কক্সবাজার-বান্দরবান নিয়ে স্বাধীন আরাকান! >> ধারাবাহিক প্রতিবেদনের প্রথম পর্ব। by রহমান মাসুদ ও ইলিয়াস সরকার

বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্তে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে রণপ্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গা সলিডিরাটারি অর্গানাইজেশন (আরএসও)। নতুন লোকবল, প্রশাসনিক শক্তি ও ভারী অস্ত্র সংগ্রহের মাধ্যমে ক্রমেই ভয়ংকর শক্তিধর হয়ে উঠছে মায়ানমারের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন।
এই জঙ্গি সংগঠনের তৎপরতা রোধে বাংলাদেশি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে প্রায়ই কঠিন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মায়ানমার সেনাবাহিনীর সঙ্গে প্রায়ই বাংলাদেশ সীমান্তে বন্দুকযুদ্ধ হচ্ছে আরএসও’র। এতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে স্থানীয় পাহাড়ি-বাঙালি জনগোষ্ঠী।
বাংলানিউজের স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট রহমান মাসুদ ও স্টাফ করেসপন্ডেন্ট ইলিয়াস সরকার এর দীর্ঘ সরেজমিন অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এ বিষয়ে নানা চাঞ্চল্যকর ও ভয়ংকর তথ্য।

 
বাংলাদেশ-মায়ানমার সীমান্ত থেকে ফিরে: গত বছরের জুন মাসের শুরুতে মায়ানমারের আরাকান রাজ্যে সংঘঠিত সহিংসতায় ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)।  ফলস্বরূপ ২০১২ সালের ৮ জুন (শুক্রবার) মংডু জেলার কোয়ারবিল মাদ্রাসায় জুম্মার নামাজের খুতবায় স্বাধীন ইসলামী আরাকান রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ঘোষণা করে তারা।

দলের সামরিক শাখার প্রধান ও বর্তমানে কক্সবাজারে অবস্থানরত হাফেজ সালাউল ইসলাম ও তার ভাই কোয়ারবিল মাদ্রাসার মোহাতামিম হাফেজ হুজ্জাত এ স্বাধীনতা ঘোষণা দেন।

আরএসও’র এই স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্রের কল্পিত সীমানা মায়ানমারের সীমান্ত রেখা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডেও ঢুকে পড়েছে বলে  দাবি করছে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো। সূত্রের দাবি, বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলাকে স্বাধীন আরাকান রাজ্যের ভূখণ্ড হিসেবে পেতে চায় বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

আর এই আরএসও’র সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (আরএনও) এবং আরাকান রোহিঙ্গা ডেমোক্রেটিক অর্গানাইজেশন (এআরডিও)।

বাংলাদেশে বসে স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় কাজ করছেন আরএসও’র সামরিক শাখার প্রধান সালাউল। সালাউলের আছে তিনটি বাংলাদেশি পাসপোর্ট। এসব পাসপোর্ট দিয়ে তিনি বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তান, ভারত, সৌদি আরব, দুবাই, ইয়েমেন, কাতার, ইরান, ইরাক, লিবিয়া, ওমান, মিশর, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন।

পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও কয়েকটি আরব দেশে তার জঙ্গি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আছে বলে নিশ্চিত হয়েছেন গোয়েন্দারা।

অভিযোগ রয়েছে, আরএসওকে সামরিক সহায়তা দিচ্ছে লস্কর-ই-তৈয়্যবা ও আল কায়েদাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন।

গত বছর কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধবিহারে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা চেয়ারম্যান তোফায়েল আহমেদকে ধরতে কক্সবাজার পুলিশের সাদা পোশাকের একটি দল অভিযান চালায় চলতি বছরের এপ্রিলে।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, অভিযানের এক পর্যায়ে কক্সবাজার পুলিশের এ বিশেষ দলটি বান্দরবান জেলার নাইক্ষ্যংছড়ির কুরিক্যং এলাকার ডলিঝিরির এক পাহাড়ে অবস্থিত জনৈক জিয়াবুলের বাড়িতে দুপুরের খাবার খায়। এরপর পুলিশের দলটি নিচে নামার সময় মসজিদের কাছে এসে পৌঁছুলে চারদিক থেকে সশস্ত্র আরএসও সদস্যরা তাদের ঘিরে ফেলে এবং হাত-পা বেঁধে অস্ত্র কেড়ে নেয়। এ অবস্থায় চোখ বাঁধা পুলিশ দলটিকে নিয়ে যাওয়া হয় পাহাড়ের আরএসও ক্যাম্পে। আটক পুলিশ সদস্যদের বাংলাদেশি হিসেবে শনাক্ত করেন স্থানীয় এক ইউপি সদস্য। পরে অস্ত্রসহ ছাড়া পায় আটককৃতরা। বর্তমানে এ দলের দুই সদস্য (এএসআই) টেকনাফের রোহিঙ্গা অধ্যুষিত একটি  ফাঁড়িতে কর্মরত আছেন।

