ক্ষমতার চেয়ে জনগণ বড় by ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু

জন ডান নামক এক ইংরেজ কবির একটি কবিতা রয়েছে ‘Go and Catch a Falling Star’ শিরোনামে। কবিতাটি ১৫৯৫ থেকে ১৬০০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় প্রকাশিত হয়। সে কবিতায় কবি কিছু অসম্ভবের কথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, আকাশ থেকে খসে পড়া তারা ধরতে, ম্যানড্রেক গাছের শেকড় থেকে মানব সন্তান নিতে, অতীতকে ফিরিয়ে আনতে, শয়তানকে তাড়া করে তার ঘর খুঁজে বের করতে এবং মৎস্যকন্যার গান শুনতে। এগুলো সবই আসলে অসম্ভব। অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশ। কিন্তু আজ হঠাৎ এতদিন পর সেই কবিতার প্রসঙ্গ তোলার কারণ দেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক অবস্থা। আসন্ন সংসদ নির্বাচন নিয়ে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের নেতা-নেত্রীদের বক্তব্য ও ভাবভঙ্গি খুবই চিন্তার বিষয়। গণতন্ত্রের কথা মুখে বলেন সবাই, কিন্তু কর্মকাণ্ডে মনে হয় তারা স্বৈরতন্ত্রের ধারক। নির্বাচিত সংসদ সদস্য হয়েও এক দলের সংসদ সদস্যরা সংসদে যান না, আর অন্য দলের সদস্যরা সে সময় সংবিধান সংশোধন করেন নিজেদের মতো করে। নির্বাচন নিয়ে এই দড়ি টানাটানি দেখে মনে হয়, তাদের মনে একটাই চাওয়া, আর তা হচ্ছে যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকা বা ক্ষমতায় যাওয়া। অর্থাৎ এ যেন ‘বিচার যাই করো না কেন, তালগাছটা কিন্তু আমার।’ এ দেশের ১৬ কোটি মানুষ শুধুই তাদের হাতে খেলনা। নির্বাচন নিয়ে আলোচনায় বসা নিয়ে যে নাটক হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে, তা দেখে মনে হয়- বাঘে মহিষে শেষ পর্যন্ত এক ঘাটে জল খেলেও আমাদের দেশের দুই নেত্রী দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে একসঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে পারেন না। পারলে তাদের গাত্রদাহ হয়। এজন্যই জন ডানের ওই কবিতার কথা লেখা। জন ডানের সেই কবিতায় যেমন অনেক অসম্ভব সম্ভাবনার কথা আছে, আমাদের দুই নেত্রীর দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে আলোচনায় বসা তেমনই অসম্ভব। ক্ষমতার স্বার্থের কারণে দেশের বৃহত্তর স্বার্থ, জগণের স্বার্থ তারা দেখতে পান না।
বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ বলবেন, তারা জনগণের জন্য রাজনীতি করেন। দেশের প্রধান একটি রাজনৈতিক দল তো এ স্লোগান প্রায়ই প্রচার করে বেড়ায়- ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে দেশ বড়’। কিন্তু দেশের চেয়ে যে তাদের কাছে নিজেদের স্বার্থ বড় এবং দেশ ও জনগণের চেয়ে প্রকৃতপক্ষে সেটাই সবসময়ই বড় করে দেখা হয়, তা কিন্তু মোটেও প্রচার করা হয় না। এটা শুধু ওই রাজনৈতিক দলের ক্ষেত্রেই নয়; বরং অন্য প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনীতিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো কি সত্যিকার অর্থেই জনগণের জন্য, জনগণের স্বার্থের জন্য রাজনীতি করে? নিশ্চয় নয়। যদি তাই করত, তাহলে ওই সব রাজনৈতিক দলের হাতে এদেশের জনগণকে বারবার জিম্মি হতে হতো না, জনগণকে বারবার বলির পাঁঠা হতে হতো না।
গত ২৭, ২৮ ও ২৯ অক্টোবরের হরতাল শেষ হতে না হতেই আবারও ১০, ১১, ১২ ও ১৩ নভেম্বর হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, বাংলাদেশ হরতালের দেশ হতে চলেছে। বস্তুত হরতাল যেন এদেশের সংস্কৃতিতে নতুন এক মাত্রা হিসেবে যোগ হয়েছে। একটি সংস্থার জরিপে দেখা গেছে, এ দেশের শতকরা ৯৫ ভাগ লোকই হরতাল পছন্দ করেন না। তা সত্ত্বেও জনগণকে বারবার হরতালের কালো থাবার কবলে পড়তে হচ্ছে। হরতাল যেন এ দেশের জনগণের কাছে ভাগ্যদেবীর এক ‘আশীর্বাদ’। এটি বিভিন্ন সংগঠনের দাবি