জাতিকে নেতৃত্বহীন করতে চেয়েছিল ঘাতকরা by সৈয়দ আবুল মকসুদ

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের জেল-হত্যাকাণ্ড ছিল ১৫ আগস্টের ঘটনাবলিরই ধারাবাহিকতা। বঙ্গবন্ধু ও জেলখানায় তার চার সহকর্মীর হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণকে নেতৃত্বহীন করার নীলনকশার পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়। আগস্ট ট্রাজেডির তিন মাসের মধ্যেই যে ঘাতকদের আরও রক্তের প্রয়োজন হবে, তা বাংলাদেশের মানুষ স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি। ঘাতকরা রক্ত চেয়েছিল দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতাদের। চার নেতাকে খুব কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল আমার। চারটি বছর দেশের নানা অঞ্চলে আমি তাদের সঙ্গে ব্যাপক সফর করেছি। তারা অন্যরকম রাজনীতিবিদ ছিলেন। পাকিস্তান আমলে তারা এ দেশের মানুষের স্বাধিকার অর্জনের জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন। সে জন্য নির্যাতন-নিপীড়ন, জেল-জুলুম সহ্য করেছেন। স্বাধীনতার জন্য একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে তারা আপসহীনভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দেশের প্রতি তাদের অন্যরকম দরদ ছিল। তাদের জীবনে ভুল-ভ্রান্তি, দোষ-ত্র“টি ছিল না তা নয়, কিন্তু তারা বেঁচে থাকলে অতীতের মতো ভবিষ্যতেও দেশের স্বার্থ বিসর্জন দিতেন না এবং নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য কিছু করতেন না বলেই আমার বিশ্বাস। আমাদের মতো তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরাও সেটা খুব ভালো জানতেন। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তিও জানত। তাই তাদের বাঁচিয়ে রাখা তারা নিরাপদ মনে করেনি।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান ছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদী নেতা। তারা একই দলের নেতা ছিলেন, তবে তাদের প্রত্যেকেরই ছিল আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। যেমন, রাজনীতি না করলে তাজউদ্দীন আহমদ হতেন একজন প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী। একজন সৎ বুদ্ধিজীবীর সব বৈশিষ্ট্যই তার মধ্যে ছিল। যদিও বুদ্ধিজীবীরা সমাজে আলাদা কোনো প্রজাতি নয়। যে কোনো পেশা থেকেই একজন হতে পারেন বুদ্ধিজীবী, যদি তার থাকে সমাজ ও রাষ্ট্রের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ আর বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা, যুক্তিবাদী মন, ন্যায়পরতা এবং মানুষের কল্যাণ করার অঙ্গীকার। এ বৈশিষ্ট্যগুলো তাজউদ্দীনের মধ্যে দেখেছি।
নিহত চার নেতার কোনো ব্যক্তিগত শত্র“ ছিল বলে আমাদের জানা নেই। থাকলেও তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ থাকতে পারে। এমন কোনো শত্র“ তাদের ছিল না, যারা তাদের প্রতিশোধ নেয়ার জন্য খুন করতে পারে। তাদের কেউ খুন করতে চাইলে জেলখানার বাইরেও তা করতে পারত। তাছাড়া তাদের সবার অভিন্ন শত্র“ থাকার কথা নয়- যে শত্র“ তাদের একই সঙ্গে হত্যা করে আনন্দ পাবে বা উপকৃত হবে। জেল হত্যাকাণ্ড একটি সুপরিকল্পিত ঘটনা, যার পেছনে দেশী ও বিদেশী হাত ছিল এবং তারা শুধু ওই চার নেতার শত্র“ ছিল না, তারা ছিল গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের শত্র“। চার জাতীয় নেতা যে সময়টিতে নিহত হন, সেটি ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের সময়। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সংহত করার সময়। ওই সময়টিতে তাদের নেতৃত্বের খুব প্রয়োজন ছিল এ জাতির। অনেকের মতো আমারও বিশ্বাস, একদলীয় শাসন বাংলাদেশে খুব বেশি দিন থাকত না। বঙ্গবন্ধু এবং এ চার নেতা বেঁচে থাকলে জনগণের আবেগ-অনুভূতি ও মনোভাব উপলব্ধি করে তারা আবার বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের পথেই ফিরে আসতেন।
শত্র“রা সেই সুযোগটি তাদের দেয়নি। তাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি নতুন ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির ধারায় প্রবেশ করে। সেই রাজনীতির মধ্যেই এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে দেশ। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে আরও দীর্ঘ সময় আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। এ চার নেতার বিকল্প নেতৃত্ব গত ৩৮ বছরেও তৈরি হয়নি। জেল হত্যাকাণ্ডের দুটি দিক আছে। একটি হল এটি মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ। অন্য দিকটি রাজনৈতিক। ফৌজদারি অপরাধের বিচার হয় আদালতে। দোষীদের শাস্তি হয় আদালতের রায়ে। অপরাধীদের মানুষ এক সময় ভুলে যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দিকটির তাৎপর্য অনেক বেশি ও সুদূরপ্রসারী।
