সরল গরল- আজ থেকে সিইসি ‘সুপার প্রধানমন্ত্রী’ by মিজানুর রহমান খান

আজ থেকে অবশ্যই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ‘অবৈধ’ হবে না। কিন্তু আজকের দিনটি সাংবিধানিকভাবে বিশেষ তাৎপর্যমণ্ডিত। তিন-চতুর্থাংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা সমর্থিত মন্ত্রিসভার আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে এবং তা চোখে পড়তে হবে।
গণমাধ্যমকর্মীদের নজর রাখতে হবে মন্ত্রীরা বা সরকারি কর্মকর্তারা সীমারেখা বা আন্তর্জাতিক মানের নির্বাচনকালীন আচরণবিধি লঙ্ঘন করেন কি না। তাঁদের রিপোর্ট করার কায়দায় বড় পরিবর্তন আনতে হবে।

আমার আশঙ্কা, সরকারি দল জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে একটা মারাত্মক বিপদ ডেকে আনছে। সেটা হলো দলীয় সরকার সম্পর্কে জনগণের মধ্যে অনুরাগের পরিবর্তে বিরাগ ও বিতৃষ্ণা সৃষ্টি। কারণ, তাদের উচিত ছিল আগে থেকেই নির্বাচনকালে স্ব-আরোপিত বিধিনিষেধ আরোপে প্রস্তুতি গ্রহণ করা। কিন্তু এ পর্যন্ত তারা এমন কিছুই করেনি, যাতে দলীয় প্রধানমন্ত্রী, বিশেষ করে শেখ হাসিনার অধীনের সরকার আর নির্বাচন কমিশন নিয়ন্ত্রিত সরকার যে এক নয়, জনগণ তা মনে করতে পারে।
নির্বাচন কমিশনের নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণে থাকা ৯০ দিনকে যদি একটি নির্বাচনী কেকের সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে জনগণকে আওয়ামী লীগ কী দেখাল?  সিইসিকে অন্ধকারে রেখে তারা ১২ দিনের (২৭ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর) একটি টুকরো কেটে হজম করার সব উদ্যোগ সম্পন্ন করল। এর মানে সিইসিকে না জানিয়ে তারা গত ৫ বছরের মতোই স্পিকারের সভাপতিত্বে কার্য উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক করল। এবং ধুম করে ৭ নভেম্বর পর্যন্ত সংসদ চালানোর সিদ্ধান্ত নিল। কী আশ্চর্য, ২০১১ সালে প্রায় চোখের পলকে নির্দলীয় সরকারের বিধান তারা সংবিধান থেকে ফেলে দিল। অথচ যখন তাদেরই গড়া সংবিধান অনুযায়ী, গ্রহণকালের মতো ‘নির্বাচনকাল’ গ্রাস করতে শুরু করেছে, তখনো তারা অপ্রস্তুত। তাদের হাতে বিল। নির্বাচন কমিশন বলছে, সবই তারা সাঙ্গ করেছে, কেবল আচরণবিধিটাই বাকি। আওয়ামী লীগের ষোলোকলা পূর্ণ করতে গিয়ে এখনো তাদের নির্বাচনী বাইবেল হিসেবে পরিচিত আরপিও সংশোধন করাটাই বাকি।
শতভাগ নির্বাচনী প্রস্তুতি সংবিধান-নির্দেশিত ৯০ দিন গণনা শুরুর আগেই শেষ করা গেল না। সেই অর্থে আজ থেকে সংবিধানের ওপর একটা সংকটের ছায়াপাত ঘটবে। প্রস্তুতিহীনতায় আরও যত দিন গড়াবে, ততই সাংবিধানিক সংকটের এই ছায়া প্রগাঢ় হবে। প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণে মহাজোটের সঙ্গে বৈঠকের কথা বলেছিলেন, কিন্তু সেই বৈঠক হয়েছে বলে জানা যায় না। তিনি ইতিবাচকভাবে বিএনপির কাছেও পরামর্শ চেয়েছিলেন। কিন্তু এটা আর কোনোক্রমেই কেবল রাজনীতিকদের বিষয় নয়। কেবল খেলোয়াড়দের বিষয় নয়। যা কিছুই করা হোক, রেফারিকে সম্পৃক্ত করেই করতে হবে। তবে রেফারিকেও তেমন রেফারি হতে হবে। গ্যালারি ভর্তি মানুষ রেফারির ব্যাঘ্রোচিত স্বভাবের পরিবর্তে মেষের স্বভাব দেখলে তার প্রতি পচা ডিম ছুড়তেই পারে।