নাইক্ষ্যংছড়ির গর্জনিয়া এলাকার কচ্ছপিয়া গ্রামে বসবাসরত আরএসও’র সাবেক এক কমান্ডার বাংলানিউজকে জানান,  অপহৃত পুলিশ সদস্যদের আরএসও’র যে ঘাঁটিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাও ওই কুরিক্যং অঞ্চলে অবস্থিত। এ ঘাঁটির দক্ষিণ-পূর্বে ওয়াইচ্চাখালি, পশ্চিম-দক্ষিণে আবু তালেব হাজির বাগান। পশ্চিমে ইটের রাস্তা, পূর্বে কোয়ানজিরি মুখ, উত্তরপূর্বে বাঁশখোলা, উত্তরে কালিনজিরির সীমানা। প্রায় ৪/৫ কিলোমিটারজুড়ে এই ক্যাম্প এলাকা অবস্থিত। এ ক্যাম্প থেকে গর্জনিয়া বাজারে প্রতিদিন সকালে বাজার করতে আসে আরএসও’র সদস্যরা। এ বাজারে ওষুধের দোকানের মালিক (রোহিঙ্গা) ডা. সোনা মিয়ার দোকানে অবস্থান নেয় তারা। তাদের বাজার করে দেন স্থানীয় এক সাবেক মেম্বার এবং জনৈক রহিম ও আব্দুল আজিজ নামে স্থানীয় দুই ব্যক্তি।

তিনি জানান, বিচ্ছিন্নতাবাদী জঙ্গি সংগঠন জমিউতুল আরাকানের নেতা মওলানা ছলিমও (৫৫) গর্জনিয়ায় বাড়ি করে আছেন।

আরএসও’র সাবেক এই কমান্ডার আরও জানান, টেকনাফের বাহারছাড়া ও শাপলাপুর, উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প, রামুর পোকখালী, লেঙ্গুরছড়ি, কাউয়ারখোপ, জোয়ারিয়া নালায় রয়েছে আরএসও’র সশস্ত্র অবস্থান। এছাড়া মায়ানমারের সীমান্তবর্তী নাইক্ষ্যংছড়ি, লামা, আলীকদমে রয়েছে আরএসও’র সশস্ত্র ঘাঁটি।

এসব ঘাঁটিতে সব মিলিয়ে দুই হাজারের মতো সশস্ত্র সদস্য রয়েছে। গত জুনে মায়ানমার থেকে সাগরপথে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কের শাপলাপুরে আসে ২৫০ জনের একটি সশস্ত্র গ্রুপ। সামরিক পোশাক পরিহিত এই দলটি পার্শ্ববর্তী পাহাড়ে অবস্থান নেয় বলে স্থানীয় একটি সূত্র বাংলানিউজকে নিশ্চিত করে।

স্থানীয় শাপলাপুর পুলিশ ফাঁড়ির এক এএসআই বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয়দের কাছে এ খবর শুনে আমরা দ্রুত পাহাড়ের দিকে যাই। কিন্তু তাদের খুজেঁ পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত তারা পাহাড় থেকে বের হয়নি বলে মনে করা হচ্ছে। তবে তারা সম্ভবত নাইক্ষ্যংছড়ির সীমান্তবর্তী জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে।

কক্সবাজার পুলিশের এক উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বাংলানিউজকে বলেন, আমরা শুনেছি আরএসও নতুন করে মায়ানমার থেকে লোকবল সংগ্রহের কাজ করছে। একই সঙ্গে চীন থেকে ভারতের মধ্য দিয়ে নতুন নতুন ভারি অস্ত্র সংগ্রহ করছে। কয়েকটি চালান অবশ্য ভারতে আটক হয়েছে।

তিনি বলেন, কুরিক্যংয়ে পুলিশ আটকের পর আরএসও’র পক্ষ থেকে কক্সবাজার পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে টেলিফোন করে জনৈক ইউনুস ওই ঘটনার জন্য ক্ষমা চেয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন। এ সময় পুলিশকে জানানো হয়, মায়ানমারের গোয়েন্দা সংস্থার লোক অনুমান করে বাংলাদেশি পুলিশকে অপহরণ করেছিল আরএসও।

আরএসও’র এক সদস্য বাংলানিউজকে বলেন, যতদিন পর্যন্ত স্বাধীন আরাকান রাষ্ট্র গঠিত না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত বাংলাভাষী আরাকানি রোহিঙ্গা মুসলমানদের মগদের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।

No comments

Powered by Blogger.