আনলোড সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড by মাকসুদুল আলম

অক্টোবর মাস। আর সপ্তাহ দু’এক পরেই ২৫শে অক্টোবর। ২৫শে অক্টোবরের পর কি হতে যাচ্ছে? সবার মাঝে বিরাজ করছে এক ধরনের আতঙ্ক। রয়েছে উৎকণ্ঠা। জনমনে আশঙ্কা। আছে নানা প্রশ্ন। নির্বাচন আদৌ হবে কিনা?
দেশে জরুরি অবস্থা জারি হতে যাচ্ছে কিনা? নির্বাচন স্থগিত হতে চলেছে কিনা? চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের সম্ভাব্য পথ নিয়ে সর্বত্র চলছে গুঞ্জন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর মতে ‘দেশে কোন সঙ্কট নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক অচলাবস্থা টেলিভিশন চ্যানেলগুলোতে তথাকথিত সুশীলবাবুদের সৃষ্টি। এদের কথা বলা বন্ধ হলেই দেশে সঙ্কট থাকবে না। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর এক সদস্য দম্ভোক্তি করে বলেছেন ‘২৪শে অক্টোবরের পর কিছু হবে না’। সংসদে ৩৩ সদস্যের বিরোধীদলকে সংখ্যালঘু আখ্যায়িত করে তিনি বলেছেন, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করলে বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে আনলোড করে দেয়া হবে’। এর আগেও বামদলের একজন মন্ত্রী বিরোধীদলীয় নেত্রীকে রাজনীতি থেকে মাইনাস করবেনই বলে হুমকি দিয়েছিলেন। বাস্তবে ভিন্ন চিত্র। গলার স্বর উঁচু করে আলোচনা চলছে চায়ের টেবিলে। হিসাব নিকাশ চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। জনস্বার্থে আগামী দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন চেয়ে উচ্চ আদালতে একটি রিট আবেদনও করা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে জনমনে আতঙ্কের যথেষ্ট কারণও রয়েছে। সমঝোতার সবরকম কুটনৈতিক তৎপরতা প্রায় ব্যর্থ। প্রধান দুই দলের মধ্যে আলাপ আলোচনার পথ প্রায় অবরুদ্ধ। দুতায়ালির মাঠে নেই ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’ কিংবা ‘টুয়েসডে গ্রুপ’। দেশজুড়ে সৃষ্টি করা হয়েছে ভয়ানক ভীতিকর পরিস্থিতি। ছাত্রলীগের ক্যাডার, পেশাদার ছিনতাই চক্র ও দুর্ধর্ষ অপরাধীরা সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নেমেছে। কমান্ডো স্টাইলে লুটে নিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা। দেশের প্রায় সবগুলো শহরে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ড বেড়েছে। কুইক রেন্টালের বিশাল ভর্তুকির পর বিদ্যুৎ নিয়ে নতুন খেলা চলছে। শুধুমাত্র দাদাদের স্বার্থ রক্ষার্থে জনমতের বিরুদ্ধে গিয়েও রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ভারত থেকে বিদ্যুৎ কেনাকে জায়েজ করা হয়েছে। ঘাটতি না থাকা সত্বেও সরকারি নির্দেশে লোডশেডিং বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বিগত বছরগুলোতে সরকার দেশব্যাপী ‘মারাত্মক উন্নতি’ করার পরও ৫টি সিটি করপোরেশনের নির্বাচনগুলোতে ভোট না পাওয়ায়, ইতিমধ্যে জনগণকে কয়েক দফায় শাসানো হয়েছে দেশের ভেতরে ও বাইরে। সরকারের উন্নয়ন জনগণের চোখে না পড়ায় চশমা লাগাতে বলা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে সরকারি খরচে বিলবোর্ড লাগানো হয়েছে। সাম্প্রতিক জরিপে তাতেও আশানুরূপ ফল না পাওয়ায় এখন বিদ্যুৎই বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হচ্ছে। অস্বাভাবিক গরমে আমজনতাকে উচিৎ শিক্ষা দিতে তাদের দুঃখ কষ্টকে বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারের সাগর চুরি (পুকুর চুরি নয়) নিয়ে প্রশ্ন তোলায়, ঝোপ বুঝে কোপ মারা হয়েছে পটুয়াখালী-৩ আসনের নিজদলীয় সংসদ সদস্যকে। বেসরকারি ইনডিপেন্ডেন্ট টিভির অপরাধ বিষয়ক অনুষ্ঠানের দু’জন প্রতিবেদকের ওপর চড়াও হওয়ায় শেষ পর্যন্ত তাকে লাল