গোপন তথ্যের সুরক্ষা চাইলে ফিরিয়ে আনুন টাইপরাইটার! by তপন চক্রবর্তী

আধুনিক যুগ পেরিয়ে আমরা এখন উত্তর আধুনিকতার শেষের দিকে। যুগের সাথে তাল মিলিয়ে জীবনের সর্বক্ষেত্রে প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে।এযুগে এমন ব্যক্তি খুঁজে পাওয়া ভার যিনি প্রযুক্তির সর্বশেষ ভার্সন মুঠোফোনের সংস্পর্শ পাননি।
আর প্রযুক্তির উৎকর্ষের সাথে ব্যক্তিজীবনে যেমন নিত্যদিন লাগছে পরিবর্তনের ছোঁয়া তেমনি বদলে যাচ্ছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন অফিস আদালতের দৃশ্যও।নয়মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশে এ প্রযুক্তির ভাল দিকের পাশাপশি মন্দ বা অশুভ দিকটাও স্পষ্ট হয়ে পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বলছিলাম, টাইপরাইটারের কথা। যে জিনিস ছাড়া একসময় অচল ছিল অফিস আদালত এমনকি ব্যক্তিগত কাজও।আগের দিনের এই টাইপরাইটারকে দূরে পাঠিয়ে জায়গা দখল করে নিয়েছে কম্পিউটার-ল্যাপটপ, ফ্যাক্সের স্থানে ই-মেইল এবং টেলিফোনের বদলে স্মার্টফোন, আইফোন ইত্যাদি।

আর এসব নিত্যনতুন প্রযুক্তির সংস্পর্শে তৃতীয় বিশ্বের ক্যাটাগরিতে থাকা বাংলাদেশও এগিয়ে চলছে ভবিষ্যতের দিকে। তবে এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে ব্যক্তিজীবনে সুফল বয়ে আনলেও প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার অভাব থাকায় এবং স্পর্শকাতর তথ্য ফাঁস হবার ঝুঁকি থাকায় বহির্বিশ্বে ঘটে গেছে ইতিহাসে স্থান পাওয়ার মত নানা ঘটনা। তথ্য প্রযুক্তির অবাধ ব্যবহারের কারণে উইকিলিকস এবং খোদ মার্কিন ডাটা এনালিস্ট এডওয়ার্ড স্নোডেন মার্কিন তথ্য ফাঁস করে দেবার পর বিশ্বজুড়ে তোলপাড় হয়েছে। বাংলাদেশও পিছিয়ে নেই। সালাউদ্দিন কাদের(সাকা) চৌধুরী ফাঁসির রায়ের কপি আগেভাগে আংশিক ফাঁস হয়ে পড়ার দুর্ঘটেও এমনই এক বিস্ফোরক অধ্যায়ের সূচনা ঘটেছে বাংলাদেশে।  শুরু হয়েছে পুরোপুরি নতুন আর অভূতপূর্ব এক বিতর্কের---যার জন্য দায়ী সর্বশেষ তথ্য প্রযুক্তি। 

আদালতের মতো পবিত্র জায়গাটিকে জনগণের সর্বশেষ আস্থার স্থল হিসেবে রাখতে এবং  নিরপেক্ষতা ‍ও সততা বজায় রাখার স্বার্থে সংশ্লিষ্টদের আরও দায়িত্বশীল ও কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করার বিষয়টি ভেবে দেখার সময় এসেছে।

কথায় আছে, পুরান চাল ভাতে বাড়ে। এই প্রবাদবাক্যটি আমরা না মানলেও অবশেষে মানতে বাধ্য হচ্ছে রাশিয়া, ভারত ও ইরানের মতো অনেক দেশ। স্পর্শকাতর ও গোপন তথ্যের সুরক্ষার স্বার্থে  কম্পিউটার ছেড়ে তারা ফের টাইপরাইটারে ফিরে যাচ্ছে।

সংবাদ মাধ্যম সূত্রে জানা যায়, উইকিলিকস ও স্নোডেনের তথ্য ফাঁসের পর থেকেই রাশিয়া তাদের অফিসিয়াল কাজে কম্পিউটার ছেড়ে যাবতীয় গোপন তথ্যের জন্য টাইপ রাইটার ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে তথ্য ফাঁসের আশংকা যেমন নেই, তেমনি এতে করে সার্বিক নিরাপত্তাও ঝুঁকিও তৈরি হয় না। বরং নিরাপত্তা জোরদারই হয় বলে মনে করছে তারা।

ইংল্যান্ডের লন্ডনে ভারতীয় হাইকমিশন ও রাশিয়া তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে কম্পিউটার ছেড়ে টাইপরাইটারে তাদের যাবতীয় তথ্য লিখছে বলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

এক্ষেত্রে আমাদের বাংলাদেশও গুরুত্বপূর্ণ স্থান আদালত ও প্রতিরক্ষাখাতসহ রাষ্ট্রের স্পর্শকাতর ও গোপন তথ্য যাতে ফাঁস না হয় সেজন্য ফের সনাতন পদ্ধতি টাইপরাইটার ব্যবহারের বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। 
বোতাম টিপে যন্ত্রের সাহায্যে কাগজে বিভিন্ন তথ্য লেখার জন্যে পশ্চিমা দেশেই প্রথমে টাইপ রাইটার বা টাইপ মেশিন আবিষ্কার হয়। পরবর্তী সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একজন যন্ত্রপ্রকৌশলী ক্রিস্টোফার শোলস্‌ ১৮৬৬ সালে  বৈদ্যুতিক টাইপ রাইটার আবিষ্কার করেন। যা সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।

বর্তমানে উন্নত প্রযুক্তির ধারায় ও কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছে এককালের বহুল ব্যবহৃত জনপ্রিয় যন্ত্র এই টাইপ রাইটার। 

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে জড়িতদের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। এ বিচার নিয়ে এক বিচারপতির স্কাইপ কথোপকথন ফাঁস হয়ে দেশ-বিদেশে তোলপাড় হয়। 

এ ট্রাইব্যুনাল থেকেই গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিএনপি‘র প্রভাবশালী নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর (সাকাচৌ) রায়ের কপি আংশিক ফাঁস হয়ে যায়। অভিজ্ঞ মহলের মতে, ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটি মহল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে।

সরকার বিষয়টি বেশ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে এ ঘটনার পেছনের লোকগুলোকে চিহ্নিত করতে তদন্ত শুরু করেছে। এরই মধ্যে সাকার এক আইনজীবীর কম্পিউটার জব্দ করেছে এবং এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে একজনকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তদন্ত অব্যাহত আছে।

আমরা আশা করি দেয়ালের পেছনের মানুষগুলোর মুখোশ উন্মোচন হবে।

ফের ফিরে আসি টাইপরা‌ইটার প্রসঙ্গে, প্রযুক্তির যুগে পৃথিবীর উন্নত দেশগুলি তাদের গোপন তথ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে সনাতন রীতিতে ফিরে যাচ্ছে। ষড়যন্ত্রকারিদের নতুন কোনও পরিকল্পনা করার আগে দেশ ও জাতির স্বার্থে  আমাদেরও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তরে টাইপরাইটার ব্যবহার করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় এসেছে।

No comments

Powered by Blogger.