সমতার লড়াই

সম্মেলনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি রুবানা হক
সমাজের বিভিন্ন উন্নয়নে অবদান রাখা বিশ্বের ১০০ জন নারীর উপস্থিতিতে ২৫ অক্টোবর বিবিসি আয়োজন করেছিল একটি সম্মেলন। নাম: ১০০ নারী সম্মেলন। আমাদের দেশ থেকেও উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ে সফলতার স্বাক্ষর রাখা মোহাম্মদী গ্রুপের রুবানা হক অংশ নিয়েছিলেন। গত শতাব্দী থেকেই নারীরা তাঁদের অসাধারণ সব অর্জনের মাধ্যমে অনেকখানি এগিয়ে গেছেন। তবু সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনীতির ক্ষেত্রে অবদানের জন্য যে শক্ত পদক্ষেপ নারীকে নিতে হচ্ছে, সেখানে জেন্ডার-বৈষম্যের কারণেই পুরুষদের তুলনায় তাঁদের প্রতিবন্ধকতা বেশি মোকাবিলা করতে হচ্ছে। যেসব বিষয় আলোচনায় এসেছিল তার মধ্যে— শিক্ষায় মেয়েশিশুর ঝরে পড়া ও বাল্যবিবাহ কি উন্নয়নের অন্তরায়?
রাজনীতি ও ব্যবসায়ে নারী কি আরও বেশি ভূমিকা রাখবেন?
মাতৃত্ব ও পারিবারিক বন্ধনই কি নারীর অগ্রযাত্রায় বাধা?
নারীবাদের ভূমিকার কি এখনো প্রয়োজন আছে?
ধর্ম কি নারীর ক্ষমতায়নের পথে প্রতিবন্ধক?
নারীর ঝুঁকি ও সম্ভাবনা, যৌন সন্ত্রাস, একক মাতৃত্ব নারীকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে গণমাধ্যমের ভূমিকা ইত্যাদি। নিজ নিজ বিশেষায়িত অবস্থান থেকে সবাই অভিজ্ঞতা বিনিময়সহ তাঁদের দাবি ও প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করলেন। সিয়েরা লিওনের জায়নাব বাঙ্গুরার উত্থাপিত বিষয়টি আমাদের দেশের সামাজিক অবস্থাকেও সমানভাবে ইঙ্গিত করে। তিনি বললেন, তাঁর বয়স যখন ১২ বছর, তখন তাঁর বাবা তাঁকে বিয়ে দিতে চান। তাঁর মা এর প্রতিবাদ করলে বাবা তাঁকে বাড়ি থেকে বের করে দেন সারা জীবনের মতো। জায়নাবের গ্রামের মেয়েদের স্কুলে যাওয়ার অধিকার ছিল না। বাল্যবিবাহ সে দেশের মেয়েদেরও নিয়তি। আমাদের দেশেও এর ব্যত্যয় নেই। মেয়েশিশু শিক্ষার হার বাড়লেও মেয়েদের উচ্চশিক্ষার হার সে অনুপাতে বাড়েনি। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সালে মেয়েশিশু শিক্ষার (অনূর্ধ্ব-৭ বছর) হার ছিল শতকরা ৫৪ দশমিক ৮ ও ছেলেশিশুর ৬১ দশমিক ১২। এটা আবার গ্রাম ও শহরের হারে বিশাল ফারাক। ২০০১ সালের তথ্য অনুযায়ী, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মোট শিক্ষার্থীর ২৪ দশমিক ৩ ভাগ মেয়ে ও ৭৫ দশমিক ৭ ভাগ ছেলে। তো বুঝতে অসুবিধা হয় না যে, আমাদের মেয়েশিশুদের উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত উত্তরণে পদে পদে অনেক বাধা। জায়নাব বলছিলেন, তাঁদের গ্রামের মেয়েশিশুরা স্কুলে যাওয়ার পথে আক্রমণের শিকার হয়। আমাদের দেশে ইদানীং ইভ টিজিং বেড়ে যাওয়ার কারণে অভিভাবকেরা মেয়েদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে বাল্যবিবাহ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। সেদিন আমাদের একটি টিভি চ্যানেলেও উত্তরাঞ্চলের কিছু মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মেয়েদের সঙ্গে কথোপকথন প্রচার করা হচ্ছিল, যেখানে ১৬ বছরের কম বয়সী ছাত্রীদের অনেকেরই বিয়ে হয়ে গেছে। কেন? মেয়েরা বলছিল, বিয়ে হয়ে গেলে স্কুলে আসা-যাওয়ার পথে ছেলেরা আর উত্ত্যক্ত করে না, তাই। কিন্তু তাদের কেউই এ বয়সে বিয়ে হোক, তা চায়নি। তারা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে আগ্রহী। তারা আরও বলছিল, তাদের লেখাপড়ায় বেশি দূর এগোনোর সুযোগ নেই। কারণ, তাদের শ্বশুরবাড়ির কেউ চান না, ঘরসংসার বাদ দিয়ে তারা লেখাপড়া করুক। এ মেয়েগুলোর মুখে ছিল না কোনো উচ্ছ্বাসের ঝলক, ছিল না কিশোরীর চপলতা। আনন্দহীনতা আর অনিশ্চয়তার কালো ছায়ায় ভরা ছিল তাদের নির্লিপ্ত চোখ। ইউএনএফপিএর এক তথ্য অনুযায়ী, ‘বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ রোধে নানা ধরনের উদ্যোগ থাকলেও এখনো গড়ে শতকরা ৬৬ ভাগ নারীকে ১৮ বছরের আগেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হচ্ছে’। ইউএনএফপিএর বাংলাদেশ প্রতিনিধি আর্থার আরকেন বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বাল্যবিবাহের হার সবচেয়ে বেশি। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সম্পত্তিতে অনগ্রাধিকার, পরের ঘরে যাওয়ার নিয়তি, অনিরাপত্তা, অধস্তনতা, পুরুষের সঙ্গে অসমকক্ষতা ইত্যাদি বাল্যবিবাহের পূর্বশর্ত হিসেবে মেয়েদের উচ্চশিক্ষার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। জায়নাব বাঙ্গুরা বলছিলেন, একজন নারী সত্যিকার শিক্ষিত হলে প্রথমে তিনি তাঁর পরিবারকে রক্ষা করবেন এবং তারপর রাজনীতিতে এলে দেশকেও রক্ষা করতে পারবেন। জায়নাব আরও বলছিলেন, তাঁর মা লিখতে ও পড়তে জানেন না। কিন্তু তিনি বলেন, শিক্ষা হচ্ছে সোনার চাবি, যা দিয়ে পৃথিবীর সব সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেওয়া যায়।
 উম্মে মুসলিমা: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.