৭ নভেম্বর স্পিকার আবার বৈঠকে বসবেন। কিন্তু কেন? এর আগে তিনি আরও কাজ বাকির দোহাই দিয়েছিলেন। ৭ নভেম্বরে গিয়ে আমরা যেন তথাকথিত জনস্বার্থে বা রাষ্ট্রীয় স্বার্থে, জনগণের বৃহত্তর কল্যাণে নতুন নতুন ‘জনকল্যাণমূলক আইন’ পাসের অজুহাত না শুনি। নবম সংসদ আমাদের ঢের বেশি আইনকানুন উপহার দিয়েছে। এর কাছে বেশি চাই না। এরপর দশম সংসদের কাছে চাই। সম্প্রতি সংসদ হঠাৎ একটি ভালোমানুষি বিল পাস করল। পুলিশি হেফাজতে কারও মৃত্যু ঘটলে অভিযুক্তের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড। উদাহরণের স্বার্থে বলি, মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া এ রকমের বিল আমরা আজকের পর থেকে নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত আর দেখতে চাই না। প্রতিবেশী ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অনেক সময় তাঁদের আইনসভাগুলোকে নির্বাচনকালে বাজেট দিতেও বাধা সৃষ্টি করেছেন। কারণ, বেশি ভালো ভালো না। অতি ভক্তিও সুলক্ষণ নয়। পাঁচ বছরের একটি মেয়াদের শেষ ৯০ দিনকে সরকারের ঠিক স্বাভাবিক মেয়াদ বলা যাবে না। সে কারণে সংবিধানের কৈফিয়ত হলো, আজ থেকে ৯০ দিন তুমি তো নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত থাকবা। তোমার আইন পাসের সময় কই? সে জন্যই তোমাকে তিন মাসের ছুটি দিলাম। এ সময়ে এক দিনের জন্য বৈঠকে না বসতে পারলেও ক্ষতি নেই। আইনের লঙ্ঘন ঘটবে না। এই ৯০ দিন আসলে প্রসূতিকালীন ছুটি। এটা নতুন সন্তান বা নতুন সংসদ প্রসবের সময়। কিন্তু কদিন আগে তোফায়েল আহমেদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত প্রকারান্তরে প্রসূতিকালীন ছুটিকে প্রজননকাল হিসেবে বর্ণনা করলেন।    

তাই বলি, বর্তমান সরকারি দলকে আর সুশাসন দিতে হবে না। তাকে ৯০ দিনের জন্য জিরিয়ে নিতে হবে। অমৃতেও অরুচি ধরে। তাই ক্ষমতাসীন দলকে আর অমৃত ঢালতে হবে না। একটু জিরোতে হবে। বিলুপ্ত হওয়া ত্রয়োদশ সংশোধনীর একটি বিধানে বলা ছিল, দৈনন্দিন কাজ ছাড়া কোনো নীতিনির্ধারণী কাজ করা যাবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনকারী সব দেশ এটা মানে। এটা আজ থেকে কার্যকর করার দায় সিইসির। দশম সংসদ নির্বাচনের জন্য দেশের মানুষ ও জনপ্রশাসনকে নির্বাচন কমিশন তার মনের মতো করে সাজাবে। আজ থেকে নির্বাচনকে স্পর্শ করে এমন সব বিষয়ে সিইসির হুকুম হবে চূড়ান্ত। মন্ত্রীরা চলবেন তাঁর কথামতো। সিইসির বজ্রকণ্ঠ শুনতে কান পেতে রাখব। তিনি বলবেন, সরকারি রুটিন-কাজ চালানো এবং নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। এটা মানতে হবে। হেলিকপ্টারে চড়ে, সরকারি পরিবহন, সরকারি সুযোগ-সুবিধা ব্যবহার করে রথ দেখা আর কলা বেচার দিন আজ থেকে শেষ। জাতীয় পতাকা উড়িয়ে আরও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার কসরত বন্ধ করতে হবে। সরকারি খরচে বিরোধী দলকে গালাগালিতে লাগাম টানতে হবে।

