কোরবানির পশুর হাটের অর্থনীতি by ড. আর এম দেবনাথ

সামনে ঈদ ও পূজা। ঈদ দেশের বৃহত্তম জনগোষ্ঠীর পবিত্র ধর্মীয় উৎসব। পূজা, মানে দুর্গাপূজা সংখ্যালঘু হিন্দুদের বৃহত্তম ধর্মীয় উৎসব। দুটি একসঙ্গে পড়েছে এবার। প্রথমে পূজা, তারপর কোরবানির ঈদ। বাসে, ট্রেনে, বিমানে, লঞ্চে কোথাও টিকিট নেই। দেশের ভেতরের জন্যও নেই, বিদেশে ভ্রমণের জন্যও নেই। দেশের ভেতরে প্রাইভেট গাড়ি নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার ইচ্ছাও একটা স্বপ্ন। গত বুধবার ট্রেনে ময়মনসিংহ থেকে ঢাকা আসার তিস্তা ট্রেনটি চার ঘণ্টা বিলম্ব করেও ময়মনসিংহ স্টেশন ছাড়েনি। অজানা আশংকায় যাত্রীরা ছিল অসহায়। ঢাকা থেকে বেরোনোর কোনো ব্যবস্থা নেই। টঙ্গী দিয়ে বেরোনো, যাত্রাবাড়ী-সায়েদাবাদ দিয়ে ঢাকার বাইরে যাওয়ার ইচ্ছা একটা দুঃস্বপ্ন মাত্র। ঢাকায় বন্দি থাকাই ভালো। এমনিতেই তো বন্দি জীবন! ঢাকায় এখন স্বাভাবিক অবস্থাতেই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে এক-দুই ঘণ্টা সময় লাগে।
এরই মধ্যে কোরবানির হাট বসছে অনেক জায়গায়। এটা ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়। কিছু বলার নেই। এ পশুর হাটের ব্যবস্থা প্রতি বছরই হয়। ব্যবসায়ীরা কখনও লাভ করেন, কখনও লোকসান দেন। যারা কোরবানির জন্য পশু কেনেন তারা কখনও জেতেন, কখনও লোকসান নয়- ঠকেন। প্রতি বছরের ঘটনা এটা। এবারও তাই শুরু হয়েছে। ঈদের পর হিসাব মেলালে বোঝা যাবে কার হার, কার জিত হল- ক্রেতার না বিক্রেতার। এ হিসাবের আগে আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিশাল ঈদের বাজার জমে উঠেছে। দেশের সর্বত্র। এ ঈদে কাপড়ের ব্যবসা, জামা-কাপড়ের ব্যবসা বেশি হয় না। তবে এবার কিছুটা হতে পারে। কারণ দেশের হিন্দুভাইরা পূজা করবেন। তাদের কেনাকাটা আছে। এ কারণে জামা-কাপড়, শাড়ির ব্যবসাও এবার কম জমজমাট নয়। সেদিন গিয়েছিলাম মুদি দোকানে। প্রচণ্ড ভিড়। পেঁয়াজ, রসুন, আদা, চিকন চাল, সেমাই ইত্যাদির রমরমা বাণিজ্য। কোরবানির ঈদ উপলক্ষে বিশেষভাবে জমজমাট হবে মশলার বাজার। জিরা, মরিচ, হলুদ, বিরিয়ানির উপকরণ ইত্যাদির বাজার জমবে। জমবে পশুখাদ্যের বাজারও। দা-খন্তা-কুড়ালের বাণিজ্যও হবে। কোরবানিতে সাহায্য নিতে হবে মৌলভী সাহেবদের। তাদের কদর বাড়বে।
চামড়া ব্যবসায়ীরা তৎপর, যথারীতি তাদের ব্যবসার রেকর্ড ভালো নয়। গৃহনির্মাণ, পরিবহন, কোল্ডস্টোরেজ, পাট, চামড়া ও চা ব্যবসায়ীদের ব্যাংক রেকর্ড ভালো নয়। তবু এবার আগের বছরের মতোই চামড়া ব্যবসায়ীদের স্বার্থ দেখার জন্য সরকার তৎপর। এদের ঋণ দিতে হবে। বেসরকারি ব্যাংকওয়ালারা কত সুনামের দাবিদার, কিন্তু পাট-চামড়ায় পয়সা তারা দেয় না। সব বদনামের ভাগিদার সরকারি ব্যাংক এসবে ঋণ দিতে বাধ্য হয়। এবারও তাই। তারা সরকারি ব্যাংক থেকে বস্তুত বিনা প্রশ্নে প্রায় ৬০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে গেছে। এই যে চামড়ার ব্যবসা, এর অনেকগুলো দিক আছে। চামড়ার ব্যবসা গরুর ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। চামড়ার ব্যবসায় কেমিক্যাল লাগবে, লবণ লাগবে। এসবের বাণিজ্যও হবে প্রচুর। তা হোক, আমরা দেখতে চাই এ ব্যবসার অন্যান্য দিক। গরু ও চামড়ার ব্যবসার রাজনৈতিক দিক আছে। এর অর্থনৈতিক দিক আছে, প্রশাসনিক দিক আছে। অর্থনৈতিক দিকে আছে সরকারের রাজস্বের দিক, হুন্ডির দিক ইত্যাদি।
