কঠিন বাস্তবতায় নির্বাচন কমিশন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় ১৮ দলের জোটের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ফোনালাপের পরের দিন অর্থাৎ ২৭ অক্টোবর থেকেই বর্তমান উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যেই শুরু হয়েছে সংবিধানের ১২৩ (৩) (ক) অনুযায়ী নির্বাচনের পূর্ব সময়। মানে সংসদ ভেঙে যাওয়ার পূর্ব ৯০ দিন। উল্লেখ্য, সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর এবং বর্তমান সংসদ কার্যকর মেয়াদের শেষ তারিখ ২৪ জানুয়ারি, ২০১৪। কাজেই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান ও নির্বাচন পরিচালনার জন্য সাংবিধানিকভাবে গঠিত নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই এই ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্পন্ন করতে হবে।
এটাই নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজ। আরও যে তিনটি সাংবিধানিক দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া আছে, সেগুলোও জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি এবং জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। নির্বাচন কমিশনকে সংবিধানে প্রদত্ত ৯০ দিনের মধ্য শুধু নির্বাচনই নয়, বরং নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং সবার অংশগ্রহণে, বিশেষ করে সংসদের বিরোধী দলকে নিয়েই নির্বাচন করতে সব ধরনের প্রচেষ্টা নিতে হবে। প্রয়োজনে তফসিল ঘোষণার পর রদবদল করতে হলে তা-ও করতে হবে। ২০০৮ সালে এমনই করা হয়েছিল। মনোনয়ন-প্রক্রিয়া, বাছাইয়ের পর, শেষ হলে যদি কোনো প্রার্থী সংক্ষুব্ধ হয়ে থাকেন, তাঁকে আইনানুগভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে আপিল করার যৌক্তিক সময় দিতে হবে। শুধু প্রার্থীকে সময় প্রদানই নয়, ন্যায্য শুনানি দিয়ে কমিশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্যও প্রয়োজনে যথেষ্ট সময় রাখতে হবে। বর্তমান আইন অনুযায়ী শুধু বাতিলের বিরুদ্ধেই নয়, বরং মনোনয়ন বৈধ হলেও বিশেষ ক্ষেত্রে আপিলের সুযোগ রয়েছে। এসব শুনানির জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত সময় এবং ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন বাছাইয়ের সময় প্রাথমিকভাবে বাতিল হওয়া ৫৫৭ জনের মধ্যে ৩০৯ জন প্রার্থী আপিল করেছিলেন। ৮৯ জনের বৈধতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যাংক, সেবা প্রদানকারী সংস্থা ও অন্যান্য বিষয়ে আপিল হয়েছিল। সর্বমোট ৩৯৮টি আপিল গ্রহণ ও শুনানি করতে হয়েছিল। প্রায় প্রত্যেক প্রার্থীর বক্তব্য আইনজ্ঞদের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়েছিল। কাজেই এসব আপিল শুনানির জন্য পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন। এর পরে রয়েছে প্রত্যাহারের সময় এবং বৈধ প্রার্থীদের প্রচারণার সময়। সব মিলিয়ে তফসিল ঘোষণার যৌক্তিক সময় ভোট গ্রহণের ধার্যকৃত দিনের আগে ৪৫ থেকে ৫০ দিন। এই পূর্ণ সময় এবং ফলাফল সরকারি গেজেট প্রকাশের দিন পর্যন্ত ‘নির্বাচনকালীন’ বলে আখ্যায়িত। উল্লেখ্য, নির্বাচনকালীন ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়ের’ একটি অংশ। ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২ (আরপিও ১৯৭২)-এর অধীন বিদ্যমান আচরণ বিধিমালায়, ‘সাধারণ নির্বাচনের ক্ষেত্রে, সংসদের মেয়াদ উত্তীর্ণ কিংবা সংসদ ভাঙিয়া যাওয়ার পর হইতে পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল’ এবং ‘উপনির্বাচনের ক্ষেত্রে সংসদের কোনো আসন শূন্য ঘোষণা হইবার পর হইতে উক্ত আসনের জন্য অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রকাশের তারিখ পর্যন্ত সময়কাল’ সংজ্ঞায়িত রয়েছে। বিদ্যমান বিধিমালার ৯০ দিনের পূর্ব সময় সংবিধানের আলোকেই নির্ণীত। তবে পঞ্চদশ সংশোধনীর পর যেহেতু সংসদ বহাল অবস্থাতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, সেহেতু ‘সংসদ ভাঙিয়া যাইবার পরবর্তী’-এর বদলে ‘পূর্ববর্তী’ হিসেবে ১২(৩) (ক)তে উদ্ধৃত এবং সংবিধানের ধারা ১২৩(খ)তে এখনো ‘পরবর্তী’ বিদ্যমান রয়েছে।
