যুক্তরাজ্যে নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র

২১ অক্টোবর ২০১৩ যুক্তরাজ্য সরকার ফ্রান্সের ‘ইডিএফ কোম্পানির’ নেতৃত্বে গঠিত কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে তিন হাজার ২০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুই ইউনিটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি অনুমোদন করেছে। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকার ২১ অক্টোবরের খবর অনুযায়ী, বিদ্যমান ‘হিন্কলে-পয়েন্ট বি’ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের (১৯৭৬ সাল থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনরত কেন্দ্র) কাছাকাছি সমারসেটের ‘হিন্কলে-পয়েন্ট সি’ নামক স্থানে ১৪ বিলিয়ন পাউন্ড (২২ দশমিক ৬৫৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ব্যয়ে ইডিএফ এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুল্লি ও আনুষঙ্গিক স্থাপনা নির্মাণ করবে। কেবল বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ নয়, এই চুক্তি বাস্তবায়নের ফলে ২৫ হাজার চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হবে, যার সিংহভাগ যুক্তরাজ্যের কর্মসংস্থানে গুরুত্বপূর্ণ। এই নির্মাণচুক্তির মধ্যে মেয়াদ শেষে স্থাপনা বন্ধ (ডি-কমিশনিং) এবং পারমাণবিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অন্তর্ভুক্ত। চীনের বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান (চায়না ন্যাশনাল নিউক্লিয়ার করপোরেশন ও চায়না জেনারেল নিউক্লিয়ার পাওয়ার করপোরেশন) এই ‘হিন্কলে-পয়েন্ট সি’ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিনিয়োগ করবে। ২০১১ সালের জাপানের ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার পর, ইউরোপজুড়ে গড়ে ওঠা পরমাণু বিদ্যুৎবিরোধী আন্দোলনের ঢেউ যুক্তরাজ্যকে নাড়া দিলেও সরকার এ কেন্দ্র পরিচালনা থেকে সরে আসা যুক্তিগ্রাহ্য মনে করেনি। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন চুক্তি স্বাক্ষরে স্পষ্টত উচ্ছ্বসিত।
২৪ অক্টোবর ২০১৩ প্রকাশিত ‘মেইল অনলাইন’ চুক্তি স্বাক্ষরের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর উচ্ছ্বাসকে উদ্ধৃত করেছে, ‘অনেক দিন পর আমরা একটি নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছি; আগের সরকারগুলো এ জন্য প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়ন করতে সমর্থ হয়নি।’ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নিশ্চিত করেছেন, ভবিষ্যতে নির্মিতব্য আরও অনেক পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি হতে যাচ্ছে ‘হিন্কলে পয়েন্ট-সি’ বিদ্যুৎকেন্দ্র। ১৯৪৭ সালে যুক্তরাজ্য প্রথম বাণিজ্যিক পরমাণু কেন্দ্রের উপযোগিতা যাচাই এবং ১৯৫৬ সালে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করে। এর পর থেকে যুক্তরাজ্য ধারাবাহিকভাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং সেগুলো থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কেন্দ্র তাদের ‘জীবনকাল’ শেষে বন্ধ হয়েছে; নতুন কেন্দ্র প্রতিস্থাপন করেছে। ছোটখাটো দুর্ঘটনাও ঘটেছে, যেমন ১৯৫৬ সালে যুক্তরাজ্যে একটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনায় তেজস্ক্রিয় আয়োডিন-১৩১ আইসোটোপ বেরিয়ে আসে। মানুষজন সরিয়ে না নিলেও ক্ষতিগ্রস্ত কেন্দ্রসংলগ্ন খামারের দুধ ধ্বংস করা হয়। পরে প্রযুক্তির উন্নয়ন, পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের নিরাপত্তা বাড়ানো,
পরমাণু বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ অনেক সংস্কার হয়েছে। এখন যুক্তরাজ্য নয়টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা এবং ইতিমধ্যে আটটি বন্ধ করেছে। ২০২৩  সাল নাগাদ যুক্তরাজ্যে বিদ্যমান অধিকাংশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্বাভাবিক আয়ুষ্কাল শেষে বন্ধ হয়ে যাবে। তবে বিদ্যমান পরিকল্পনা অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে আরও নতুন ১০টি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হবে। প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল থেকে ‘হিন্কলে-পয়েন্ট সি’ কেন্দ্র যুক্তরাজ্যের মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ৭ শতাংশ বা ৫০ লাখ বাড়ির গ্রাহকের চাহিদার বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে। এই কেন্দ্রের আয়ুষ্কাল ধরা হয়েছে ৬০ বছর। প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য যুক্তরাজ্যের সরকার ৯২ দশমিক ৫০ ব্রিটিশ পাউন্ড ব্যয় করবে। বিদ্যমান (২০১৩ সালে) পাইকারি বাজারদর অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে প্রতি মেগাওয়াট বিদ্যুতের জন্য ব্যয় করতে হয় প্রায় ৪৮ ব্রিটিশ পাউন্ড। তবে যুক্তরাজ্য সরকারের ২০২০ সাল নাগাদ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ ৫০ শতাংশ হ্রাস করার পরিকল্পনা রয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাজ্যে উৎপাদিত বিদ্যুতের ৭৫ শতাংশ কয়লা ও গ্যাস পুড়িয়ে পাওয়া যায়। জীবাশ্ম জ্বালানিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের বিকল্প উৎসগুলো ব্যয়বহুল জেনেও সরকার সেদিকে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
বিদ্যমান বিকল্প নবায়নযোগ্য উৎসের মধ্যে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনে যুক্তরাজ্যকে প্রতি মেগাওয়াটে ব্যয় করতে হয় ১২৫ ব্রিটিশ পাউন্ড; স্থলভাগে বায়ুশক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১০০ ব্রিটিশ পাউন্ড, সমুদ্রবক্ষে বায়ুশক্তিনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনে ১৫৫ ব্রিটিশ পাউন্ড, সমুদ্রের ঢেউ থেকে ৩০৫ ব্রিটিশ পাউন্ড। সে বিবেচনায় গ্যাস-কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যুক্তরাজ্যকে ব্যয় করতে হয় প্রতি মেগাওয়াটে প্রায় ৫৫ পাউন্ড। বিবিসির রিপোর্ট অনুযায়ী, হিন্কলে-পয়েন্ট সি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণচুক্তির সমালোচকেরা বলছেন, ৩৫ বছরের জন্য ইডিএফ কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে নির্ধারিত মূল্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি করায় গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল বাড়বে। কিন্তু যুক্তরাজ্য সরকারের হিসাব অনুযায়ী, ‘হিন্কলে-পয়েন্ট সি’সহ অন্যান্য নতুন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন ২০৩০ সাল নাগাদ প্রত্যেক বিদ্যুৎ গ্রাহকের বিদ্যুতের বিল বছরে গড়ে ৭৭ ব্রিটিশ পাউন্ড কম রাখতে সহায়তা করবে। একই সঙ্গে পরমাণু বিদ্যুৎ যুক্তরাজ্যকে কম কার্বন দূষণপ্রবণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ দেবে বলে সরকার দাবি করছে। যুক্তরাজ্য সরকার দেশের জ্বালানি চাহিদা পূরণে বর্ধিত আমদানি ব্যয়ের চাপ নিয়ে নিশ্চয়ই সজাগ।
বিশেষত জাপানের বর্ধিত মাত্রায় জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি বাণিজ্য ভারসাম্যে যে বাড়তি চাপ ফেলেছে, আমদানি জ্বালানিনির্ভর দেশ হিসেবে যুক্তরাজ্যকে তা বিবেচনায় নিতেই হবে। ফুকুশিমা দাইচি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে ২০১১ সালের মারাত্মক তীব্রতার ভূমিকম্প ও সুনামির কারণে সংঘটিত দুর্ঘটনার পর জাপান পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ রাখতে বাধ্য  হয়েছে। কিন্তু অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তাকে বর্ধিত হারে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), জ্বালানি তেল ও কয়লা আমদানির জন্য বিপুল ব্যয়ের চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। জার্মানিতে জাপানের পরমাণু দুর্ঘটনার অভিঘাতে পরমাণু বিদ্যুৎ উৎপাদন পর্যায়ক্রমে ২০২২ সাল নাগাদ বন্ধ করার ঘোষণা এসেছে। ফলে বিশ্ববাজারে এলএনজির চাহিদা ও দাম বাড়ছে। আপাতত জার্মানি ও যুক্তরাজ্যকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কয়লার ব্যবহার  বাড়াতে হয়েছে। বিষয়টি যুক্তরাজ্য সরকারের জন্য আরও অস্বস্তির। কেননা ২০০৩ সাল থেকে যুক্তরাজ্য তেল ও গ্যাসের নিট আমদানিকারকে পরিণত হওয়ায় তার বাণিজ্য ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়েছে। আগামী ১০ বছরে যুক্তরাজ্যে তেল ও গ্যাস উৎপাদন আরও কমার আশঙ্কা তীব্র। ফলে পরমাণু বিদ্যুৎ ছাড়া যুক্তরাজ্যের সামান্য বিকল্পই খোলা আছে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।

No comments

Powered by Blogger.