সময়ের অ্যালবাম থেকে কয়েকটি ছবি

চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি গঠিত হয়েছে সম্প্রতি। কমিটির ঘোষণা এসেছে কেন্দ্র থেকে। স্থানীয় নেতাদের প্রতি কতটা অনাস্থা ও অবিশ্বাস-সন্দেহের জন্ম হলে কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষিত হয়, তা সহজে অনুমেয়। ধারণা করা হয়েছিল, কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষণা করা হলে তা গ্রহণযোগ্য হবে সবার কাছে, যথাযথ মূল্যায়ন হবে ত্যাগী ও যোগ্য ছাত্র-কর্মীদের। কিন্তু এই প্রক্রিয়াও যে শেষ পর্যন্ত সবাইকে খুশি করতে পারেনি, তার প্রমাণ কমিটি ঘোষণার পর ছাত্রলীগের একাংশের প্রতিক্রিয়া। এই ক্ষুব্ধ অংশটি কমিটি ঘোষণার পর প্রতিবাদ জানিয়ে মিছিল করেছে, সমাবেশ করেছে। এটি তারা করতেই পারে। কিন্তু যেকোনো ক্ষোভ-দুঃখ-অপ্রাপ্তি-বঞ্চনার দায় সাধারণ নগরবাসীকে কেন বহন করতে হবে, এ প্রশ্নের কোনো জবাব মেলে না। ছাত্রলীগের কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিত ছাত্রনেতা ও তাঁদের সমর্থকেরা অর্ধশতাধিক গাড়ি ভাঙচুর করেছেন, ভীতি-আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছেন নগরজুড়ে। বিএনপিসহ ১৮ দলের ৬০ ঘণ্টার সহিংস হরতালে অবরুদ্ধ থাকার পর নগরবাসী যেদিন প্রথম পথে বেরিয়েছিল অফিস-আদালত-স্কুল-কলেজের নিয়মিত কাজে যোগ দিতে, এমনকি বাজার-সওদা করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আয়োজন করতে, সেদিনই হঠাৎ তাদের ওপর নেমে এল এই ‘খাঁড়ার ঘা’। একদিকে চলেছে গাড়ি ভাঙচুরের মহোৎসব, অন্যদিকে স্কুলগামী শিশুটিকে নিয়ে মায়ের আতঙ্কিত ছোটাছুটি, হাসপাতালগামী রোগীর চিকিৎসার বিষয়টি স্থগিত রেখে আপাতত নিকটে দাঁড়ানো সাক্ষাৎ মৃত্যু থেকে নিজেকে রক্ষা করার অসহায় প্রয়াস। হরতাল ডেকে মানুষের জানমালের ক্ষতি সাধন করার জন্য বিরোধী দলকে অবিরাম সমালোচনা করে যাচ্ছেন সরকারি দলের নেতা-নেত্রীরা। কিন্তু নিজেদের দলের ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীরাই যখন এ রকম ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত, সে বিষয়ে তাঁদের বক্তব্য কী, তা খুব জানতে ইচ্ছে করে।
কারণ, এক পক্ষকাল অতিক্রান্ত হলেও এ নিয়ে কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, এর জন্য নিন্দা প্রকাশ করতেও দেখা যায়নি সরকারি দলের কোনো নেতা-নেত্রীর। পদবঞ্চিত ছাত্রলীগের কর্মী-সমর্থকদের দাবি, উৎকোচের বিনিময়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়েছে। এই দাবিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না এই কারণে যে এর আগে কেন্দ্র থেকে ঘোষিত যুবলীগের কমিটিতে এমন দু-একজন যুবকের নামও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে, চট্টগ্রাম শহরে যাঁদের পরিচিতি সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজ হিসেবে। কিন্তু পদবঞ্চিত হলেই নিরীহ পথচারীর ওপর, কিছু যানবাহনের ওপর হামলা চালিয়ে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে হবে—এমন অদ্ভুত আচরণ কিছুতেই মেনে নেওয়া যায় না। কিছুদিন আগে একই ঘটনা ঘটিয়েছেন ছাত্রদলের কর্মীরা। একইভাবে স্থানীয় বিএনপির দ্বিধাবিভক্ত নেতাদের ওপর আস্থাহীনতার কারণে কেন্দ্র থেকে কমিটি ঘোষিত হয়েছিল ছাত্রদলের। সেখানেও পদবঞ্চিতরা নিজেদের কার্যালয়ে আগুন দিয়ে ও গাড়ি ভাঙচুর করে ভীতি-আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিলেন নগরজুড়ে। হরতাল ঘোষণা হলে তা ‘সফল’ করতে আগের দিন গাড়ি ভাঙচুর হবে, অগ্নিসংযোগ হবে—এসব এখন স্বাভাবিক নিয়মে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ মানুষ হয়তো নিয়তি বলেই মেনে নিয়েছে এটাকে। নতুন উপসর্গ হিসেবে যুক্ত হয়েছে কমিটি ঘোষণা। হরতাল ঘোষণা করা হলে সাধারণ মানুষ নিজেদের মতো করে সতর্কতা অবলম্বন করে। কিন্তু দলের কমিটি ঘোষণা করা হলে সেই প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগও থাকে না তাদের হাতে। অতএব, আমরা কি এখন দাবি করতে পারি, ছাত্রলীগ বা ছাত্রদলের কমিটি গঠনের দিন-তারিখও জানিয়ে দিতে হবে আগেভাগে, যাতে পদবঞ্চিতদের হামলা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্কতা অবলম্বনের সময়-সুযোগ থাকে? সরকারি ও বিরোধী দলের রাজপথের কর্মীদের মধ্যে একটি অলিখিত সমঝোতা আছে বলে মনে হয়।