সংসদ ভেঙে দেওয়া হবে, নাকি হবে না, সেই চিন্তায় ইসির আর ঘুম নষ্ট করার সময় নেই। তার উচিত হবে ৭ নভেম্বরের যথেষ্ট আগেই নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা। কারণ, তাঁকে বাঁচতে হবে। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের আব্রু তাঁকে রক্ষা করতে হবে। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে ২০০৮ সালে ইসি তিনবার তফসিল পরিবর্তন করেছিল। এবার তারা যদি প্রথম ৪৫ দিনের মধ্যে তফসিল ঘোষণা না-ই করে, তাহলে তাদের মুখ থাকবে কী করে? দ্বিতীয় ৪৫ দিনে প্রথম তফসিলটি ঘোষণা করতে গেলে তারা তিনবার পেছানোর মতো সময়ই পাবে না। সিইসির অন্তত উচিত হবে অনতিবিলম্বে সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য তারিখ নির্দিষ্টভাবে ঘোষণা করা। সরকারি দলকে একটা খামোশ বলা।

সিইসিকে সুপার প্রধানমন্ত্রী বলাটা কি সাংবিধানিক নয়? সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ ব্যাখ্যা করলে কিন্তু তাই দাঁড়ায়। এই অনুচ্ছেদ বলেছে, ‘নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সকল নির্বাহী কর্তৃপক্ষের কর্তব্য হইবে।’ ২৭ অক্টোবর থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে যেকোনো দিন ভোট গ্রহণ করা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। তাদের এই দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর সহায়তা দেওয়া হবে কর্তব্য। দায়িত্ব পালন আর কর্তব্য পালন এক কথা নয়। আমি মনে করি না, দুই প্রধান দলের মধ্যে সমঝোতা হোক বা না হোক, আগামী ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানে সিইসিকে এড়ানো বা তাকে বর্জন করার কোনো আইনি পথ খোলা আছে। সিইসি বসবেন নির্বাচনী ট্রেনের চালকের আসনে। মন্ত্রিসভার সদস্যরা হবেন ট্রেনযাত্রী। সময় হলে জংশন থেকে ট্রেন চালিয়ে গন্তব্যে পৌঁছানো চালকের ‘দায়িত্ব’। আর তাঁকে সহায়তা দেওয়া সব যাত্রীর কর্তব্য। তবে সেটা দরকার হলেই কেবল লাগবে। এই সহায়তা লাগতেও পারে, না-ও পারে। ট্রেন চালক না চাইলেও বা তাঁর দরকার না পড়লেও চালককে কোনো যাত্রী ‘সহায়তা’ দিতে গেলে সে যাত্রী স্বভাবে গায়ে পড়া বলে নিন্দিত হতে পারেন। প্রধানমন্ত্রীর কাছে সিইসি সহায়তা চাইলে দেবেন, না চাইলে দেবেন না। এই লেনদেন সর্বতোভাবে নির্বাচনসর্বস্ব হতে হবে।     

