মন তো দখল করা যায় না

হরতালের আগে চট্টগ্রামের লালখান বাজার
২০০১ সালের নির্বাচনের সময় বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখেছিলাম। সে সময়কার একটি ঘটনার কথা খুব মনে পড়ে। চট্টগ্রামের নাসিরাবাদ বালক উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে যাঁরা ভোট দেওয়ার জন্য সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের প্রায় সবারই বুকে সাঁটানো আছে নৌকা মার্কা প্রতীকের ব্যাজ। শুধু ভোটারদের সারিতে কেন, কেন্দ্রের আশপাশে যাঁরা ইতস্তত ঘোরাঘুরি করছেন, তাঁদেরও সবাই ধারণ করেছেন ওই একটি প্রতীকেরই ব্যাজ। ব্যাপারটা বিস্ময়কর, তাৎক্ষণিক এর কারণ খুঁজে পাইনি। সন্ধ্যার পর ফলাফল ঘোষণা করা হলো, এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এম এ মান্নানকে হারিয়ে জয়লাভ করেছেন ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করা বিএনপির প্রার্থী আবদুল্লাহ আল নোমান। কৌতূহলবশত খোঁজ নিলাম নাসিরাবাদ বালক বিদ্যালয় কেন্দ্রে কে কত ভোট পেয়েছেন সে হিসাব জানতে। জানা গেল, সেখানে নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছেন ধানের শীষের প্রার্থী। কী করে হলো? তাহলে ভোটারদের সারিতে নৌকা প্রতীকের ব্যাজ লাগিয়ে যাঁরা দাঁড়িয়েছিলেন, তাঁরা কারা?
এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগেরই একজন মাঝারি সারির নেতা। তাঁর ব্যাখ্যাটি খুবই যুক্তিসংগত মনে হয়েছিল। তখন নাসিরাবাদ এলাকায় প্রবল দাপট ছিল যুবলীগের নেতা ও পুলিশের খাতায় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত মামুনুর রশীদ ওরফে মামুনের। তাঁর ভয়ে এলাকার কারও পক্ষে সাহস করে তাঁদের পছন্দের দল, প্রার্থী বা প্রতীকের নাম উল্লেখ বা ব্যাজ ধারণ করা ছিল অসম্ভব ব্যাপার, তাই প্রকাশ্যে সমর্থনের ব্যাপারটি না জানিয়ে গোপন ব্যালটেই ব্যক্ত করেছিলেন নিজেদের অভিপ্রায়। আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনেও বিভিন্ন কেন্দ্র ঘুরে দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন বিএনপির শাসনকাল। চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট কেন্দ্র এলাকায় গিয়ে দেখলাম, বিএনপি-সমর্থিত প্রার্থী মীর নাছিরের সমর্থকেরা ভেঙে দিয়েছেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর নির্বাচনী ক্যাম্পটি। ক্যাম্পে বসা ছিলেন মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থনে প্রচারের জন্য ঢাকা থেকে আসা জনপ্রিয় নাট্যব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিক আসাদুজ্জামান নূর। যুবদলের কর্মীরা নাজেহাল করেছিলেন তাঁকেও। এ ঘটনার অল্প কিছুক্ষণ পর ওই কেন্দ্র পরিদর্শন করতে এসেছিলেন মীর নাছির। আসাদুজ্জামান নূর তাঁর কাছে ছুটে গিয়ে অভিযোগ জানিয়েছিলেন।
মীর নাছির কোনো প্রতিকারের চেষ্টা তো করলেনই না, বরং দুর্ব্যবহার করেছিলেন নূরের সঙ্গে। বিমর্ষ নূর একটি চেয়ারে বসে ছিলেন একা, কোনো কর্মী-সমর্থক ছিলেন না তাঁর পাশে। ওই নির্বাচনে বিপুল ভোটে মহিউদ্দিন জিতেছিলেন—এ খবর তো সবার জানা, কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের কেন্দ্রটিতে, যেখানে আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরা দাঁড়াতেই পারেননি, সেখানে মীর নাছিরের প্রায় দ্বিগুণ ভোট পেয়েছিলেন মহিউদ্দিন। এ দুটি ঘটনা মনে পড়ল সম্প্রতি আওয়ামী লীগের লালদীঘি ময়দান দখলের একটি সংবাদ পাঠ করে। ২৫ অক্টোবর লালদীঘি ময়দানে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছিল স্থানীয় বিএনপি। একই স্থানে একই দিনে সমাবেশ করার ঘোষণা দেয় আওয়ামী লীগও। মাঠ দখলের প্রস্তুতি হিসেবে ২৩ অক্টোবর যুব সমাবেশের আয়োজন করেছে যুবলীগ। কৌশলটা ভালো, ২৫ অক্টোবর দুই দলই সমাবেশের ঘোষণা দেওয়ায় পুলিশ যদি কাউকে সমাবেশ করতে না দেয়, তাহলে আগেভাগে একটা শোডাউন করা হয়ে গেল। ২২ অক্টোবর মঞ্চ নির্মাণের কাজ যখন চলছিল, তখন পর্যন্ত পুলিশ প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো ধরনের অনুমতি নেওয়া হয়নি বলে জানিয়েছেন খোদ পুলিশ কমিশনার। ক্ষমতায় থাকার এই একটি সুবিধা, ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরা তখন কোনো কিছুতেই অনুমতির তোয়াক্কা করেন না। পরে যে এটা ম্যানেজ করা যাবে,
