আদুরী আজ বাড়ি ফিরবে by মোশাররফ হোসেন মুসা

সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে আজ বাড়ি ফিরছে আদুরী। ৯-১০ বছরের কিশোরী গৃহকর্মী আদুরীকে বর্বরভাবে নির্যাতন করে বারিধারা-ডিওএইচএস এলাকায় একটি ডাস্টবিনে ফেলে রাখা হয়। ২৩ সেপ্টেম্বর এলাকার কিছু হৃদয়বান ব্যক্তি কংকালসার মেয়েটিকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে দেন। ঘটনাটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি হয়। পরে নির্যাতনের অপরাধে গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২২ ধারায় মহানগর আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট মোঃ নূরু মিয়ার কাছে যে জবানবন্দি দেন, তা শুনে অনেকেই শিউরে উঠেছেন। তিনি তার জবানবন্দিতে কিভাবে আদুরীকে গরম খুন্তি ও ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিতেন এবং সামান্য অপরাধে কিভাবে লাঠিপেটা করতেন তার বর্ণনা দেন। আদুরী তার জবানবন্দিতে বলেছে- ‘ক্রীতদাসীর মতো জীবন ছিল তার। কারণে-অকারণে হাতে দিত ইস্ত্রির ছ্যাঁকা। মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে ব্লেড দিয়ে নির্মমভাবে ছিঁড়ে দেয়া হতো। এর সঙ্গে ছিল লাঠি দিয়ে পিটুনি। রাতে শুকনো মুড়ি জুটত আদুরীর ভাগ্যে। ঘুমানোর অনেক জায়গা থাকলেও তার ঠাঁই হতো বেলকুনিতে।
৩ অক্টোবর ‘যুগান্তর’ পত্রিকায় সাবেক কূটনীতিক ও কলাম লেখক মহিউদ্দিন আহমদ ‘শিশু গৃহদাসী আদুরী ও নিলুফাদের ঠিকানা ঢাকা মহানগরীর ডাস্টবিন’ শিরোনামে এক মর্মস্পর্শী কলাম লিখেছেন। তিনি তার কলামে নিলুফা নামের আরও এক গৃহকর্মী নিষ্ঠুর নির্যাতনে কিভাবে মারা গিয়েছিল তা তুলে ধরেন। তিনি নিলুফার মাকে কিছু টাকা দেয়ার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন, সে ঘটনাও উল্লেখ করেন (আমার জানা মতে, গৃহকর্মীদের নির্যাতনের ওপর তার একটি গবেষণা রয়েছে)। তিনি তার কলামে এসব গৃহকর্মীর বিপদে সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের ও সুশীল সমাজের লোকদের এগিয়ে না আসার জন্য তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি যাদের সমালোচনা করেছেন, তারা সবাই জাতীয় পর্যায়ের লেখক, বুদ্ধিজীবী ও চাকরিজীবী। তারা সর্বক্ষণ ‘জাতীয়’ সমস্যা নিয়ে ভাবেন এবং সেই আলোকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। গৃহকর্মী নির্যাতনের মতো ‘ক্ষুদ্র’ বিষয়ে তাদের চিন্তা করার সময় কোথায়! তাদের ৪২ বছরের লেখালেখিতে জাতীয় পর্যায়ে কতটুকু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, সে প্রশ্ন করা যায়।
২.
বর্তমানে অস্ট্রেলিয়া, জাপান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপীয় দেশগুলো যদি বাংলাদেশ থেকে গৃহপরিচারিকা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে এবং একই সঙ্গে আরব দেশগুলোও গৃহপরিচারিকা নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে নিশ্চয়ই বাংলাদেশী মেয়েরা প্রথম বিশ্বের দেশগুলোকে পছন্দ করবে আগে। কারণ আরব দেশগুলোয় গৃহপরিচারিকাদের নির্যাতনসহ গৃহকর্তার লালসার শিকার হওয়ার ঘটনাগুলো তাদের জানা রয়েছে। অর্থাৎ একটি দেশে মানুষের প্রতি মমত্ববোধ ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকা বা না থাকার পেছনে থাকে গণতান্ত্রিক শাসনের ধারাবাহিকতা থাকা বা না থাকার বিষয়টি। আমাদের প্রিয় দেশটি আরব দেশগুলোর মতো কর্তৃত্ববাদী শাসন দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে না, এখানে রয়েছে গণতান্ত্রিক শাসনের জন্য লিখিত সংবিধান। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশেও মাঝে মধ্যে আরব দেশগুলোর মতো গৃহপরিচারিকা নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। লক্ষণীয়, এদেশে এ ধরনের ঘটনা ঘটলে আমাদের লেখক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের লোকেরা নানা রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। কেউই গণতান্ত্রিক শাসন বিনির্মাণের জন্য দেশোপযোগী কার্যপদ্ধতি প্রতিস্থাপনের কথা বলেন না। সেই সঙ্গে সুস্থ নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য স্থানীয় সরকারের যে ব্যাপক ভূমিকা থাকে- এ কথাও কেউ বলেন না। সম্প্রতি গৃহকর্মী আদুরী নির্যাতনের ঘটনায় সেরকম প্রতিক্রিয়াই দেখা গেল।