প্রথমেই রাজনৈতিক দিকটার ওপর একটু আলোকপাত করতে চাই। এ কথা সবাই আমরা জানি, শুধু কোরবানির ঈদ নয়, সাধারণভাবেও সারা বছর যে গোমাংস দেশে ভোগ হয়, তার একটা বড় অংশের জোগানদার প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও মিয়ানমার। সবচেয়ে বড় জোগানদার অবশ্য ভারত। ভারতের মানুষ গরুর মাংস খায় না ধর্মীয় কারণে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে গরুর মাংস একটা সস্তা পুষ্টিকর খাদ্য। অধিকন্তু এতে রয়েছে ধর্মীয় অনুভূতি। এক দেশে নেতিবাচক, আরেক দেশে তা ইতিবাচক। এটা গরু বাণিজ্যের ভিত্তি, এটাই গরু চোরাচালানের ভিত্তি। হাজার চেষ্টা করেও এটা রোধ করা সম্ভব নয়। নিতান্ত অর্থনৈতিক কারণেই এ চোরাচালান বাণিজ্য সংঘটিত হয়। এর সুবিধাভোগী উভয় দেশের মানুষ। ভারতীয়দের গরুর দরকার নেই মাংসের জন্য, বাংলাদেশীদের গরুর দরকার মাংসের জন্য। এই প্রয়োজনকে ভিত্তি করেই এই বাণিজ্য হচ্ছে। অথচ এটা অবৈধ। কারণ বৈধভাবে ভারত গরু রফতানি করে না। বৈধভাবে ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র (এলসি) খুলে বাংলাদেশ তা আমদানি করে না। দৃশ্যত এই অবৈধ বাণিজ্যে জড়িত উভয় দেশের হাজার হাজার বা লাখ লাখ লোক- এটা অবৈধ বাণিজ্য জেনেও। ফলে সীমান্তে এ নিয়ে গোলাগুলি হয়। মানুষ মারা যায়। এতে উভয় দেশের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং এটা ঘটে প্রায়ই। এ সমস্যা শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সমস্যার সৃষ্টি করে। তা করে সারা বছরই। ফলে তিক্ততার সৃষ্টি হয়। নানারকমের গুজব রটে। অথচ অনেকেই বলছেন সীমান্তে যে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে, গুলির ঘটনা ঘটে, তা চোরাচালানের জন্য। এতে গরুর বাণিজ্যও আছে।
দৃশ্যত অবৈধ এই গরুর বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পর্ক হুন্ডির, যা আবার অবৈধ-বেআইনি, দণ্ডনীয় অপরাধ। এই অপরাধের বিচার হয় ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন আইনে’। হুন্ডি কেন? গরুর ব্যবসা বা আমদানি বৈধ নয়। ভারত, নেপাল, ভুটান বা মিয়ানমার থেকে যে গরু আসে, তার সংখ্যা কত তা কেউ আমরা জানি না। এ ব্যাপারে কোনো গবেষণামূলক তথ্যও নেই। সরকারি তথ্যও নেই। অতএব এর সঙ্গে কত টাকার বাণিজ্য জড়িত, তা বলা মুশকিল। তবে সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়, এ খাতে বছরে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়। প্রশ্ন, যে আমদানি বৈধ নয়, সেই আমদানি কীভাবে হয়? ভারতীয় চোরাচালানিরা তাদের গরু বাংলাদেশে ‘পুশ’ করে। এপারে আসার পর এগুলো হয় ‘দাবিদারহীন’ গরু। প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের চোরাচালানিরা জানে কার ‘চালান’ কোনটা। গরু ‘কাস্টমসে’ নিলামে ওঠে নামমাত্র। বাংলাদেশী চোরাচালানিদের মধ্যে যে ‘প্রকৃত’ দাবিদার, অর্থাৎ যার ‘চালান’ সেই নিলাম ডাকে অংশ নেয় এবং নামমাত্র একটা কর পরিশোধ করে দেয়। ‘চোরাচালানিরা’ একটা রসিদ হাতে পায়। গরুর শরীরে একটা সিল মারা হয়। ‘অবৈধ’ গরু ‘বৈধ’ হয়ে যায়। তা পরে সারাদেশের বিভিন্ন বাজারে সারা বছর বিক্রি হয়। এটা একটা অভিনব পন্থা, যার মাধ্যমে আমরা বাণিজ্যটা বৈধ করে নিয়েছি।
