খুনি একজনই by নূরুজ্জামান

কন্যা ঐশীর হাতেই খুন হয়েছেন পুলিশ দম্পতি মাহফুজুর রহমান ও স্বপ্না রহমান। পাঁচ দিনের রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে গতকাল পরিকল্পনা থেকে হত্যাকাণ্ড- দুই ধাপেই তার সরাসরি সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছেন তদন্তকারী কর্মকর্তারা।
বয়ফ্রেন্ডদের সঙ্গে অবাধ মেলামেশা ও মাদক সেবনে বাধা দেয়ায় নৃশংস এই খুনের ঘটনা ঘটিয়েছে। আজ দুপুরে  ঐশীকে আদালতে হাজির করা হবে। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী তার পিতা-মাতা খুনের দায় স্বীকার করেছে। আজ (শনিবার) ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার কথা রয়েছে। সূত্রমতে, ঐশীর স্বীকারোক্তি ছাড়াও ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা বিভিন্ন আলামতের রাসায়নিক ও প্রযুক্তিগত পরীক্ষায় মাত্র একজন  খুনির সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। এর বাইরে অন্য কোন ব্যক্তির তথ্য পাওয়া যায়নি। ঘটনাস্থল থেকে জব্দ করা হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি ও ঐশীর পরনের কাপড়-চোপড় ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের আলামত পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রত্যেকটি পরীক্ষায় একই ব্যক্তির হাতের ছাপ খুঁজে পান পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডির কর্মকর্তারা। পরে ঐশীর হাতের ছাপের সঙ্গে আলামতে প্রাপ্ত ছাপ মিলিয়ে নিশ্চিত হয়েছেন, খুনি  একজনই। সে হচ্ছে নিহত দম্পতির কন্যা ঐশী রহমান।  যদিও পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী দাবি করেছিল বাবা-মা হত্যাকাণ্ডের সময় তার আরও দুই বয়ফ্রেন্ড জড়িত ছিল। তার এমন তথ্যে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে যান তদন্ত কর্মকর্তারা। পরে ঘটনাস্থলে ঐশীকে কয়েক দফায় হাজির করে তার দেয়া বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে বলেন। এতে ঐশীর বক্তব্যে গরমিল ধরা পড়ে। একপর্যায়ে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে ঐশী তার আগের বক্তব্য থেকে সরে আসে। অব্যাহত জেরা ও পরীক্ষাগারের প্রাপ্ত ফলাফলের তথ্য জানার পর একাই খুন করার কথা স্বীকার করে। লাশের ময়না তদন্তকারী চিকিৎসক সোহেল মাহমুদ বলেন, মাহফুজুর রহমান ও তার স্ত্রীর লাশের ক্ষতস্থান গুলো পরীক্ষা করে দেখা গেছে- এমন একটি ধারাল অস্ত্র দিয়ে কোপানো হয়েছে, যার দুদিকেই ধার ছিল। মাহফুজের শরীরে তিনটি আর স্বপ্না রহমানের শরীরে ১১টি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন ছিল। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণেই তাদের মৃত্যু হয়েছে বলে জানান এই চিকিৎসক। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত একটি খঞ্জর টাইপের ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার হওয়া ওই ছুরির দুই দিকেই ধার ছিল। গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী স্বীকার করেছে, কয়েকদিন আগেই বাবা-মাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। এজন্য আগে থেকেই খঞ্জর টাইপের ওই ছুরি সংগ্রহ করে। লুকিয়ে রাখে বাসার রেফ্রিজারেটরের পাশে, যাতে বাবা-মা দেখতে না পান। পরে নিজেই ঘুমের ওষুধ কিনে রাখে। বুধবার সন্ধ্যার পর নিজের হাতে কফি তৈরি করে। সবার অগোচরে সেই কফিতে উচ্চ মাত্রার ১০টি ঘুমের ট্যাবলেট গুলিয়ে দেয়। সেখান থেকে এক কাপ কফি মাকে খাইয়ে দেয়। কিছুক্ষণ পর মা ড্রইং রুমের পাটিতে গভীর ঘুমে ঢলে পড়েন। পরে রাত ১০টার পর মায়ের মোবাইল ফোন দিয়ে বাবাকে তিনবার কল করে। প্রতিবারই জানতে চায়-কখন বাসায় ফিরবেন। রাত সাড়ে ১০টার পর বাবা বাসায় ফিরলে বরবটি ভাজি দিয়ে ভাত খাওয়ায়। এরপর ঘুমের ট্যাবলেট মিশ্রিত কফি খেতে দেয়। ঐশী জানায়, বাবা কফি খেতে চাচ্ছিলেন না। ‘নিজের হাতে তৈরি করে রেখেছি’ বলার পর তিনি খেতে চান। পরে গরম করে দেই। এর ১৫ মিনিটের মাথায় বাবা আমার বেডরুমেই ঘুমের ঘোরে ঢলে পড়েন। জিজ্ঞাসাবাদে ঐশী জানায়, বাবা-মা ঘুমের পর ছোট ভাই ঐহী ও সুমি ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর হত্যার কথা ভাবতে ভাবতে রাত গভীর হয়ে যায়। পরে রাত তিনটার দিকে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘুমন্ত মায়ের শরীরে প্রথম কোপ দেয়। এতে মা জেগে উঠলে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকে ঐশী। এতেও কাজ না হলে গলায় খঞ্জর ঢুকিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। পরে ঘুমন্ত বাবার গলায় প্রচণ্ড জোরে ছুরি চালিয়ে দেয়। এক কোপেই বাবা নিস্তেজ হয়ে পড়েন। গোঙানীর চেষ্টা করলে আরও ২-৩টি কোপ দেয়ার পর নিস্তেজ হয়ে পড়েন। এ খুনের ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ঐশী রহমান, তার বন্ধু রনি ও বাসার গৃহকর্মী সুমিকে ৫ দিন করে রিমান্ডে নেয় গোয়েন্দা পুলিশ। আজ তিন জনকেই আদালতে হাজির করা হবে। গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, চামেলী ম্যানশনের ওই ফ্লাট থেকে রক্তমাখা কাপড়চোপড়, হত্যাকাণ্ডে ব্যবহূত অস্ত্র, বিভিন্ন জায়গায় হাত ও পায়ের ছাপসহ অনেক কিছুই সংগ্রহ করেছিলেন সিআইডির ক্রাইম সিনের সদস্যরা। এগুলো পরীক্ষার পর সিআইডি তাদের রিপোর্ট গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে। ঐশীকে জিজ্ঞাসাবাদকারী একজন কর্মকর্তা বলেন, বন্ধু জনির কাছ থেকে নয়, নিজেই শান্তিনগরের একটি দোকান থেকে ১০টি ঘুমের ওষুধ (নাইট্যাস) কেনে ঐশী। ওই দোকানিও শনাক্ত হয়েছে বলে দাবি করেছেন গোয়েন্দারা। তবে দোকানি কোন প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ দিয়েছেন না প্রেসক্রিপশন ছাড়া ওষুধ বিক্রি করছেন তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোন প্রেসক্রিপশন দেখে ওষুধ দিলে দোকানিকে এই ঘটনায় সম্পৃক্ত করা হবে না বলে জানিয়েছেন তদন্তকারীরা। এসব বিষয় নিয়ে শান্তিনগর এলাকার বেশ কয়েকজন দোকানিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। গত ১৬ই আগস্ট শুক্রবার রাতে রাজধানীর চামেলীবাগের ‘চামেলী ম্যানশনের’ ছয় তলার বি-৫ নম্বর ফ্ল্যাটের তালা ভেঙ্গে পুলিশ দম্পতির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ঐশীর কক্ষের বাথরুম থেকে চাদর দিয়ে প্যাঁচানো অবস্থায় লাশ দু’টি উদ্ধার করা হয়। দু’জনের শরীরেই ছিল উপর্যুপরি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন। ঘটনার পরদিন বৃহস্পতিবার সকালে ছোট ভাই ঐহী (৭) ও গৃহকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে ফ্ল্যাট ছাড়েন দম্পতির একমাত্র মেয়ে ঐশী। ছোট ভাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিলেও ঐশী পলাতক ছিল। শনিবার দুপুরে পল্টন থানায় আত্মসমর্পণ করে।

No comments

Powered by Blogger.