অপরিকল্পিত নগরায়ণের দায়

সমাজে ঘটে চলছে একের পর এক দুর্ঘটনা। প্রতিটি সেকেন্ডে দেশের কোথাও না কোথাও চলছে কোনো না কোনো ছোট-বড় অপরাধ। খবরের কাগজ খুললেই খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই থেকে শুরু করে চোখের সামনে ধরা দেয় হাজার রকমের অপরাধের চিত্র। এসব অপরাধ আমাদের ঠেলে দিচ্ছে বড় কোনো সহিংসতার দিকে। ব্রিটিশ ক্রাইম সার্ভের (বিসিএস) তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর পৃথিবীতে প্রায় ১০ দশমিক ৭ মিলিয়ন অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। এর পেছনে অনেক কারণ থাকলেও একটি কারণকে কখনো আলোচনার সামনে সঠিকভাবে আনা হচ্ছে না, সেটি হচ্ছে নগরের অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, সঠিক নকশা প্রণয়ন ও সমন্বয়ের অভাব। সাধারণ পর্যবেক্ষণ থেকে দেখা যায়, অন্ধকারাচ্ছন্ন ও জনসমাগম কম—অপ্রশস্ত রাস্তা—যার সঙ্গে প্রধান কোনো সড়কের সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে, এমন জায়গাগুলোতে ছিনতাইসহ অন্যান্য অপরাধের প্রবণতা বেশি থাকে। যখন নগরের কোথাও একটি সুউচ্চ স্থাপনা তৈরি করা হয়, তখন স্থাপনার পেছনে-পাশে বিদ্যমান খালি জায়গার সঠিক নকশা ও সমন্বয়ের অভাবে তৈরি হতে পারে ‘নেগেটিভ স্পেস’, যা ভবিষ্যতে বিভিন্ন শ্রেণীর বয়সের মানুষের জন্য সামাজিক অপরাধ সংঘটনের নিরাপদ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
আমরা যখন কোনো বাড়ির নকশা প্রণয়ন করি, তখন সাধারণত বাড়ির সামনে অনেক অংশজুড়ে খোলা সবুজ জায়গা রেখে দিই। সেখানে অনেক ক্ষেত্রেই সুউচ্চ অধিক ডালপালাযুক্ত নানা গাছ রোপণ করা হয়। পরে সুরক্ষার জন্য ৭ থেকে ১০ ফুট উচ্চতার সীমানাপ্রাচীর তৈরি করা হয়। এ কারণে স্থাপনাটির সামনের ফুটপাতটি স্থাপনাটিতে বসবাসকারীরা দেখতে পারে না, তাই এ ধরনের ফুটপাতে যেকোনো ধরনের অপরাধ নিমেষেই যে কেউ করে নির্দ্বিধায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। এ ছাড়া ফুটপাতের পাশের ডাস্টবিনগুলোর বেশির ভাগই থাকে অপরিষ্কার এবং স্বভাবতই সেখানে জনসমাগম কম থাকে। তাই সন্ধ্যার পর অনেক ক্ষেত্রেই সেই স্থানটি হয়ে ওঠে অনিরাপদ। সংঘটিত হয় সামাজিক অপরাধ। প্রয়োজনের তুলনায় যদিও আমাদের সবুজ অরণ্যের পরিমাণ অনেক কম, তথাপি এই সবুজকে বুঝে-শুনে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে এটিই হতে পারে বিপদের কারণ। আজ থেকে ছয়-সাত বছর আগে আমাদের শহরের পার্কগুলোতে (ধানমন্ডি পার্ক) বসার জায়গাগুলোর ওপরের অংশে সিমেন্টের তৈরি রংবেরঙের ছাতা তৈরি করা হয়েছিল। নির্মাণগত ত্রুটি কিংবা ব্যবস্থাপনার অভাবে সেই ছাতাগুলো মাটিতে ভেঙে পড়লে,