কিন্তু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে বড় একটা। ভারতীয় চোরাচালানিরা কি বিনা পয়সায় গরুর চালান পাঠায় বাংলাদেশী চোরাচালানিদের কাছে? দু’জনের মধ্যে কি ‘ভাই ভাই’ সম্পর্ক? বিনা পয়সায় এই ব্যবসা হচ্ছে- এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। রীতিমতো উচিত মূল্যে এসব গরু বাংলাদেশে ‘আমদানি’ হয়। তাহলে এর ‘পেমেন্ট’ কীভাবে হয়? এটা তো ব্যাংকের মাধ্যমে ‘এলসি’ (ঋণপত্র) খুলে আমদানি করা পণ্য নয় যে তা ডলারে পরিশোধিত হবে। তাহলে কোন পন্থায় এর ‘পেমেন্ট’ হয়? অবশ্যই তা হুন্ডির মাধ্যমে। অথচ হুন্ডি অবৈধ। কিন্তু তা হচ্ছে, হবে, অতীতেও হয়েছে। এর পরিমাণ বাড়ছে। নিতান্ত অর্থনৈতিক প্রয়োজনেই তা হচ্ছে। কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থায়ই এ ব্যবসা রোধ করা যায়নি, আগামী দিনে তা পারা যাবে- এ কথা আমি বিশ্বাস করি না অভিজ্ঞতার আলোকেই। অবৈধ বাণিজ্য থাকলে হুন্ডি থাকবে। হুন্ডি থাকলে অবৈধ বাণিজ্য থাকবে। একটি আরেকটির সঙ্গে সম্পর্কিত।
এ সমস্যার আরেকটা দিক আছে। এটা রাজস্ব সম্পর্কিত। অবৈধভাবে যেসব পণ্য ভারত, মিয়ানমার, ভুটান ও নেপাল থেকে আসে, বিপরীতে যেসব পণ্য সেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে যায়, তার ওপর সরকার কোনো কর (ট্যাক্স) পায় না। লাভবান হয় অবৈধ ব্যবসায়ীরা। যদি অবৈধ বাণিজ্য না হয় তাহলে সরকার রাজস্ব পেত, সব সরকারই পেত। বাণিজ্যটা সরকারি হিসাবে আসত। এই বাণিজ্য অল্প টাকার নয়। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে চোরাচালান ব্যবসা প্রচুর টাকার। অনেকে বলেন, এর পরিমাণ হবে সরকারি বাণিজ্যের সমান।
বছর দুই-তিন আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণাপত্রে এই বাণিজ্যকে সরকারি করার দাবি করা হয়, হুন্ডিকে অনুমোদন দেয়ার কথা বলা হয়। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফও তা চায় বলে জানি। যে সমস্যা প্রশাসনিক পদক্ষেপে সমাধান হচ্ছে না, তার সমাধান অর্থনৈতিক হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এটা অনেকেই বলেন যে, প্রশাসনিক ব্যবসা দ্বারা এই চোরাচালান বন্ধের কথা যারা বলেন তারা আসলে চোরাচালান ব্যবসা জিইয়ে রেখে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করেন। চোরাচালানিরা সংঘবদ্ধ ও শক্তিশালী। তাদের প্রোপাগান্ডাই লোকে বিশ্বাস করে। অথচ এই সমস্যার সমাধান হতে হবে অর্থনৈতিক। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা যে উদার বাণিজ্যের পথ ধরেছে, তা ধীরে ধীরে চোরাচালান বন্ধে সহায়তা করবে। সেটা সময় লাগতে পারে। ইত্যবসরে বাংলাদেশ ও ভারত সরকার বসে এ ব্যাপারে বাস্তব পদক্ষেপ নিতে পারে। এতে বাধা কোথায়?
ড. আর এম দেবনাথ : সাবেক প্রফেসর, বিআইবিএম

No comments

Powered by Blogger.