দালানের ভাত খাওয়ানো হয়েছে। বিচার সংক্রান্ত বিষয়ে মন্তব্য করলেই আদালত অবমাননার অভিযোগে মামলা দায়ের হচ্ছে। শুনেছি, বিদেশ ভ্রমণের নামে দেশ থেকে সুটকেস ভর্তি হাজার হাজার কোটি টাকা অনেক আগেই পাচার করা হয়েছে। লুটপাটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, বেসিক, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের অবস্থা নাকি এখন একেবারেই চরমে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোতে এখন নাকি আর তালা দেয়ার প্রয়োজন পড়ে না। সেগুলো এখন একেবারেই ফতুর। ছিঁচকে চোরও এখন আর সেখানে হানা দেয় না। শেষ সময়ে সরকারের নজর এখন নাকি গ্রামীণ ব্যাংকের সহায় সম্বলহীন, অবহেলিত ও নিরক্ষর ৮৪ লাখ দরিদ্র নারীর জমানো টাকার প্রতি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর নজরদারিতে এনে এই ব্যাংককে শায়েস্তা করতে গ্রামীণ ব্যাংক আইন অনুমোদন করা হয়েছে। পত্রিকায় পড়েছি বিগত বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া ও মালয়েশিয়ায় বিপুল পরিমাণ টাকা পাচার করা হয়েছে। দুর্নীতি ও লুটপাটের টাকা দিয়ে সেসব দেশে কেনা হয়েছে বিশাল আয়তনের রাজপ্রাসাদ। মনমাতানো অট্টালিকা। চোখজুড়ানো কনডোমিনিয়াম। পাচার করা টাকায় কানাডায় গড়ে তোলা হয়েছে ‘বেগমগঞ্জ’। মালয়েশিয়ায় গড়ে তোলা হয়েছে সেকেন্ড হোম ‘সাহেবপুর’। পদ্মা সেতু সংক্রান্ত দুর্নীতিতে কানাডার রাষ্ট্রীয় তদন্তে শুধুমাত্র আবুল হাসান ফেঁসেছেন। দোষী সাব্যস্ত হয়ে কলঙ্কিত হয়েছেন। পর্দার আড়ালের নাটের গুরুরা অনেক আগেই সেখান থেকে সরে পড়েছে। একাধিক পাসপোর্ট ব্যবহার করে দেশে চলে এসেছেন। সততা প্রমাণে কেউ আবার অনবরত পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছেন। টাকার বিনিময়ে হারানো বিশ্বাস ফিরে পেতে চাইছেন। আশার কথা হলো, কানাডার আদালতে পদ্মাসেতুর দুর্নীতি তদন্ত এখনও শেষ হয়ে যায় নি। কেউ জানে না কখন আবার হাসানের পরে হোসেনের খবর আসে। ভুলে গেলে চলবে না, পাপ বাপকেও ছাড়েনা।
সর্বোচ্চ সংখ্যক সফরসঙ্গী নিয়ে জাতিসংঘের ৬৮তম সাধারণ অধিবেশনে যোগদান শেষে বীরের বেশে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল। প্রত্যাবর্তনের সময় গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারণা দেয়া হয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে জানানো হয় যে, দারিদ্র্য বিমোচনে বিশেষ অবদান রাখার জন্য আমাদের প্রধানমন্ত্রী এ বছর জাতিসংঘের সাউথ সাউথ পুরস্কার পেয়েছেন। জাতিসংঘের এ পুরস্কার পাওয়ায় বিমানবন্দরে আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীকে ঘটা করে ব্যাপক নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়। বিমানবন্দর থেকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পর্যন্ত রাস্তায় বাস, ট্রাক ও মোটর সাইকেলে মিছিল করায় রাজধানী জুড়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। বিমানবন্দরমুখী গুরুত্বপূর্ণ এই সড়কে গণসংবর্ধনার আয়োজন করায় চরম জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হয়। টিভির সংবাদে দেখেছি, যানজট ও জনদুর্ভোগে গোটা রাজধানী অচল হয়ে পড়ার দৃশ্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার পেলেন, খবরটা ভালকরে জানাই ছিল না। দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনা চাট্টিখানি কথা নয়। সমুদ্র জয়ের পর জাতিসংঘ জয়। এতো মহাখুশির খবর। দেশের প্রায় সবগুলো ব্রডশিট পত্রপত্রিকায় রঙিন পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন ব্যাংক, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সংগঠন প্রতিদিন প্রধানমন্ত্রীকে এই উপলক্ষে অভিনন্দন