কাজেই সংবিধানের উদ্ধৃত ধারার আলোকে ৯০ দিনের পূর্ববর্তী সময়ে নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত করার কথা। এক কথায়, বর্তমানের সংশোধিত সংবিধানের আলোকে ২৭ অক্টোবর থেকে আগামী বছরের ২৪ জানুয়ারি পর্যন্ত অথবা এরই মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে গেজেটে ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত এ সময় নির্বাচন-পূর্ব সময় বলে আখ্যায়িত হবে। ওপরের আলোচনা থেকে প্রতীয়মান হয়, এই সময়ে যে সরকার বিদ্যমান থাকবে, তাকে যে নামেই অভিহিত করা হোক, মূলত আর চরিত্র হবে নির্বাচনকালীন সরকারের। তবে এ বিষয়ে সংবিধানের সরল পাঠে তেমন কোনো উল্লেখ নেই বিধায় বিদ্যমান সরকারকেই সেই চরিত্রে রূপান্তরিত হওয়াই সংবিধানের ধারা ১২৩-এর আলোকে যৌক্তিক। আমি মনে করি, এই সময়ের মধ্যেই সংবিধানের ধারা ১২৬ অধিকতর প্রযোজ্য। নির্বাচন-পূর্ব সময়ে নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা। তেমনি ধারা ১২৬-এর আওতায় সরকারের সহযোগিতায় নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের ও তফসিল ঘোষণার পরিবেশ তৈরি করবে। গণতান্ত্রিক রীতিতে পরিচালিত নির্বাচনকালীন সরকারের প্রাথমিক দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে এবং সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করার পরিবেশ সৃষ্টিতে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে পরামর্শ ও চাহিদাক্রমে সর্বতো সহযোগিতা প্রদান করা।
নির্বাচনকালীন সরকার দৈনন্দিন কার্য সম্পাদন করা ছাড়া অন্য এমন কোনো কার্য সম্পাদন করবে না, যা নির্বাচনকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করতে পারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে আচরণবিধির আইনগত ভিত্তি না থাকা সত্ত্বেও সর্বতোভাবে প্রয়োগ করা হয়। এমনকি মন্ত্রিপরিষদের রুটিন সিদ্ধান্তও নির্বাচন কমিশনের পরামর্শ ছাড়া সম্পাদন করা হয় না। বাংলাদেশের সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনীর পরেও সরকারের কাঠামো ও কার্যপরিধি এমনি হওয়ার কথা। অথচ এখন পর্যন্ত সরকারের কার্যক্রমে নির্বাচনকালীন সরকারের আদল দেখা যাচ্ছে না, যদিও প্রধানমন্ত্রীর প্রাথমিক মতামত তেমনটিই ছিল। প্রধানমন্ত্রী একপর্যায়ে ২৪ অক্টোবরের পর সংসদের কার্যক্রম রদ করে নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে মত পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। মত পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে এক ঘোষণা মোতাবেক আগামী ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর সরকারের কার্যপরিধিতে এবং সরকারের আয়তনে কোনো পরিবর্তন এখন পর্যন্ত সূচিত হয়নি। যাই হোক, নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশ যেমন হওয়ার কথা, বাস্তব চিত্রটি তেমন নয়। বাস্তব চিত্রে দেখা যাচ্ছে, তফসিল অথবা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার বিষয়টি নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত করা হয়েছে এবং এমনই থাকবে বলে মনে হয়।