আদায়ের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগের একটি মাধ্যম এবং তা একটি গণতান্ত্রিক অধিকারও বটে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে হরতালের কারণে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থাসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের ওপর যে দীর্ঘস্থায়ী কুপ্রভাব পড়ছে, তা সামাল দেয়ার মতো ক্ষমতা আমাদের দেশের আছে কি? হরতালের কারণে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাব্যবস্থা, উন্নয়ন-অগ্রগতিসহ দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপর্যস্ত হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য। পাশাপাশি বহির্বিশ্বে দেশের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হচ্ছে, বিনিয়োগ কার্যক্রম নিরুদ্যম হয়ে পড়ছে। হরতালের কারণে এ দেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সমাজসহ সবাই এখন রীতিমতো বিষিয়ে উঠেছেন। হয়ে পড়েছেন উদ্বিগ্ন। হরতাল আহ্বানকারীরা এদেশের উন্নয়ন-অগ্রগতিসহ খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের কথা না ভেবেই বারবার হরতাল আহ্বান করছেন।
হরতালে দেশের সার্বিক শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা পড়ছেন সেশনজট নামক কালো থাবার কবলে, যা তাদের জীবনে বয়ে আনছে অপূরণীয় ক্ষতি। এটা সব গণতান্ত্রিক দেশেই স্বীকৃত যে, রাজনীতির অন্যতম প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষাসহ সবদিক থেকে এগিয়ে নেয়া। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর উল্টোটি হচ্ছে।
দেশে বারবার হরতালের কারণে বাধাগ্রস্ত হয় মানুষের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড। হরতাল পঙ্গু করেছে দেশের অর্থনীতি, ব্যবসা, শিক্ষাসহ সব ক্ষেত্রকে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে দেশের ব্যবসায়িক নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী মহল, সাধারণ মানুষ, সুশীল সমাজসহ সব রাজনৈতিক দলের দ্রুত সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ প্রয়োজন। প্রয়োজন দাবি আদায়ে হরতালের বিকল্প কোনো পন্থা খুঁজে বের করা। সবাই মিলে হরতালকে ‘না’ বলার ব্যাপারেও সমন্বিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি। এ ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দলের স্মরণ রাখা প্রয়োজন, যে দল হরতাল আহ্বান করে দেশে অস্থিশীলতা ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে, এর কুপ্রভাব পরবর্তী নির্বাচনে ওই দলের ওপর পড়ে। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এটাও বোঝা উচিত, জনগণ এখন আর বোকা নয়। তারা যে সুপ্ত আগ্নেয়গিরির মতো যে কোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটাতে সক্ষম, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ তারা ইতিমধ্যে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভালোভাবেই দেখাতে সক্ষম হয়েছেন। দেশ-জাতির বৃহত্তর স্বার্থে তথা আমাদের সবার প্রিয় এ দেশটির সার্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতির পথকে সুগম করতে সব দলেরই হরতাল পরিহার করা উচিত। এখন সময় এসেছে দেশকে এগিয়ে নেয়ার। হরতালের কারণে এ দেশটি সবদিক থেকে পিছিয়ে যাক, এমনটি কারও কাম্য হতে পারে না। দেশের এই ক্রান্তিকালে সরকারি দল, বিরোধী দলসহ সব রাজনৈতিক দলকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আগেই একসঙ্গে আলোচনায় বসে সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই।
ড. কুদরাত-ই-খুদা বাবু : বিভাগীয় প্রধান, আইন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস); অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সদস্য

No comments

Powered by Blogger.