রাজপথে তাণ্ডব চালানোর ব্যাপারে উভয়েরই সমান আগ্রহ ও অধিকার। ‘তুমি ভাঙো, আমিও ভাঙি’। ‘তাল’ আছে ‘হর’ নেই হরতালের দিনগুলোতে প্রায় প্রতিদিনই বিএনপির কাজীর দেউড়ির কার্যালয়ের সামনে সভা-সমাবেশ হয়ে থাকে। বিভিন্ন এলাকা থেকে মিছিল এসে জড়ো হয় এখানকার দলীয় কার্যালয়ের সামনের রাস্তায়। পুলিশ এই রাস্তার দুদিক থেকে চলাচল বন্ধ করে বিএনপির সভা-সমাবেশ নির্বিঘ্ন করার ব্যবস্থা নিয়ে থাকে। সভা-সমাবেশ শেষে মিছিল নিয়ে অল্প কিছু দূর ঘুরে আসেন নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা। এতেও সামনে-পেছনে পুলিশের উপস্থিতি থাকে, যাতে আওয়ামী লীগ বা তাদের অঙ্গসংগঠনের সঙ্গে কোনো ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা না ঘটে। কিন্তু পুলিশ দুই দলের সংঘর্ষ ঠেকাতে পারে বটে, অন্তঃকোন্দল ঠেকাতে পারে না। কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে, বিএনপির কার্যালয়ের সামনে সভা-সমাবেশে নিজেদের মধ্যে নিয়মিত হাতাহাতি-মারামারির ঘটনা ঘটছে। নগর বিএনপির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সমর্থকেরা পরস্পরের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ছেন ছোটখাটো বাদ-বিসংবাদের সূত্রে। এমনও দেখা গেছে, ছাত্রদলের একাংশের মিছিল দলীয় কার্যালয়ের দিকে আসতে দেখে অপর অংশের নেতা-কর্মীরা ছোটাছুটি, হুড়োহুড়ি শুরু করেছেন। তাতে ভীতি-আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। সর্বশেষ ৬ নভেম্বর ছাত্রদল-যুবদলের দুই গ্রুপের মধ্যে এ রকম হাতাহাতির একপর্যায়ে যুবদলের এক নেতা প্রকাশ্যে পিস্তল বের করে তাক করেছেন প্রতিপক্ষের উদ্দেশে। অস্ত্রসহ সেই নেতার ছবিও ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। তবে সবচেয়ে হাস্যকর ঘটনাটি ঘটেছে ৩ নভেম্বর হরতালের সমর্থনে নগর বিএনপির মিছিলটিতে।
মিছিলের অগ্রভাগে থাকার জন্য হাতাহাতি-ধাক্কাধাক্কির একপর্যায়ে দেখা যায়, মিছিলের সামনে থাকা ব্যানারটি ছিঁড়ে দুই টুকরা হয়ে গেছে। আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, মীর মোহাম্মদ নাছির, শাহাদাত হোসেন, গোলাম আকবর খোন্দকার প্রমুখ নেতার হাতে থাকা ব্যানারের ছেঁড়া অংশটিতে লেখা ছিল ‘তাল সফল করুন’। ‘হর’ লেখা অপর অংশটি তখন অন্য গ্রুপের হাতে। ভয়ংকর খেলনা! সুরমা ও লাল মিয়াকে কোনো দিন খেলনা কিনে দিতে পারেননি তাদের মা-বাবা। তাই রাস্তায় কখনো বিত্তবান পরিবারের শিশুদের পরিত্যক্ত খেলনা কুড়িয়ে পেলে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যায় তারা। ৫ নভেম্বরও নগরের ঝাউতলা এলাকায় সে রকম একটি খেলার ‘বল’ খুঁজে পেয়ে সুরমা (৯) খুশিতে ডগমগ হয়ে চিৎকার করে মাকে ডেকে বলছিল, ‘মা বল পাইছি, বল পাইছি...।’ কিন্তু সেই আনন্দ স্থায়ী হয়নি তার। মুহূর্তের মধ্যে বলসদৃশ বস্তুটি বিস্ফোরিত হয়ে মায়ের চোখের সামনেই ঝলসে গেছে সুরমার শরীর। লাল মিয়া (১০) নামের কিশোরটিও সুরমার দিকে ছুটে এসেছিল দুর্লভ খেলনা পাওয়ার আনন্দ ভাগ করে নিতে। সুরমার মা মনোয়ারা বেগমের আহাজারিতে ভারী হয়ে আছে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রাঙ্গণ। লাল মিয়ার অচেতন দেহ কোলে তুলে নিয়ে নিথর দাঁড়িয়ে ছিলেন তার বাবা। অভিব্যক্তিহীন চেহারা। কার কাছে বিচার চাইবেন তিনি? ব্যতিক্রমী কোনো ঘটনা তো নয় এটি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নিয়মিতই ঘটছে। কখনো বা এই শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে এ ধরনের ককটেল। ২০০ টাকার বিনিময়ে এগুলো ছুড়ে মারার দায়িত্বও দেওয়া হচ্ছে তাদের হাতে। হায় শৈশব! বহুকাল আগে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য লিখেছিলেন, ‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাবো আমি/ নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ শিশুর জন্য কতটা বাসযোগ্য হলো বাংলাদেশ?
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.