অন্যদিকে সরকারের কার্যক্রমেও কোনো পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। মাঠে-ময়দানে রাজনৈতিক সংঘাত বিদ্যমান। সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হবে কি না, সে বিষয়টির এখনো সুরাহা হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নির্বাচনের পরিবেশ তৈরিতে নির্বাচন কমিশন এখনো নিয়োগ করতে পারেনি বা নির্বাচন কমিশন সেই উদ্যোগও নেয়নি। সংশোধিত আচররণবিধির খসড়া হয়েছে মাত্র, চূড়ান্ত করতে আরও কয়েক দিন সময় লাগবে। অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনকে উপেক্ষা করেই আরপিওর সংশোধনী পাস হয়েছে সংসদে। আরপিও থেকে ১২(১) জে বাদ দেওয়ায় মনোনয়ন বাণিজ্য এবং অরাজনৈতিক ব্যক্তিদের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ বাড়বে। এ ধরনের বাস্তবতায় আগামী ২৪ জানুয়ারির মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে না পারলে কমিশন কর্তৃক সংবিধান লঙ্ঘিত হবে, অবশ্য যদি সংবিধানের ধারাগুলো অপরিবর্তিত থাকে। সার্বিক আলোচনা ও পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়, প্রথম থেকেই নির্বাচন কমিশন নানা ধরনের সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগার কারণে সে ধরনের প্রস্তুতির ঘাটতি তথ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এরই মধ্যে যোগ হয়েছে বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থার বাস্তবতা। নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের পরিস্থিতির সঠিক নিরূপণ করতে না পারায় আগাম প্রস্তুতি গ্রহণে ঘাটতি দৃশ্যমান। নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব সংবিধান মোতাবেক নির্বাচন পরিচালনা করা এবং এ দায়িত্ব পালনের জন্য যে ধরনের ক্ষমতা প্রয়োজন, তা সংবিধান প্রদত্ত।
তবে সব দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড যে তৈরি হবে না, তার কিছু আলামত হালের রাজনৈতিক পরিবেশেই প্রতীয়মান। তদুপরি রয়েছে সংসদ বহাল রেখে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার মতো অনভিজ্ঞতা। এসব কারণেই কমিশনের উচিত ছিল প্রায় ছয় মাস আগেই সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা, যার মধ্যে আরপিও সংশোধন, আচরণবিধি প্রণয়ন ও প্রচারণা সম্পন্ন করা এবং সব দল ও মতের সঙ্গে আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া। এ কথা অনস্বীকার্য, যে ধরনের রাজনৈতিক পরিবেশ বিদ্যমান, তার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশনের কাজ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি কমিশন তার এখতিয়ার কায়েম করতে পারছে না। এমতাবস্থায় নির্বাচন কমিশন এসব বিষয়ে রাষ্ট্রপতির পরামর্শ গ্রহণ করতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি এবং কঠিন বাস্তবতার আলোকে সব দলের অংশগ্রহণের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার বাধাবিপত্তিগুলো রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে সাহায্য-সহযোগিতা কামনা করতে পারে। এমন করাটা সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনের নৈতিক দায়িত্বের পরিপন্থী হবে না। এই সময়ে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন ব্যাখ্যার মধ্যে না গিয়ে উচিত হবে নির্বাচন-পূর্ববর্তী সময়ে নিজের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে সবার জন্য নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করা। অন্যথায় সুষ্ঠু, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ এবং সবার কাছে গ্রহণযেগ্য নির্বাচন না করতে পারার দায়িত্ব এককভাবে নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে। কঠিন বাস্তবতার আলোকে দায়িত্ব সংকুচিত করা নয়, বরং সুচারুভাবে পরিপালন করাই নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব।
 এম সাখাওয়াত হোসেন: সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও কলাম লেখক।
hhintlbd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.