মত দ্বিমত- দেশে জরুরি অবস্থা জারির পাঁয়তারা by ইনাম আহমদ চৌধুরী

নির্বাচন সামনে রেখে সরকার ও বিরোধী দল মুখোমুখি। একদিকে বিরোধী দলের সহিংস হরতাল অন্যদিকে সরকারের ধরপাকড়। এ পরিস্থিতিতে জনমনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বাড়ছে। কী ভাবছে রাজনৈতিক দল?
সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ যে এমন কদর্যভাবে সংলাপ ও সমঝোতার পথ রুদ্ধ করে দেবে, দুই দিন আগেও তা প্রশ্নাতীতভাবে অনুধাবিত হয়নি। সরকারি কর্মকাণ্ড প্রথম দৃষ্টিতে আকস্মিক হরতালের আহ্বানপ্রসূত বলে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা সত্ত্বেও পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অনুসৃত ঘটনাপ্রবাহ হচ্ছে সম্পূর্ণভাবেই পূর্বপরিকল্পিত।

‘পথ হারাবে না বাংলাদেশ’—এই থিমের পটভূমে প্রথম আলোর প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল সমমর্মিতাময় প্রীতি-সিক্ত একটি মিলনমেলা। তথ্যমন্ত্রীসহ সরকারি-বিরোধী দল এবং সমাজের উল্লেখযোগ্য বহু লোকের ছিল সমাগম, শুভেচ্ছা বিনিময়, মতামত আদান-প্রদান। ওখানে মনে হচ্ছিল সত্যিই বুঝি রাজনীতির বহমান ঘূর্ণাবর্তে বাংলাদেশ পথ হারাবে না। কিন্তু সামান্য ক্ষণের ব্যবধানেই সরকারি দলের হঠকারী সিদ্ধান্ত আশার প্রদীপ নিভিয়ে দিল। ওই অনুষ্ঠান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পথে যে তিনজন এবং ওই রাতেই খালেদা জিয়ার বাসভবন থেকে বেরোবার সময় যে দুজনকে দৃশ্যত কারণ না দেখিয়েই গ্রেপ্তার করা হলো, মূলে তার কারণ অত্যন্ত পরিষ্কার। হরতাল আহ্বান ও পালন, পিকেটিং, শান্তি ভঙ্গকারী কোনো কর্মকাণ্ড থেকে এ পাঁচজনের দূরত্ব সর্বাধিক। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এই পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সরকারের আলোচনা এবং এমনকি সংসদে মত প্রকাশের পথও সজোরে রুদ্ধ করে দেওয়ার অপপ্রচেষ্টার অঙ্গ। সরকারি দল কিছুতেই চাইছে না বিএনপির নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার মতো একটি অবস্থা সৃষ্টি হোক। বিএনপির নির্বাচনে যোগদান মানেই আওয়ামী লীগের পরাজয়—এই সত্য উপলব্ধি থেকেই সরকারি দলের এই উদ্ধত, অস্থির ও অবিমৃশ্যকারী আচরণ।
মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার সংসদ সদস্য। এম কে আনোয়ার সংসদে বিএনপির প্রস্তাবিত নির্বাচনকালীন সরকারের ব্যাখ্যা দিয়ে তা যে আলোচনার মাধ্যমে সম্পাদিত হতে পারে, তার উল্লেখ করেন। মওদুদও সংসদে বিএনপির একজন মুখপাত্র। দুজনই অসুস্থ। সংসদ চলাকালে গণতান্ত্রিক ও সংসদীয় নিয়মরীতি-প্রথা লঙ্ঘন করে তাঁদের গ্রেপ্তার করার অর্থই হচ্ছে সংসদে যোগদান করা কিংবা সংলাপে তাঁদের ভূমিকা নেওয়াকে অসম্ভব করে তোলা। রফিকুল ইসলাম মিয়ারও সংলাপে এবং অংশগ্রহণে একটি গঠনমূলক ভূমিকা পালন করার কথা এবং তিনিও আইনগত ও সংসদীয় কর্মকাণ্ডে পারদর্শী।
আবদুল আউয়াল মিন্টু ব্যবসায়ীদের তরফ থেকে সমঝোতা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। আর চেয়ারপারসনের বিশেষ সহকারী শিমুল বিশ্বাস ছিলেন খালেদা জিয়ার সঙ্গে সংযোগের যোগসূত্র। তাঁদেরও গ্রেপ্তার করে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হলো।
বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে র‌্যাব-বিজিবি-সশস্ত্র পুলিশ এবং বিভিন্ন জাতীয় যানবাহন যেমন জলকামান, পুলিশ আর্মড কার, প্রিজন ভ্যান ইত্যাদির মহাজমায়েত দেখে মনে হচ্ছে অফিসে কাউকে ঢুকতে বা তা থেকে কাউকে বেরোতে না দিতে সরকারি প্রশাসন বদ্ধপরিকর। সেখানে দলের অন্যতম যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ছাড়া কেউ নেই। এ যেন রণপ্রস্তুতির আয়োজন। ওদিকে চেয়ারপারসনের বাসভবনও চারদিকে পুলিশ বাহিনী পরিবৃত। দলের কাউকে আসতে-যেতে দেওয়া হচ্ছে না। চেয়ারপারসন শনিবার রাতে নিজের কার্যালয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেও যেতে পারেননি। অর্থাৎ তিনি যে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, তার পথ-সুযোগও সম্পূর্ণ বন্ধ।
এর আগেই এক স্বৈরাচারী আদেশে সর্বপ্রকার সমাবেশ, এমনকি অভ্যন্তরীণ সভা, মানববন্ধন, মিছিল পুলিশের বিনা অনুমতিতে (যা পাওয়াও কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ) নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমতাবস্থায় বিএনপির হরতাল-অবরোধ জাতীয় কর্মকাণ্ড ছাড়া উপায় থাকবে না। এবং সেগুলোকে সহিংস করে তোলা অতীব সহজ। বর্তমান অবস্থায় কেন্দ্রীয় নেতাদের পারস্পরিক যোগাযোগ ও বিচ্ছিন্ন এবং মতবিনিময় সম্ভূত সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথাই অবান্তর। তা ছাড়া অন্য নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি-নির্যাতন একটি বিভীষিকাময় শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। সুতরাং সংলাপ-সমঝোতা এবং বিএনপির অংশগ্রহণ সরকারের নীলনকশা অনুযায়ীই এখন অসম্ভব এবং অবাস্তব করে তোলা হলো। এবং এটা এমন সময়, যখন বিএনপি আলোচনা-সংলাপে যেতে দুই হাত, এক পা বাড়িয়েই আছে।
আওয়ামী লীগ নির্বাচনী মনোনয়নপত্র বিতরণ শুরু করেছে। অর্থাৎ এটি আরেকটি সংকেত—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’।
বলা হচ্ছে ‘সর্বদলীয় সরকার’ হবে। এই তথাকথিত সর্বদলীয় সরকারে যে মহাজোটের চার দলই থাকে কি না, তা নিয়ে গভীর সন্দেহ। জাসদ (ইনু) এবং বর্তমানেই যূথবদ্ধ মেননের ওয়ার্কার্স পার্টি নিয়ে তাকে ‘সর্বদলীয়’ নাম দেওয়া হবে ধিক্কারযোগ্য একটি প্রহসন।
প্রধান বিরোধী দল এবং তার সহসঙ্গীরা না যোগদান করলে এই নির্বাচনকে কোনো অবস্থাতেই সর্বদলীয় নাম দেওয়া যেতে পারে না। সুতরাং প্রস্তাবিত এই নির্বাচন হবে একদলীয়, স্বৈরাচারী এবং সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য।
তাহলে সরকার কোন পথে এগোচ্ছে? পরিষ্কারভাবে অগ্রহণযোগ্য এই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা তো ‘জরুরি অবস্থা’কেই ডেকে আনার পাঁয়তারা।
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে মনে হচ্ছে সেটাই সরকারি দলের ইচ্ছা ও কর্মসূচি। বাংলাদেশ যেন এবার সত্যিই পথ হারাল এবং দুঃখের কথা, তা হলো প্রবীণতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগেরই ‘কল্যাণে’।
সেটি হলে ইতিহাস তাদের কোনোকালেই ক্ষমা করবে না।
ইনাম আহমদ চৌধুরী: উপদেষ্টা, বিএনপির চেয়ারপারসন।

No comments

Powered by Blogger.