বিচার প্রশাসনের নির্বাচনী সাজ

লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হিসেবে বিচার প্রশাসনকেও নিরপেক্ষ নির্বাচনী সাজ দেওয়ার দাবি রাখে। গত ২৭ অক্টোবরে সংবিধানের ৯০ দিনের মধ্যে ঢুকে পড়েছি। মন্ত্রীদের পদত্যাগ দেখি, স্বভাবে পরিবর্তন দেখি না। পুলিশও আগের মতো মারকুটে। জনপ্রশাসনের কোনো নিরপেক্ষতা দেখি না। সংসদ অধিবেশন চলমানরত অবস্থায় মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ারের জামিন নাকচ হওয়া দেখে ভাবতে বসি, এ থেকে পরিত্রাণ কী। ভাবি, এখানেই তো নির্বাচন কমিশনের (ইসি) বড় ভূমিকা থাকবে। বর্তমান আইনমন্ত্রী, বিশেষ করে আইন প্রতিমন্ত্রী অধস্তন আদালতের প্রশাসনকে প্রায় পাঁচ বছর বিরাটভাবে প্রভাবিত করেছেন। ২০১১ সালে বাহাত্তরের সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদটি জীবিত করা হয়নি। যদি করা হতো, তাহলে বিচারকদের বদলি ও কর্মস্থল নির্ধারণের মালিক-মোক্তার থাকতেন সুপ্রিম কোর্ট। এখন সরকারের হাতে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সর্বদলীয় সরকার অপরিহার্য মনে হলে সর্বদলীয় প্রশাসনও লাগবে। সে থেকে বিচার প্রশাসন বাইরে থাকতে পারে না। সামনে হয়তো আরও চমক ও ধরপাকড় আসবে। এমনকি প্রধানমন্ত্রীও সরে দাঁড়াতে পারেন। কিন্তু তখনো তাঁর রেখে যাওয়া স্থায়ী সরকার পাথরের মতো চেপে থাকবে।
বিচার প্রশাসনে একটি জগদ্দল পাথর আছে। জামিন নাকচ হওয়া দেখে তাই মনে হয়। আদালতের হাত লম্বা। বর্তমানে ইসির হাতও অনেক লম্বা। বিচার প্রশাসনে একটা ব্যাপকভিত্তিক রদবদল হতে হবে। অন্যথায় ইসি দেখতে চাইলে দেখবে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য তাদের নেওয়া পদক্ষেপগুলো সুফল দিচ্ছে না। মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার ও রফিকুল ইসলাম মিয়া বিএনপির সামনের সারির নেতা। তাঁদের আটককে যদি রাজনৈতিক কৌশল বলা হয়, তাহলে আদালত তার অংশ হতে পারে না। এমনকি অযথা তেমনটা প্রতীয়মান হলেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিচার বিভাগকে বে-আবরু করার যুক্তিতেও নির্দলীয় সরকার বাতিল হয়েছে। এখন ভিন্নভাবে সেই একই বে-আবরু হওয়ার কাণ্ড চলতে পারে না। রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানি সামনের দিনগুলোতে আরও তীব্র হবে। সহিংস হরতাল ডাকার দায়ে কারও বিচার হবে না। সন্দেহভাজন বা তাঁদের নামে হয়তো ধরপাকড় চলবে। বহু লোক জামিনের জন্য দাঁড়াবেন। জামিন চাই, বিচার চাই না। জামিন নিন, বিচার দেব না। এতে রাষ্ট্র প্রশ্নবিদ্ধ হবে। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইতিমধ্যে তেমনই একটি চরিত্র। আপাতদৃষ্টিতে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট অভিযোগের ভিত্তিতে তাঁকে কয়েকটি মামলায় জড়ানো হয়েছে। জেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁর জামিন নামঞ্জুর করা হয়েছে। তাঁর বিচারের প্রস্তুতি কোথাও নেই। এ-সংক্রান্ত বিষয় প্রধানত নিম্ন আদালতের। সুষ্ঠু নির্বাচনের সঙ্গেও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অবিচ্ছেদ্য।
অধস্তন আদালতের স্বাধীনতা অত্যন্ত সীমিত। নির্বাচনে এর সরাসরি প্রভাব পড়বে। এর কারণ, নির্বাচনকালে অধস্তন আদালতের বিচারকদের সমন্বয়ে প্রাক্-নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের তদন্তে কমিটি হবে। প্রতি জেলায় অন্তত একটি করে। তাতে বিচারকেরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবেন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাড়াবাড়িও তাঁদেরই রুখে দেওয়ার কথা। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ বলেছে, ইসির দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হবে। প্রায় দুই হাজার বিচারকের নিম্ন আদালত প্রশাসন নিয়ন্ত্রণে একটি ‘দ্বৈত প্রশাসন’ কাজ করে। এর এক প্রান্তে আইন মন্ত্রণালয়, অন্য প্রান্তে সুপ্রিম কোর্ট। আওয়ামী লীগ শাসনামলে অধস্তন আদালত সরকারের একচ্ছত্র ছকে চলেছেন। সেই ছকটি কী রকম? কখন কাকে কোথায় বদলি করা হবে, তার প্রস্তাব করবে আইন মন্ত্রণালয়। আর তা অনুমোদন করবে সুপ্রিম কোর্টের জিএ কমিটি। সংবিধান ও রায় আমাদের শাসকগোষ্ঠী যখন লাগে তখন লাগায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার আওয়ামী লীগ ফেলতে চায়নি। কিন্তু তাদের হাত-পা বাঁধা। সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছেন বলে কথা! একই সুপ্রিম কোর্ট বলেছিলেন, তাঁর সঙ্গে পরামর্শ ছাড়া আইন মন্ত্রণালয়ের বিচার শাখার সচিব নিয়োগ দেওয়া যাবে না। কিন্তু সেটা তাদের মনে ধরেনি। তাই তারা সুপ্রিম কোর্টকে অগ্রাহ্য করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরের কথা। সারা দেশ থেকে জেলা ও দায়রা জজরা সুপ্রিম কোর্টে এসেছেন। জেলা জজদের বার্ষিক সম্মেলন। একজন বিচারক সেখানে ‘আইনসচিব’ সম্বোধন করেছিলেন।
প্রধান বিচারপতি তখন যথার্থই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, তিনি তো তাঁর সামনে কোনো আইনসচিবকে দেখেন না। এ নিয়ে আপিল বিভাগের একাধিক রায় আছে। সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে ও সাধারণত জ্যেষ্ঠ বিচারককে আইনসচিব করতে হবে। আইনসচিব হলেন ‘বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা’। কারণ, কোনো বিচারক কখন, কোথায় কতক্ষণ থাকবেন, তার প্রস্তাব করবেন আইনসচিব। এটা একটা স্পর্শকাতর কলকাঠি। আইনমন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, তাঁরা সুপ্রিম কোর্টকে আইনসচিব নিয়োগে কিছুই জানাবেন না। শফিক আহমেদ ও কামরুল ইসলাম হাসতে হাসতে মাসদার হোসেন মামলায় দেওয়া সুপ্রিম কোর্টের রায় জবাই করলেন। ওই ভদ্রলোক আগেই উপসচিব (প্রশাসন) ছিলেন। ওই সময় তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ২৪ ঘণ্টার জন্য ঢাকা জজশিপে তাঁর যোগদান দেখানো হলো। এরপর তাঁকে আইনসচিব পদে বসিয়ে যা করা হলো, তার নাম দিয়েছি উদ্বাহু নৃত্য। উপসচিব (প্রশাসন) পদে রেখে আইনসচিব করা ব্যক্তিকেই পরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বিচার শাখার যুগ্ম সচিব (প্রশাসন) ও অতিরিক্ত সচিবের (প্রশাসন) শূন্য পদে বসানো হয়। এভাবে সরকার সুপ্রিম কোর্টের রায় করাত দিয়ে কেটে অনির্মল বিষাদানন্দ লাভ করেছে।
এই প্রেক্ষাপটে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চকে বিব্রত হতে দেখলাম। সেটা এখন বলব। যে দেশে প্রধান বিচারপতির চাহিবামাত্র আস্ত একটা সংবিধান ছাপা হয়ে যায়, সে দেশেই এবং একই সরকারের আমলে আরেকজন প্রধান বিচারপতির উষ্মা অরণ্যে রোদন হিসেবে প্রমাণিত হয়। পুরো একটি সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও সরকারের মেয়াদ পার করল কথিতমতে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ পছন্দের ব্যক্তিকে আইনসচিব বহাল রেখে। তাহলে প্রশ্ন, সর্বদলীয় আমলে কি এই পাথরটা সরানো হবে? কয়েক মাস আগে আইনসচিবের পদের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট হলো। ভাবলাম, এবার বুঝি একটি হিল্লে হবে। কিন্তু কী দেখলাম। হাইকোর্ট রুল জারির উদ্যোগ নিলেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বাধা দিলেন। বারবার সময় নিলেন। কয়েক দফায় প্রায় চার মাস কাটল। শেষতক শুনানি হলো না, রুল জারি হলো না। হাইকোর্টের যে বেঞ্চটি অ্যাটর্নি জেনারেলের চাপাচাপিতে কেবল সময় বাড়াচ্ছিলেন, তাঁরা বিব্রত হলেন। কোনো কারণ দেখানো হলো না। কেউ জানল না। এখন কিন্তু ইসির বোঝার কথা, আইনসচিব পদে সরকার যাঁকে ঠেকনা দিয়ে এতকাল রাখল, তাঁকে সরানো উচিত হবে। হিম্মতওয়ালা বনতে হলে কিছু তো প্রমাণ দিতে হবে। বিচার প্রশাসনের বন্ধ্যত্বের আরও নজির আছে।
রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক প্রেষণভিত্তিক পদগুলোতে বিচারিক কর্মকর্তাদের স্থলাভিষিক্ত হওয়া সব সময় একটি প্রতিযোগিতামূলক বিষয়। রাজধানী ঢাকার পুলিশ বিভাগ বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা যদি নির্বাচনী পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে, তাহলে ইসিকে ঢাকার বিচার প্রশাসনের দিকেও নজর দিতে হবে। এ-সংক্রান্ত তথ্যাবলি নির্দেশ করে যে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সৃষ্টি হওয়া একটি শক্তিশালী কোটারি প্রেষণে থাকা পদগুলোকে খামচে ধরে আছে। সুপ্রিম কোর্টের বিধান হলো, কোনো বিচারক একটি কর্মস্থলে টানা তিন বছরের বেশি থাকবেন না। ইসি যদি দেখতে চায়, তাহলে তারা দেখতে পাবে যে, এখানে একটি নৈরাজ্য বাসা বেঁধে আছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে, বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, আইন কমিশন ও সুপ্রিম কোর্টের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেসব বিচারিক কর্মকর্তা ওই নীতি লঙ্ঘন করে আছেন, তার সঙ্গে নির্বাচনের আবার সম্পর্ক কী? এটা না দেখতে চাইলে, না বুঝতে চাইলে কাউকে বোঝানো কঠিন। এর মুখ্য কারণ একটি মুখচেনা গোষ্ঠী তারা নানাভাবে বর্তমান সরকারের শাসনামলে আশীর্বাদপুষ্ট থেকেছে। অনেকে হয়তো অনিচ্ছায় ঠেকায় পড়ে নিজেকে চলতি হাওয়ার পন্থী করেছেন। কিন্তু সামগ্রিক বিচারে ঢাকাভিত্তিক অধস্তন আদালত প্রশাসনে একটি ক্ষমতাসীন দল কিংবা তাদের মদদপুষ্ট কিংবা সুবিধাভোগী অংশ বিনি সুতার জাল বিস্তার করে ফেলেছে।
ব্যতিক্রম বাদে এটাই সাধারণ বাস্তবতা। যেমন একজন অতিরিক্ত দায়রা জজকে দুই বছর পরে মুখ্য বিচারিক হাকিম পদে নিয়ে আসা হলো। তাঁর পাঁচ বছর পার হলো। কিন্তু তাঁর বদলি হচ্ছে না। আইন মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা যিনি চট্টগ্রামে গেলেন দু-এক মাসের জন্য। তিনিই মুখ্য বিচারক হিসেবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে চলেছেন। ওই দুই মাস বাদে ঢাকায় তাঁর চাকরি পাঁচ বছরের বেশি সময় গড়িয়ে গেছে। একইভাবে জুডিশিয়াল সার্ভিস কমিশন, বিচার প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট, আইন কমিশন, যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল, সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রারের কার্যালয়—প্রায় সর্বত্রই পাঁচ থেকে সাত বছর চাকরি করা লোকদের ভিড় চোখে পড়বে। আবার এমনও নয় যে সুপ্রিম কোর্টের জিএ কমিটি নিজেদের তৈরি করা বিধানের ব্যত্যয়ে বিচলিত। আইন মন্ত্রণালয়কে চিঠি লিখে সরকারকে বিব্রত করার কথা শুনিনি। দীর্ঘদিন জেলা জজের ১১টি পদ শূন্য রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয় প্রায় নয় মাস আগে এই ১১টি শূন্য পদের বিপরীতে ১৭ জন অতিরিক্ত জেলা জজের নাম পাঠিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে। জেলা জজ পদে উন্নীত হয়ে টানা পাঁচ বছর জেলা জজের দায়িত্ব পালন না করলে তিনি সচিব স্কেল পাবেন না। চাকরিতে ২৫ বছর পার করা অনেকে প্রমাদ গুনছেন।
প্রায় পাঁচজন ইতিমধ্যে গভীরভাবে হতাশ। কারণ, তাঁরা এখন জেলা জজ হলেও আর পাঁচ বছরের শর্ত পূরণ করতে পারবেন না। প্রায় পাঁচ লাখ টাকা করে তাঁরা বঞ্চিত হবেন। জিএ কমিটিকে ক্ষতিপূরণ আইনে ফেলার দেশ আমরা এখনো গড়তে পারিনি। ইসি জনপ্রশাসনে হাত দেবেন কি না জানি না। বিচার প্রশাসনে হাত দিলে আরও ভয়। সাবেক কমিশনার ছহুল হোসাইন মহীউদ্দীন খান আলমগীরের মামলায় কথা বলতে গিয়ে আদালত অবমাননায় জড়িয়েছিলেন। প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে সাবেক সিইসি বললেন, তিনি ভবিষ্যতে দেখবেন, আপিল বিভাগ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈধতার প্রশ্ন ঠিকই নিষ্পত্তি করেছেন। তিনি ঠিক। তবে সে জন্য হয়তো সরকার বদল দেখতে হবে। এতক্ষণ যা বললাম, তাতে বর্তমান ইসি শক্তি পাবেন, না ভড়কে যাবেন? তাঁরা যা-ই হোন, এটা অনস্বীকার্য যে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছাড়া ইসির স্বাধীনতার প্রশ্নটি অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক ও অপাঙেক্তয় থেকে যাবে।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।
mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.