পরিকল্পনাহীন স্থাপত্য শিক্ষা

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। স্থাপত্য ও নগর অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগ চালু হয়েছে প্রায় চার বছর। অথচ নেই কোনো নিজস্ব ভবন। স্থানসংকুলানের অভাবে শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হচ্ছে ভূগর্ভস্থ পার্কিং (বেসমেন্ট) স্পেসে। পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের অভাবে ভবিষ্যৎ দিনের স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদেরা হয়ে পড়ছেন অসুস্থ। তা ছাড়া এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় উপকরণ এমনকি শিক্ষকস্বল্পতার দরুন শিক্ষার সুষ্ঠু বিকাশ হচ্ছে বাধাপ্রাপ্ত, এটাই স্বাভাবিক। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবহিত করলেও ফলপ্রসূ পদক্ষেপের অভাবে এমন অবস্থা বিদ্যমান। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, এই অবস্থা সরকারিভাবে পরিচালিত অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও বিদ্যমান। অথচ বাংলাদেশে স্থাপত্য ও পরিকল্পনা শিক্ষার শুরুর দিকটা ছিল সময়ের প্রয়োজন। প্রথম ১৯৬১ সালে তৎকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে (বর্তমানে বুয়েট) টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতায় রিচার্ড ব্রুম্যানকে শিক্ষক করে মাত্র ছয়জন শিক্ষার্থী নিয়ে স্থাপত্য শিক্ষার যে পদচারণ, আজ তার রূপরেখার পরিবর্তন ঘটেছে। দিন দিন দেশের আর্থসামাজিক চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এ শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা যেমন বাড়ছে, ঠিক তেমনি ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ছাড়াই একের পর এক তৈরি হচ্ছে স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগ।
দেশে বর্তমানে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে অনুমোদন সাপেক্ষে প্রায় সাতটি (নতুন দুটি অনুমোদন পাওয়া সাপেক্ষে) এবং বেসরকারিভাবে প্রায় ১৫-১৬টি স্থাপত্য বিভাগ তাদের শিক্ষার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে নগর ও অঞ্চল বিভাগের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম। গত এক দশকে দেশের ক্রমবর্ধমান আবাসন সমস্যার সমাধানকল্পে এবং প্রাকৃতিক সম্পদ ও ভূমি ব্যবহারে পরিকল্পায়নে এই শিক্ষার অগ্রযাত্রাকে সাধুবাদ জানানোই শ্রেয়, যদি সেখানে সুষ্ঠু শিক্ষার বিকাশে সঠিক পরিকল্পনা বিদ্যমান থাকে। কারণ, শুধু বিভাগসমূহ অনুমোদন দেওয়া সাপেক্ষে নয়, বরং প্রথম নিশ্চিত করতে হবে একজন স্থপতি কিংবা নগর পরিকল্পনাবিদ হিসেবে বেড়ে উঠতে গেলে একজন ছাত্রছাত্রীর শিক্ষার পরিবেশ বিকাশের ক্ষেত্রে যে ধরনের সুযোগ-সুবিধার প্রয়োজন, তা প্রথম নিশ্চিতকরণ। সরেজমিনে দেখা যায়, বুয়েট ব্যতীত অন্য বেশির ভাগ পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা বিভাগসমূহে যে শুধু নিজস্ব ভবন নেই সেটা নয়, অপর্যাপ্ত ল্যাবের সুযোগ-সুবিধা, জুরি স্পেস, প্রদর্শনী স্পেস, কমিউনিকেটিভ স্পেস, প্রিন্টিং ও মডেল মেকিং ফ্যাসিলিটিস, উন্নত প্রযুক্তিসংবলিত ডিজাইন স্টুডিও, ডিজিটাল মাল্টিমিডিয়াযুক্ত শ্রেণীকক্ষ, থিয়েটার কিংবা অতিপ্রয়োজনীয় লাইব্রেরিতেও বইয়ের স্বল্পতা বিদ্যমান। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়, এ ধরনের শিক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় বইসমূহের মূল্য অন্যান্য সাধারণ বই থেকে অনেক বেশি।