আচরণগত পরিবর্তন আনলে বা তার সর্বাত্মক চেষ্টা করলেও জনগণ আওয়ামী লীগকে বাহবা দেবে। ১৯৯৫-৯৬ সালে বিএনপির মন্ত্রীরা আচরণ না পাল্টে কেবল আরপিও বদলে পার পেতে চেয়েছিল। তাই বলি, গতকালের মন্ত্রিসভার হম্বিতম্বি আর আজকে মন্ত্রিসভার হম্বিতম্বি এক হতে পারে না। তাদের অবশ্যই কথাবার্তার মেজাজ পাল্টাতে হবে। কারণ, আজ থেকে এই প্রজাতন্ত্র নির্বাচনী ভাবধারায় প্রবেশ করছে। কার্যকর ও প্রত্যক্ষ শাসনের দিন আজ শেষ। আজ থেকে নির্বাচনে জয়ী না হওয়া পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলের উচিত হবে না উল্লেখযোগ্য কোনো নীতিনির্ধারণী সিদ্ধান্ত নেওয়া, উচিত হবে না কোনো আন্তর্জাতিক চুক্তি করা। এই ৯০ দিনে কোনো বিদেশি নেতার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কোনো শীর্ষ বৈঠকের ব্যাপারেও সতর্ক থাকতে হবে।

অস্ট্রেলিয়া কোনো বাধ্যতামূলক আইন না করেও নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ ও কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করছে।  ২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার ডিপার্টমেন্ট অব দ্য প্রাইম মিনিস্টার অ্যান্ড কেবিনেট ‘গাইডেন্স অন কেয়ারটেকার কনভেনশনস’ জারি করে। চলতি বছরে এতে আরও সংশোধনী আনা হয়েছে। এর সূচনাতেই বলা আছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার (বিদায়ী মন্ত্রিসভা) কোনো উল্লেখযোগ্য নীতি নির্ধারণ, উল্লেখযোগ্য কোনো নিয়োগ বা বড় কোনো চুক্তি সম্পাদন এড়িয়ে চলবে। ভারতীয় নির্বাচন কমিশন লোকসভা বা বিধানসভার নির্বাচনকালে মন্ত্রী ও সাংসদেরা কী করতে পারবে আর কী পারবে না, সে বিষয়ে বাধানিষেধ আরোপ করেছে। ১৯৭৯ সালে ভারতের রাষ্ট্রপতি সঞ্জীব রেড্ডি চরণ সিংয়ের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে দৈনন্দিন রুটিন-কাজের বাইরে কিছু না করতে একটি ডিক্রি জারি করেছিলেন। এর বৈধতা আদালতে চ্যালেঞ্জ হলে আদালত রাষ্ট্রপতির আদেশকেই সমুন্নত রাখেন।

২০০৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের ২৬ অক্টোবরের মধ্যরাত পেরোনোর পরে বিশ্বের অন্যান্য গণতন্ত্রের মতো বর্তমানের ঢাউস মন্ত্রিসভাটির কোমায় যাওয়ার কথা। সিইসির উচিত হবে কয়েকজন মন্ত্রীকে ছাঁটাই করতে বলা। দুই নেত্রীর বিরল ফোনালাপসূত্রে সংকট ঘুচলে তা হবে এক অসামান্য ঐতিহাসিক অর্জন। তবে সুপার প্রধানমন্ত্রী সিইসিকে একটি লিটমাস টেস্ট দিই। ডিসি ও এসপির মতো পদের পরিবর্তন প্রধানমন্ত্রীর হুকুমে হয়ে থাকে। সিইসি যদি বর্তমানের সাজানো ছকটা আমূল বদলে দিতে উদ্যোগী হন, জনপ্রশাসনের যে অংশটি আগে কখনো রিটার্নিং অফিসার হননি, তাঁদের যদি আনার একটা নতুন পরিকল্পনা করেন, আর বিদায়ী মন্ত্রিসভা তর্জনগর্জন শুরু করে, তাহলে বুঝব, সিইসি চালক হওয়ার, রেফারি হওয়ার যোগ্য। শেখ হাসিনার সরে দাঁড়ানো বড় বেশি দূরের বিষয়।

মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক।

mrkhanbd@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.