৩.
মহামতি অ্যারিস্টটল বলেছেন, ‘সব ভালো মানুষ ভালো নাগরিক নয়, কিন্তু সব ভালো নাগরিকই ভালো মানুষ’ (উদ্ধৃতিটি নবম-দশম শ্রেণীর পৌরনীতি বই থেকে নেয়া)। তার কথার সূত্র ধরে বলা যায়, যারা আদুরীকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন, তারাই ভালো নাগরিক। তবে অ্যারিস্টটলের আমলে নগররাষ্ট্র ছিল ক্ষুুদ্র প্রকৃতির। বর্তমানে রাষ্ট্রের বিস্তৃতি ঘটে জাতিরাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। রাষ্ট্র শুধু স্থানীয় কাজই দেখে না, তাকে জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজও দেখতে হয়। বাংলাদেশে কার্যত কোনো স্থানীয় সরকার নেই। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সব কাজই কেন্দ্রীয় সরকার করে থাকে। নগর এলাকায় স্থানীয় সরকার না থাকায় এনজিও ও সুশীল সমাজের লোকরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ছোটখাটো স্থানীয় অপরাধ ও পারিবারিক কলহগুলো মীমাংসা করে থাকেন। উদাহরণস্বরূপ, মিরপুর রূপনগর আবাসিক এলাকায় ‘জাগো নারী ফাউন্ডেশন’-এর কিছু কাজ উল্লেখ করা যেতে পারে। নারীনেত্রী নূরুন্নাহার মেরীর নেতৃত্বে সংগঠনটি গার্মেন্ট শ্রমিকদের পারিবারিক কলহের মীমাংসা ও গৃহপরিচারিকাদের সমস্যার সমাধান করছে। সে জন্য আমাদের বিবেচনায় এদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য, আয়তন ও লোকসংখ্যার আলোকে দুই ধরনের সরকার থাকতে পারে- কেন্দ্রীয় সরকার ও স্থানীয় সরকার। কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য জাতীয় ও বৈশ্বিক কাজগুলো নির্দিষ্ট থাকবে। আর বাকি সব স্থানীয় কাজ স্থানীয় সরকারগুলো বাস্তবায়ন করবে। তার আগে স্থানীয় সরকারগুলোকে সমন্বিত স্তরবিন্যাস করে প্রতিটি স্থানীয় ইউনিটে ‘সরকার কাঠামো’ প্রতিস্থাপন করে স্বশাসন দিয়ে দিতে হবে (যেমন- ইউনিয়ন সরকার, জেলা সরকার, নগর সরকার ইত্যাদি)।
সংক্ষেপে প্রস্তাবিত নগর সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরা যেতে পারে। নগর প্রশাসন, নগর সংসদ ও নগর আদালত মিলে ‘নগর সরকার’ গঠিত হবে। মেয়রের নেতৃত্বে নগর প্রশাসন পরিচালিত হবে। কাউন্সিলররা নগর সংসদের সদস্য হবেন। নগর সংসদে নগরের সব সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। নগর সংসদে পাসকৃত প্রস্তাবগুলো নগর প্রশাসন বাস্তবায়ন করবে। আলাদাভাবে নিযুক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা ‘নগর আদালত’ গঠিত হবে। নগরকেন্দ্রিক অপরাধগুলোর বিচার নগর আদালতে সম্পন্ন হবে। যেমন- গৃহপরিচারিকাদের নির্যাতন, ফুটপাত দখল, পার্ক দখল, নদী-খাল দখল ইত্যাদির বিচার নগর আদালতে সম্পন্ন হবে। তাছাড়া নগর সরকারের তিন বিভাগের বাইরে একজন নগর ন্যায়পাল (শেরিফ) থাকবেন। নগর ন্যায়পাল নগর সরকারের তিন বিভাগের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ নিষ্পত্তি করবেন। এ ব্যবস্থা গৃহীত হলে নগরের অধিবাসীরাই প্রত্যক্ষভাবে নগর সরকার পরিচালনার সুযোগ পাবেন। তখন নগরের সমস্যাবলী দূর করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে দায়ী করার কোনো সুযোগ থাকবে না। সেই সঙ্গে নগরের অধিবাসীরা প্রকৃত নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হবেন। আদুরীর মতো নির্যাতনের ঘটনার যথাযথ বিচারও নিশ্চিত হবে।
মোশাররফ হোসেন মুসা : গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ক গবেষক

No comments

Powered by Blogger.