অন্য শিক্ষাব্যবস্থার থেকে একটু আলাদা হওয়ার কারণে এখানে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও শিল্পসত্তার যোগসূত্রের বিকাশে সম্পূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে ঢেলে সাজাতে হয়, যেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে কমিউনিকেশনের জন্য প্রয়োজনীয় সব ধরনের আধুনিক প্রযুক্তি বিদ্যমান থাকা অতীব জরুরি। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, এসব বিবেচনা ব্যতিরেকেই প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে একের পর এক স্থাপত্য ও পরিকল্পনা বিভাগ; ভর্তি হচ্ছেন শিক্ষার্থী; জন্ম দিচ্ছে কিছু প্রশ্নের, আসলেই কি তাঁরা সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ দিনের একজন পূর্ণাঙ্গ স্থপতি কিংবা পরিকল্পনাবিদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারবেন, নাকি শুধু ডিগ্রিসর্বস্ব হয়ে ভবিষ্যতে নগরকে পরিণত করবেন ইট-কাঠের জঞ্জালে? অন্যদিকে বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউট (আইএবি) কর্তৃক প্রণীত বিভাগসমূহের জন্য Accreditation এ উল্লেখিত নিয়মনীতিমালা পূরণ করার লক্ষ্যে যেকোনো নবনির্মিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগসমূহের ক্ষেত্রে সম্ভবপর নয় যদি না বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কিংবা প্ল্যানিং কমিশন কর্তৃক সঠিকভাবে অর্থায়ন না করা হয় কিংবা প্রয়োজনীয় শিক্ষকের পদ সৃষ্টি না করা হয়। আর শিক্ষা যেহেতু কোনো ব্যবসা নয়, তাই দেশের আর্থসামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশে যুগোপযোগী স্থাপত্য ও পরিকল্পনা শিক্ষার প্রায়োগিক বিকাশে কর্তৃপক্ষ আশু ব্যবস্থা নেবে, এটাই কাম্য।
বিশ্বের বিভিন্ন নামকরা স্থাপত্য ও পরিকল্পনা স্কুল ও অন্যান্য সুপ্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের দিকে লক্ষ করলে দেখা যায়, গবেষণা থেকে শুরু করে শিক্ষার সব যুগোপযোগী উপকরণ পরিপূর্ণভাবে বিদ্যমান বলেই যুগ যুগ ধরে সেগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এবং বিখ্যাত স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের আঙিনায় পরিণত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ। পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ প্রথম অবকাঠামোগত উন্নত করে তারপর পাঠদান কর্মসূচি শুরু করেছে। অথচ আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে হয় এর উল্টো। তা ছাড়া প্রায়োগিক শিক্ষার গবেষণার জন্য যে ধরনের গবেষণাগার প্রয়োজন, উপযুক্ত অর্থায়নের অভাবে তার স্বল্পতা থাকার কারণে এসব বিভাগ দেশীয় পরিমণ্ডলে উন্নত গবেষণার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না, যা অত্যন্ত কাম্য ছিল। ইতালির পলিটেকনিকো দ্য মিলানিও কিংবা অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসেল ইউনিভার্সিটির উল্লিখিত বিভাগসমূহ প্রতিবছর মোট ব্যয়ের শতকরা ৪৪ ভাগ ব্যয় করে উচ্চতর গবেষণা ও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে। অন্যদিকে বহিঃস্থ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গবেষণাক্ষেত্রে লিংক প্রোগ্রামের মাধ্যমে শক্তিশালী করে বিশ্ববিদ্যালয় অবকাঠামোকে।
অথচ আমাদের দেশের এ শিক্ষা বিকাশের প্রায় ৫২ বছর অতিবাহিত হলেও উন্নত গবেষণার ক্ষেত্র এখনো প্রসারিত হয়নি। তবে এখনো সময় ফুরিয়ে যায়নি। বাস্তবসম্মত এ শিক্ষার পরিপূর্ণ বিকাশে কর্তৃপক্ষকে শুরুতেই কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনিটরিং সিস্টেমের মাধ্যমে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে। অন্যথায় সময়ের প্রয়োজনে প্রতিবছর শত শত স্থপতি কিংবা পরিকল্পনাবিদ তৈরি হবেন ঠিকই। তবে তাঁদের মধ্যে থাকবে না বিশুদ্ধ প্রাণের সঞ্চার; দেশ গড়ার স্বপ্ন। ফলে কোনো এক সময় আমাদের নগর পরিণত হবে আবর্জনার স্তূপে। (মাঠপর্যায়ে নিরীক্ষা, বিশেষজ্ঞ অভিমত এবং পর্যালোচনার মাধ্যমে নিবন্ধটি লেখা হয়েছে)
সজল চৌধুরী: সহকারী অধ্যাপক, স্থাপত্য বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম।
sajal_c@yahoo.com
মাহফুজ ফারুক: পরিবেশ ও স্থাপত্যবিষয়ক সাংবাদিক।
mahfuzfaruk@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.