থেমে গেছে দাঙ্গা থামেনি ধর্ষিতার কান্না

একে কি জীবন বলে? কথায় কথায় দাঙ্গা, দাঙ্গা থেকে দাহ। ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই। ভিটে-মাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ জীবন-যাপন। তারপর রাজনীতির টানাটানি এবং ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়া। কিন্তু ভুলে যেতে না যেতেই আবারও ফিরে আসে সেই দাঙ্গা, একই চেহারায়; একই উনুনের আগুন হয়ে-
ভারতের মোজাফফরনগরের দাঙ্গা থেমেছে প্রায় এক মাস আগে। কিন্তু আজও থামেনি ধর্ষিতার বোবা কান্না। লোকলজ্জার ভয়ে তারা তা বলতেও পারেনি, না পুলিশকে না সমাজকে। অন্তর দহন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে তাদের। ঘরে ফেরার অবস্থাও নেই। ফিরলেই মৃত্যু অথবা নির্মম নির্যাতনÑ এমন আতংক তাড়া করে ফেরে। তাই আশ্রয় শিবিরে মুখ লুকিয়ে, গা বাঁচিয়ে কোনো মতে বেঁচে থাকা। ধর্ষিত এসব নারীর অপলক চোখে এখন একটাই প্রশ্ন একে কি জীবন বলে? কথায় কথায় দাঙ্গা, দাঙ্গা থেকে দাহ। ঘরবাড়ি পুড়ে ছাই। ভিটে-মাটি ছেড়ে নিরুদ্দেশ জীবন-যাপন। তারপর রাজনীতির টানাটানি এবং ধীরে ধীরে ভুলে যাওয়া। কিন্তু ভুলে যেতে না যেতেই আবারও ফিরে আসে সেই দাঙ্গা, একই চেহারায়; একই উনুনের আগুন হয়ে। ভারতবর্ষে দাঙ্গা কোনো নতুন ঘটনা নয়। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ আজও একই কারণে দাঙ্গার দঙ্গলে পুড়ে ছাই হয়। পার্থক্য শুধু কম আর বেশি। তবে দিনের পর দিন ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা জš§ দিয়েছে ক্ষোভ। আর এ ক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে জমে ওঠে রাজনীতির মাঠ, ক্ষমতার মসনদ দখলের লড়াই।
শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষ হয় শিকারির নগ্ন থাবার শিকার। ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩। ভারতের উত্তরপ্রদেশের মোজাফফরনগর এলাকায় শুরু হয় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা। ছড়িয়ে পড়ে সামলি ও পানিপথ জেলাতেও। লিশার, লাংক, বাহাবাদি, হাসানপুর, মোহাম্মদপুর, ভাগপথ এরকম আরও কয়েকটি গ্রামে জ্বালিয়ে দেয়া হয় মুসলমানদের শত শত ঘরবাড়ি। নষ্ট হয় বিপুল পরিমাণ সম্পদ-সম্পত্তি। ঘর ছাড়া হয় প্রায় ৫০ হাজার সাধারণ মুসলমান। এখনও তারা ঘরে ফিরতে পারেনি। এরই মধ্যে বেদখল হয়েছে অনেকের গৃহস্থালী। আর সবচেয়ে বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয় যেটা ঘটেছে তা হল- ধর্ষণ ও গণধর্ষণের মতো বর্বর ও পৈশাচিক ঘটনা। সেই সব ধর্ষিত নারী আজ বাস্তুহারা, আÍগ্লানির ভারে মুষড়ে গেছে তাদের জীবনস্বপ্ন। সরেজমিনে ঘুরে তাদের বর্তমান অবস্থা নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এএফপি, দৈনিক ভাস্কর। আশ্রয় শিবিরে থাকা ওই সব নারীর জীবনের বীভৎস গল্প নিয়ে বার্তা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রকাশিত প্রতিবেদন অবলম্বনে কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হল। দৈনিক ভাস্করের প্রতিবেদকরা কাইরানা ও কানধালা শহরের আশপাশে ঘুরে দেখেছেন সেখানে কতটা দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে দাঙ্গাকবলিত মোজাফফরনগরের নারীরা। এখনও অনেক নারীকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাদের শেষ অবস্থা জানা নেই কারও। চোখের সামনে নিজের মেয়েকে ধর্ষণের দৃশ্য দেখতে হওয়ায় অনেক মা আÍহত্যা করার চেষ্টা পর্যন্ত করেছে। চার সন্তানের এমনি এক মা যিনি লজ্জায় নিজের নামও উচ্চারণ করার শক্তি হারিয়েছেন, তিনি বলেছেন, আমার পরিবারের আমি ও আমার তিন মেয়েকে (বয়স যথাক্রমে ১৭, ১৮, ২১ বছর) আটকে রাখে ১০ থেকে ১৩ জন দাঙ্গাকারী। তারা আমার চোখের সামনে আমার মেয়েদের ধর্ষণ করে।
আমাকে বাধ্য করে ওই দৃশ্য দেখার জন্য। আমার দুই মেয়েকে উদ্ধার করা গেলেও বাকি দুই মেয়েকে এখনও খুঁজে পাইনি। জানি না তারা কোথায় আছে। ওই দুর্বৃত্তদের তিনি চেনেন বলে দাবি করেন। তারা স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী ‘জাত হিন্দু’ সম্প্রদায়ের। তারাই তাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে এবং গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার হুমকি দিয়েছে। এরকম আরও কত মেয়ে রয়েছে যারা মোজাফফরনগর দাঙ্গার সময় যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছে। হতভাগ্য এসব মানুষ যখন পুলিশের আশ্রয় চেয়েছে তাও তারা পাইনি। ভাস্করের প্রতিবেদকদের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যখন থানায় ছুটে গেছে অসহায় মানুষ তাদের বলা হয়েছে, ‘পুলিস থানে ওয়ালে নে কাতা কি হুম তো আপনে সহায়তা করেংগে, তুম মুসলমানো কি নাহি’। এর বাংলা দাঁড়ায় এরকমÑ আমরা শুধু আমাদের জনগণকে (জাত, হিন্দু) রক্ষা করব, তোমাদের নয় মুসলিম। এরকম মর্মান্তিক ঘটনার জš§ হয়েছিল মোজাফফরনগরে। এ নিয়ে ভারত সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। দায়ী করা হয়েছে উত্তরপ্রদেশের স্থানীয় রাজনীতিকে। কিন্তু আজও দাঙ্গাপীড়িত ওই সব মুসলিমরা ঘরে ফিরতে পারেনিÑ কবে পারবে তাও বলেনি সরকার। এমন ঘটনা আর ফিরে না আসুকÑ সভ্য মানুষের এটিই প্রত্যাশা।

No comments

Powered by Blogger.