জানাচ্ছে। আনন্দে বুক ভরে যাচ্ছে। ঠিক যেন এক উৎসবের আমেজ। শেষ পর্যন্ত ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে বিস্তারিত জানার সুযোগ হলো। ঠান্ডা মাথায় কিছু কিছু বিষয় নতুন করে বুঝলাম। প্রথমত, ‘সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ জাতিসংঘের কোনো পুরস্কার নয়। দিতীয়ত, সরকারের পক্ষ থেকে মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল (এমডিজি) বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের সাফল্য হিসাবে প্রধানমন্ত্রীকে সাউথ সাউথ পুরস্কার দেয়া হয়েছে বলে দাবি করা হলেও, তা পুরোপুরি সত্য নয়। প্রধানমন্ত্রীকে বিমানবন্দরে মহাধুমধাম করে গণসংবর্ধনা দেয়া হলেও, এই পুরস্কারটি এ বছর তাঁকে দেয়া হয়নি। এই পুরস্কারটি একসময় বাংলাদেশ পেয়েছিল। তা ২০১১ সালে। তাহলে আমরা যে পত্রিকায় প্রধানমন্ত্রীকে পুরস্কার নেয়ার ছবি দেখলাম, তা কি মিথ্যা? ঠিক তা নয়। ২০১৩ সালে দারিদ্র্য বিমোচনসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ‘সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড’ নামের সংগঠনটি এ বছর যাদের পুরস্কৃত করেছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ কিংবা আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কোনো নাম নেই। সংস্থাটির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটের কোথাও বিন্দুমাত্র উল্লেখ নেই। পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় রয়েছে কোস্টারিকার প্রেসিডেন্ট, বাহরাইনের প্রধানমন্ত্রী ও ফিজির প্রধানমন্ত্রীর নাম। উন্নয়ন ও তথ্যপ্রযুক্তিতে বিশেষ অবদান রাখার জন্য দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট নেলসন ম্যান্ডেলা ও তাঁর সাবেক স্ত্রী এবং আমেরিকার একজন সঙ্গীত শিল্পীকেও এ বছর এই পুরস্কার দেয়া হয়। তবে ২২ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কের ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়ায় আমাদের প্রধানমন্ত্রী  ‘সাউথ সাউথ নিউজ’ নামের একটি ক্রেস্ট পুরষ্কার পেয়েছেন। সাউথ সাউথ নিউজ সংগঠনটি ‘গ্লোবাল গভর্ন্যান্স লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ হিসাবে সাউথ সাউথ পুরস্কারের পৃষ্ঠপোষক সংস্থা মাত্র। যতটুকু বুঝতে পেরেছি তাতে, সংগঠনটির সঙ্গে জাতিসংঘের কোনো সম্পর্ক বা যোগসূত্র নেই। ঢাকা বিমানবন্দরে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে বিশ্বসভায় স্বীকৃতি পাওয়ায়  তাঁর অর্জিত এই পুরস্কার ও সম্মান দেশের জনগণের। তিনি এই বিশেষ সম্মাননা পুরস্কার দেশের আপামর জনসাধারণকে উৎস্বর্গ করেছেন। উঠতে বসতে যাদেরকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে শাসানো হয়, ঘাটতি না থাকা সত্বেও বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে যাদেরকে অযথা অত্যাচার করা হয়, কষ্ট দেয়া হয়, তাদের আবার পুরস্কার ও সম্মান। নোবেল শান্তি পুরস্কারই যেখানে হজম হচ্ছে না, সেখানে আবার সাউথ সাউথ নিউজ। নির্বাচনের আগে নাগরিক সংবর্ধনার নামে এসবই রাজনৈতিক ফায়দা লুটার ব্যর্থ প্রচেষ্টা ছাড়া অন্য কিছু নয়। তাছাড়া যে পুরস্কার বাংলাদেশকে দেয়াই হয়নি, তা কেন জনগণের হতে যাবে? দেশবাসী কেন লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে এই প্রতারণা ও মিথ্যাচারের অংশীদার হবে? নামবিহীনভাবে এই পুরস্কার যদি জাতিসংঘ থেকে দেয়াও হয়ে থাকে, তবুও তা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর। এটা তাঁর সরকারের সাফল্য ও কৃতিত্ব। এই পুরস্কার জনগণের নয়। আনলোড সাউথ সাউথ অ্যাওয়ার্ড ফ্রম ম্যাঙ্গো পিপল।

০৪ অক্টোবর ২০১৩, টোকিও

No comments

Powered by Blogger.