এ রকম একটা ধারণা তাঁদের থাকে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। পরে অনুমতি মিলেছে। নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু পত্রিকান্তরে বলেছেন, ‘বিরোধী দলের ক্রমাগত হুংকারে নগরবাসীর মনে আতঙ্ক বিরাজ করছে। তাই আমরা নগরবাসীকে আশ্বস্ত করতে চাই, যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় আমরা প্রস্তুত আছি।’ তাঁদের এই উদ্যোগে নগরবাসী কতটা আশ্বস্ত হবেন, জানি না। তবে অভিজ্ঞতা তো বলে, এভাবে মাঠ দখলে নিয়ে মানুষের মন দখল করা যায় না। মানুষের মন জিতে নিতে হয় ভালোবাসা দিয়ে, ভালো কাজ দিয়ে। যুবলীগের আহ্বায়কের কাছে যদি প্রশ্ন করি, কী ভালো কাজ করছেন এই শহরের যুবলীগের নেতা-কর্মীরা, কী হবে তার উত্তর? গত জুন মাসে রেলওয়ের দরপত্র বাগানোর জন্য চট্টগ্রামের প্রকাশ্য রাস্তায় অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধে নেমেছিলেন ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ক্যাডাররা। গোলাগুলিতে প্রাণ গেছে সাজু পালিত নামের যুবলীগের এক কর্মীর। আরমান নামের নিরীহ একটি শিশুও প্রাণ হারিয়েছিল সেদিন। এই সংবাদ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হলে যুবলীগের নেতা হেলাল আকবর চৌধুরী ওরফে বাবর,
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক সাইফুল আলম ওরফে লিমনসহ ছাত্রলীগ-যুবলীগের বেশ কয়েকজন ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তবে বেশি দিন আটক রাখতে পারেনি। যথারীতি জামিন পেয়ে গেছেন তাঁরা। জেল থেকে বেরিয়ে আবার সগর্বে ফিরে গেছেন পুরোনো বৃত্তে। ২০ অক্টোবর রাতে নগর যুবলীগের সদস্য শহীদুল ইসলামের কার্যালয় ও বাসার সামনে ফাঁকা গুলি ছুড়েছেন বাবরের অনুসারীরা। এ সময় বাবর নিজেও অস্ত্র হাতে মহড়া দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী সাংবাদিকেরা। জনগণকে বিরোধী দলের ‘হুংকার’ ও ‘আতঙ্ক’ থেকে রক্ষা করতে, ‘আশ্বস্ত’ করতে যাঁরা লালদীঘিতে সমাবেশ করেছেন, তাঁরা নিজের দলের ক্যাডারদের সৃষ্ট আতঙ্ক থেকে নগরবাসীকে রক্ষা করতে কী উদ্যোগ নিয়েছেন, জানতে চাওয়া কি অন্যায় হবে? কয়েক দিন আগে আদালত ভবনে চাঁদাবাজি ও অপহরণ মামলার আসামি যুবলীগের নেতা মশিউর রহমানের ছবি তুলতে গেলে প্রথম আলোর আলোকচিত্রী সৌরভ দাশকে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করেন যুবলীগের কর্মীরা। ক্যামেরার মেমোরি কার্ড ও লক্ষাধিক টাকা মূল্যের লেন্সও কেড়ে নেন এই কর্মীরা। পরে অবশ্য তা ফেরতও দেওয়া হয়।
সাংবাদিকেরাই যখন এ রকম লাঞ্ছনা-নির্যাতনের শিকার, সেখানে নগরবাসী কতটা আতঙ্কমুক্ত, তা সহজেই অনুমেয়। ২৫ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় দলই লালদীঘি ময়দানে সমাবেশের অনুমতির জন্য আবেদন করায় চট্টগ্রামের পুলিশ প্রশাসন ২৪ অক্টোবর ভোর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ঢাকায় ২৫ অক্টোবর ঘিরে জনমনে যে আতঙ্ক তৈরি হয়েছিল, তাতে ঢাকায় এ ধরনের উদ্যোগের যুক্তি থাকতে পারে, কিন্তু চট্টগ্রামে সে রকম কোনো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করেন না এখানকার রাজনীতিসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। তাই প্রশাসনের এ উদ্যোগ পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। পরে অবশ্য সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের মধ্যস্থতায় উভয় দলকে দুটি পৃথক স্থানে সমাবেশের অনুমতি দেয় পুলিশ। দুটি সমাবেশই শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু সমাবেশের পর লালখান বাজার ও বহদ্দারহাট এলাকায় বিনা উসকানিতে কিছু দোকানপাট ও গাড়ি ভাঙচুর করে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা।
বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.