক। সংবিধানের ৫৮(২)-এ বলা হয়েছে- “প্রধানমন্ত্রী যে কোন সময়ে কোন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করিতে অনুরোধ করিতে পারিবেন এবং উক্ত মন্ত্রী অনুরূপ অনুরোধ পালনে অসমর্থ হইলে তিনি রাষ্ট্রপতিকে উক্ত মন্ত্রীর নিয়োগের অবসান ঘটাইবার পরামর্শ দান করিতে পারিবেন।” অর্থাৎ এ অনুচ্ছেদের আবশ্যকীয় নির্দেশনা হচ্ছে মন্ত্রী পদ শূন্য করা বা মন্ত্রীর নিয়োগ অবসান করা। মন্ত্রীরা পদত্যাগ করে এ অনুচ্ছেদের আবশ্যকীয় শর্ত পূরণ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পদত্যাগকারী মন্ত্রীদের আর কোন দায়িত্ব পালন করার কোন সুযোগ সাংবিধানিকভাবে নেই। সাংবিধানিক পদের পদবিধারীদের পদত্যাগ মানেই চূড়ান্ত। পদত্যাগ জমা করা বা কালক্ষেপণ করা সংবিধান পরিপন্থি। প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করতে পারবেন তা হবে নতুন শপথের আওতায়। অন্যদিকে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী ৫৮(৪) অনুযায়ী পদত্যাগ করেননি সুতরাং মন্ত্রীদের উত্তরাধিকারীগণ কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত তারা স্ব স্ব পদে বহাল থাকার কোন সাংবিধানিক বিধান নেই।