ঘাতকরা দুটি কাজ করেছে। শারীরিকভাবে চার নেতাকে হত্যা করেছে। একই সঙ্গে হত্যা করেছে তাদের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে। বরং তাদের রাজনীতিকে হত্যা করাই ছিল ঘাতকদের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। কিন্তু আমরা প্রশ্ন করতে পারি, চার নেতার রাজনীতি তো অন্যভাবেও প্রতিহত করা যেত। ঘাতকরা মনে করেছে, ওই নেতাদের জীবিত রেখে তাদের রাজনীতি ধ্বংস করা সম্ভব নয়। তাই তাদের হত্যা করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প ছিল না ঘাতকদের সামনে।
হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য, অপরাধীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য রাষ্ট্রের থানা, পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট, আদালত রয়েছে। সেখানে আইন-কানুনের নিরিখে সাক্ষী-সাবুদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে অপরাধীদের বিচার ও শাস্তি হয়। এ নিয়ে সাধারণ মানুষের বলার কিছু নেই। কিন্তু জেলহত্যার ঘটনা একটি সাধারণ অপরাধ বা হত্যাকাণ্ড নয়। এটি একটি বড় রাজনৈতিক ঘটনাও বটে। বরং এর রাজনৈতিক দিকটিই বেশি তাৎপর্যপূর্ণ।
হত্যাকাণ্ডের বিচার করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। তবে দেশের রাজনীতিকরাও তাদের নৈতিক দায়িত্ব এড়াতে পারেন না। এ হত্যাকাণ্ডের পেছনের ষড়যন্ত্রে কারা জড়িত ছিল, সে ব্যাপারে রাজনীতিকদের উচিত ছিল ব্যাপক অনুসন্ধান করা এবং সত্য খুঁজে বের করা। এটা করা উচিত ছিল বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থেই। সেই কাজটি তাদের রাজনৈতিক সহকর্মী ও সহযোগীরা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। বাংলাদেশের রাজনীতিকদের এ জন্য ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। গত কয়েক বছর যাবৎ লক্ষ্য করছি, মিডিয়ার চাপে অক্টোবর-নভেম্বর মাসে জেলহত্যার বিচার নিয়ে সরকারের দিক থেকে কথাবার্তা শোনা যায়। ৩ নভেম্বর পার হওয়ার পরই আবার নীরবতা। এ প্রবণতাটি ক্ষমাহীন রাষ্ট্রীয় অবহেলার উদাহরণ।
জেলহত্যা নিয়ে সবচেয়ে বেদনাদায়ক ব্যাপার যা তা হল, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকদের দিক থেকে বিষয়টি যথাযথ গুরুত্ব না পাওয়া। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি একটি ট্রাজেডি শুধু নয়, অত্যন্ত বড় রাজনৈতিক অপঘটনা। ৭ নভেম্বর পরবর্তী সরকার এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচারের ব্যবস্থা না করে এক ক্ষমাহীন অপরাধ করেছে। মতাদর্শগত দিক থেকে জিয়াউর রহমানের সেনা সরকার ছিল এই চার নেতার বিপরীত বলয়ের। তা সত্ত্বেও সামান্য সদিচ্ছা থাকলে বিচারের ব্যবস্থা তারা করতে পারতেন এবং তাতে যে তারা রাজনৈতিকভাবে খুব ক্ষতিগ্রস্ত হতেন, তা মনে হয় না। কিন্তু এক অজ্ঞাত ভয় ও মানসিক দীনতা থেকে তারা ওই বিচারের ব্যবস্থা করেননি।
বাংলাদেশ থেকে যে একদিন আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার উঠে যাবে, তার সূচনা হয় জেলহত্যা মামলা থেকেই। ১৯৭৫-৭৬ সালেই যদি প্রচলিত আদালতে জেলহত্যার বিচার হতো, তাহলে বাংলাদেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ কণ্টকিত হতো না। যে দেশে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনের নির্মম হত্যার বিচার নিয়ে রাষ্ট্র গড়িমসি করে, সুষ্ঠু বিচারের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, নষ্ট করে ফেলে আলামত, সে দেশের সাধারণ নাগরিক যে ন্যায়বিচার পাবে না, তা একজন নির্বোধও বোঝে।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান শুধু বড় মাপের রাজনৈতিক নেতাই ছিলেন না, সামাজিক ও ব্যক্তি জীবনেও তারা ছিলেন অসাধারণ ও চমৎকার মানুষ। তাদের হত্যার বিচার না হওয়ার ব্যথা শুধু তাদের পরিবার-পরিজন ও প্রিয়জনদের ব্যথা নয়, আমরা যারা তাদের সান্নিধ্যে এসেছিলাম, তাদের স্নে পেয়ে ধন্য হয়েছিলাম, তাদেরও ব্যথা। দেরি যা হওয়ার তা হয়েছে, হত্যাকারীদের নিয়োগদাতাদের হয়তো আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দাবি একটাই- চার জাতীয় নেতার হত্যাকারীদের যেন উপযুক্ত শাস্তি হয়।
সৈয়দ আবুল মকসুদ : লেখক ও গবেষক

No comments

Powered by Blogger.