সন্ধ্যার পরপরই সেই ছাতার ভাঙা ছাউনির অংশের নিচে চলত অপরাধমূলক কার্যকলাপ। বর্তমানে ফ্ল্যাটনির্ভর যান্ত্রিক জীবনে এককেন্দ্রিকতা এমনভাবে জায়গা বিস্তার করেছে যে একই ভবনের পাশাপাশি দুটি ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের মধ্যে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। এতে করে অপরাধের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। এ কারণেই প্রায়ই দেখা যায়, পাশের ফ্ল্যাটে বড় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলেও নকশা প্রণয়নে ত্রুটির জন্য কেউ জানতেই পারছে না যে দেয়ালের ওপাশে কী ঘটছে? সামাজিক গতিময়তার কথা চিন্তা না করে শুধু শহরকেন্দ্রিক আবাসন সমস্যার সমাধান কিংবা সৌন্দর্যবর্ধনের কথা চিন্তা করলে সেখানে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রবণতা বাড়বে, এটাই বাস্তবতা। যার কারণে, বিশেষ করে আমাদের যুবসমাজ খুব সহজেই যেকোনো অপরাধে লিপ্ত হতে পারে। সামাজিক গতিশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ফুটপাত, রাস্তা থেকে শুরু করে এমনকি পার্কের রাস্তায়ও নির্দিষ্ট দূরত্ব পর পর সামাজিক গতিশীলতা বাড়ায় এমন কোনো পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। যেমন, ছোট ছোট কফিশপ, গিফট কর্নার, বুক কর্নার ইত্যাদি। যে ছোট্ট শিশুটি ইট-পাথরের জঞ্জালে ভরা ঘরের বদ্ধ চার দেয়ালের মাঝে বেড়ে উঠছে, সবুজ বড় খেলার মাঠের অভাবে আমাদের সমাজে যাকে আজ আমরা সৃষ্টিশীল কোনো স্থানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছি না বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে, সেই ছেলেটিই একদিন খুঁজে নেবে বাড়ির পাশের কোনো অপরিকল্পিত অন্ধকার জায়গা, পরিত্যক্ত ছাদ কিংবা বাড়ির অনাদরে ফেলে রাখা ঝোপ-জঙ্গলে ভরা পেছনের অংশ, অরক্ষিত নদীর পাড় কিংবা পাশাপাশি দুটি ভবনের মধ্যবর্তী অপ্রশস্ত পরিকল্পনাহীন ফাঁকা স্থান,
যেখানে দিনের বেলায়ও সূর্যের আলো পৌঁছায় না। বিশ্ববিখ্যাত স্থপতি অস্কার নিউম্যান ‘ডিফেন্সিবল স্থান’কে সংজ্ঞায়িত করেছিলেন যেকোনো ধরনের হাউজিং প্রকল্পের ক্ষেত্রে। তাঁর মতে, বাসস্টপ, যাত্রীছাউনি, খোলা জায়গা, বসার বেঞ্চ, খেলার মাঠ, নগরের জলাভূমিসহ প্রতিটি অংশে অপরাধ সংঘটনের মাত্রা অনেকাংশে কমিয়ে আনা যায় শুধু পরিকল্পিত নকশা প্রণয়ন ও চলমান ধ্যান-ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে। নগরের পরিকল্পনা এমনভাবে করতে হবে, যেখানে বসবাসরত প্রত্যেকটি মানুষ তার চারপাশের সবকিছুকেই নিজেদের বলে ভাবতে শেখে, যার ফলে পরস্পরের মধ্যে একটি শক্তিশালী কমিউনিটি বন্ডিং বিদ্যমান থাকবে। আমাদের সমাজের প্রতিটি উপাদানের সঙ্গে অন্য উপাদানগুলো কোনো না কোনোভাবে জড়িত। যদিও সামাজিক অপরাধ শুধু কোনো একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের ওপর নির্ভর করে না। তথাপি একটি সুষ্ঠু পরিকল্পিত নগর এনে দিতে পারে সৌহার্দ্যপূর্ণ সামাজিক সম্পর্ক, যার অভাব এখন আমরা প্রতিদিনই উপলব্ধি করছি। কারণ, সামাজিক অপরাধের প্রবণতা কমাতে পারলে অর্থনীতি ও সাংস্কৃতিক বিকাশে দেশ লাভ করবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা, আর এর জন্য চাই সমাজের সর্বস্তরের সচেতনতা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
মাহফুজ ফারুক: পরিবেশ ও স্থাপত্যবিষয়ক সাংবাদিক।

No comments

Powered by Blogger.