আইনমন্ত্রী বলেছেন, আমরা পদত্যাগ করিনি, শুধু পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রীর নিকট জমা দিয়েছি। রাষ্ট্রপতির কাছেও দিইনি। আইনমন্ত্রীর এ বক্তব্য সংবিধানের সঙ্গে চরম সাংঘর্ষিক। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করাই মন্ত্রীর সাংবিধানিক কর্তব্য ও এখতিয়ার। আর সরাসরি রাষ্ট্রপতির নিকট কোন মন্ত্রীর পদত্যাগপত্র পাঠানোর কোন সাংবিধানিক এখতিয়ার নেই।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীগণের পদ ও পদমর্যাদা এমন উচ্চতম অবস্থানে রাখা হয়েছে যা পদত্যাগ করলেই কার্যকর হয়। কারণ, এসব পদ ও পদের অধিকারী ব্যক্তিগণ নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে সর্বোত্তম বিবেচনা করে সংবিধানে এসব অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। এসব পদ ও পদের অধিকারী ব্যক্তিগণ শপথ গ্রহণ করে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এসব পদের সঙ্গে যেহেতু শপথ গ্রহণ করতে হয় এবং শপথে যেহেতু কোন রাগ বা অনুরাগ বশবর্তী না হওয়ার বিষয় উল্লেখ আছে তাই নীতিনৈতিকতার সর্বোত্তম মান বিবেচনা করেই সাংবিধানিক গুরুত্ব ও মর্যাদা দেয়া হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে মন্ত্রীদের পদত্যাগ সংক্রান্ত তিনটি উপায় সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। প্রথমটি হচ্ছে ব্যক্তিগত কারণে যে কোন মন্ত্রী পদত্যাগ করতে পারেন, দ্বিতীয়টি হচ্ছে রাষ্ট্রীয় প্রয়োজনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে পদত্যাগ করিবেন, আর তৃতীয়টি হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে মন্ত্রীদের প্রত্যেকে পদত্যাগ করেছেন বলে গণ্য হবে। প্রথম ও দ্বিতীয় কারণে মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র পেশ করতে হবে-তৃতীয় কারণে মন্ত্রীদের পদত্যাগপত্র পেশ করতে হবে না। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে যে সকল মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র দিয়েছেন সে সকল মন্ত্রীর পদ শূন্য হয়ে পড়ছে গতকাল ১১ই নভেম্বর সোমবার অপরাহ্ণে। কারণ, এ ধরনের রাষ্ট্রের উচ্চতর পর্যায়ের ব্যক্তিত্বগণ কার্যভার গ্রহণের আগেই সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদ মোতাবেক শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দিয়েছেন। এ মন্ত্রীগণ যখন স্বাক্ষর করে পদত্যাগপত্র পেশ করেন তখন ওই শপথের অবসান হয়ে যায়। শপথের আগে যেমন কার্যভার গ্রহণ করতে পারবেন না, তেমনি শপথের অবসান হয়ে যাওয়ার পর কার্যভারও পালন করতে পারবেন না। মন্ত্রী পদের মেয়াদ প্রশ্নে ৫৮(১)(ক) ‘তিনি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করিবার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান করেন’। অর্থাৎ মন্ত্রীর মেয়াদ হবে শপথ গ্রহণের পর থেকে প্রধানমন্ত্রীর নিকট পদত্যাগপত্র প্রদান পর্যন্ত। পদত্যাগপত্র পেশকালেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদ শূন্য হয়ে যায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ পদ যেহেতু শূন্য হয়ে পড়েছে তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে সারসংক্ষেপ করে রাষ্ট্রপতির নিকট দ্রুত পাঠালে এবং অতি দ্রুত গেজেট নোটিফিকেশন জারি করা সরকারের জরুরি রাষ্ট্রীয় কর্তব্য। সরকার যদি রাষ্ট্রীয় জরুরি কাজ সম্পাদন না করে নিশ্চয়ই সরকারের বিরুদ্ধে সংবিধান লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠবে। এসব রাষ্ট্রীয় শূন্য পদ নিয়ে কালক্ষেপণের কোন সুযোগ নেই।
এসব উচ্চতম পদের মহিমা বিবেচনা করেই শপথ গ্রহণপূর্বক কার্যভার এবং পদত্যাগের মাধ্যমে অবসানের সুরক্ষা দিয়েছে সংবিধান। একজন মন্ত্রী বলেছেন পদত্যাগপত্রে তারিখ নেই। রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শপথ গ্রহণকারী কোন মন্ত্রী কি প্রতারণা করতে পারেন? রাষ্ট্রকে কি প্রতারিত করা যায়? শপথ ও ঘোষণা ফরমেও কোন তারিখ থাকে না। তারিখ প্রদান বা সিলমোহর প্রদান হচ্ছে প্রশাসনের আনুষ্ঠানিকতা। আর মন্ত্রিপরিষদ সভায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে সরাসরি পদত্যাগপত্র জমা দেয়ার পর তারিখের বিষয়টি সম্পূর্ণ হাস্যকর।
এককালে উৎপত্তিগত দিক থেকে মন্ত্রী বা গরহরংঃবৎ বলতে বোঝাতো চবৎংড়হ ড়ভ খড়বিৎ ঝঃধঃঁং কিন্তু আজ গরহরংঃবৎ শব্দটি রাজনৈতিক অর্থ লাভ করেছে এখন তারা গবসনবৎ ড়ভ ঈধনরহবঃ। সুতরাং, উচ্চতম পদের উচ্চতম মর্যাদার সাংবিধানিক বেষ্টনীকে ভেঙেচুরে বিনষ্ট না করাই তো আমাদের দায় বা কর্তব্য। মন্ত্রীরা শপথ নিয়েছেন যে নৈতিক দায় থেকে সে দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন পদত্যাগ করে। গেজেট প্রকাশ করা আমলাদের কাজ। কোন মন্ত্রী যদি মনে করেন গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন সেটা একেবারেই নৈতিকতা ও আইনবহির্ভূত। মন্ত্রীর শপথের অবসান হলেই কার্যভার শেষ। গেজেট হচ্ছে সরকারি আনুষ্ঠানিকতা। মন্ত্রীদের জন্য শপথ অনিবার্য-অপরিহার্য-অবশ্যক। তেমনি শপথের অবসানই হচ্ছে চূড়ান্ত। প্রধানমন্ত্রী যদি সংবিধানের ৫৭ অনুচ্ছেদ মোতাবেক রাষ্ট্রপতির নিকট পদত্যাগ করেন। রাষ্ট্রপতি যদি সংবিধানের ৫০ অনুচ্ছেদ মোতাবেক স্পিকারের নিকট পদত্যাগ করেন- সে সকল পদত্যাগ গ্রহণ অনুমোদন বা বিবেচনার যেমন সুযোগ নেই তেমনি মন্ত্রীদের ব্যাপারেও পদত্যাগে কোন অভিমতের এখতিয়ার নেই। কিন্তু বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনার জন্ম দিয়েছি আমরা। মন্ত্রী পদত্যাগ করেও রেহাই পাচ্ছেন না। সুরঞ্জিত বাবু সংবাদ সম্মেলনে পদত্যাগের কথা স্বীকার করেছেন ২০১২ সালে। ২০১৩ সালে জাতীয় সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করে সেই পদত্যাগের কথা স্বীকার করেছেন, এবার নাকি আবারও পদত্যাগ করেছেন। সুরঞ্জিত বাবুর কোন পদত্যাগপত্রটি গ্রহণ করা হবে? মাননীয় অর্থমন্ত্রী নাকি কোরবানির ঈদের আগেই পদত্যাগপত্র দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর নিকট। কতবার মন্ত্রী পদত্যাগপত্র পেশ করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে- আর গেজেট কবেই প্রকাশ পাবে? এভাবে সাংবিধানিক লঙ্ঘন অব্যাহত থাকলে একদিন রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়বে- যা হয়ে যাবে পুনরুদ্ধারের অসাধ্য।
শহীদুল্লাহ ফরায়জী

No comments

Powered by Blogger.