মন খারাপ, নাকি বিষণ্নতা by আহমেদ হেলাল

অফিসের চৌকস কর্মী হিসেবে সুনাম আছে। কিন্তু কদিন ধরে কাজে প্রায়ই ছোটখাটো ভুল হচ্ছে। ইদানীং মেজাজটাও খিটখিটে হয়ে থাকে। মাথাব্যথা হয়। হঠাৎ তুচ্ছ কারণে রেগে যাচ্ছেন, আগের মতো গান শুনতে বা বেড়াতে যেতে ভালো লাগে না।
এই রোগের নাম ‘ভালো না লাগা’ নাকি ‘মন খারাপ’।
পরিচিত একজন সেদিন এসেছিলেন পরামর্শ নিতে। তিনি উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। কিছুদিন ধরে তাঁর মনে হচ্ছে, এ জীবনে তেমন কোনো অর্জন নেই, তিনি একজন ব্যর্থ বাবা, ব্যর্থ স্বামী, ব্যর্থ আমলা। সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন। আজকাল তাঁর মরে যেতে ইচ্ছা করে। ভাবেন, দূর, এ জীবন রেখে কী হবে।
এই দুই ঘটনার ব্যক্তিরা বিষণ্নতা বা ডিপ্রেশনে ভুগছেন। বিষণ্নতা একটি আবেগজনিত মানসিক সমস্যা। পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, পৃথিবীতে প্রায় ৩৫ কোটি মানুষ বিষণ্নতায় আক্রান্ত। এর মধ্যে নারীদের বিষণ্নতার হার পুরুষের তুলনায় দ্বিগুণ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ১০০ জনের মধ্যে পাঁচজনের বিষণ্নতাজনিত সমস্যা আছে। বিষণ্নতার কারণে মাদকাসক্তি থেকে শুরু করে আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের এক গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে দুই-তৃতীয়াংশেরই বিষণ্নতার সমস্যা ছিল। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, যাদের বিষণ্নতা রয়েছে, তাদের শতকরা ৪০ থেকে ৬০ ভাগের আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। মানসম্মত জীবনযাপন ও আত্মহত্যা প্রতিরোধ করতে দ্রুত বিষণ্নতা শনাক্ত ও চিকিৎসা করা জরুরি।

কী করে বোঝা যাবে
সাধারণভাবে মনে করা হয়, মন খারাপ মানেই বিষণ্নতা। কিন্তু বিষণ্নতা বলতে কেবল মন খারাপকে বোঝায় না, এটি মন খারাপের চেয়ে কিছু বেশি। অনেক সময় এমন কিছু লক্ষণ থাকে, যেগুলো দেখে বোঝার উপায় নেই যে কারও মধ্যে বিষণ্নতা রয়েছে। বিষণ্নতার সাধারণ লক্ষণগুলো হচ্ছে—
 কমপক্ষে দুই সপ্তাহজুড়ে দিনের বেশির ভাগ সময় মন খারাপ থাকা।
 খিটখিটে মেজাজ, হঠাৎ রেগে যাওয়া।
 আগে যেসব কাজ বা বিনোদন ভালো লাগত, এখন সেগুলো ভালো না লাগা।
 মনোযোগ কমে যাওয়া, ক্লান্তি বোধ করা, ভুলে যাওয়া।
 ঘুমের সমস্যা, যেমন খুব ভোরে ঘুম ভাঙা বা ঘুম না হওয়া বা কখনো বেশি ঘুম।
 রুচির সমস্যা, যেমন খেতে ইচ্ছা না করা, খিদে না থাকা বা বেশি খাওয়া।
 ওজন কমে যাওয়া বা বেড়ে যাওয়া।
 যৌনস্পৃহা কমে যাওয়া।
 নিজেকে অপরাধী, ছোট ভাবা।
 মৃত্যুচিন্তা করা, আত্মহত্যার চেষ্টা করা।
 শারীরিক লক্ষণ, যেমন মাথাব্যথা, মাথায় অস্বস্তি, মাথা-শরীর-হাত-পা জ্বালা করা, গলার কাছে কিছু আটকে থাকা, শরীর ব্যথা, গিঁটে গিঁটে ব্যথা, বুক জ্বালা, বুকে ব্যথা ইত্যাদি।
 একা একা থাকা, নিজেকে গুটিয়ে রাখা
মনে রাখতে হবে, এই লক্ষণ একজনের মধ্যে সব সময় থাকবে না, বিষণ্নতা শনাক্ত করার জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ প্রয়োজন।

কী করবেন বিষণ্নতায় ভুগলে
 যদি নিজের মধ্যে বিষণ্নতার উপস্থিতি বুঝতে পারেন, তবে নির্ভরযোগ্য বন্ধু, স্বজনকে বিষয়টি জানান, মনোরোগ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
 যেসব কাজ করতে আপনার ভালো লাগে বা লাগত, যাতে আপনি আনন্দ পান বা পেতেন, সেগুলো করুন।
 নিয়মিত গোসল করুন, নখ কাটুন, দাঁতের যত্ন নিন। পরিষ্কার পোশাক পরুন।
 হালকা ব্যায়াম করুন, খেলাধুলায় অংশ নিন। সামাজিক বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকুন।
 ভালো বোধ করার জন্য নিজেকে সময় দিন, চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখুন। বিষণ্নতার চিকিৎসায় ফল পেতে কিছুটা সময় প্রয়োজন।
 বিষণ্ন অবস্থায় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেবেন না, যেমন বিয়ে করা, বিবাহবিচ্ছেদ, চাকরি ছাড়া, জমি বা বাড়ি বিক্রি করা ইত্যাদি।
 মৃত্যুচিন্তা আর আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে একা থাকবেন না। স্বজন, বন্ধু আর সহকর্মীদের সঙ্গে সময় কাটান।
 চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ বন্ধ করবেন না।

বিষণ্নতা কাটাতে...
 প্রিয়জনের মধ্যে বিষণ্নতার লক্ষণ দেখা দিলে তাঁকে দ্রুত মনোরোগ চিকিৎসকের কাছে যেতে সাহায্য করুন।
 আত্মহত্যার প্রবণতা থাকলে, হাসপাতালে ভর্তি করুন, সব সময় পাশে থাকুন। আত্মহত্যা-সংক্রান্ত তার যেকোনো বক্তব্য গুরুত্বের সঙ্গে নিন। বিপজ্জনক কোনো বস্তু বা চিকিৎসকের দেওয়া ওষুধ বেশি পরিমাণে তার হাতের নাগালে রাখবেন না।
 কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণের জন্য তাকে বকাঝকা করবেন না, তার সমালোচনা করবেন না।
 সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে উৎসাহী করুন
বিষণ্নতার চিকিৎসায় ওষুধের পাশাপাশি কাউন্সেলিং ও সাইকোথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। চিকিৎসক ও পরিবারের সদস্য-বন্ধু সবার ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। সময়মতো কার্যকর ব্যবস্থা নিলে আত্মহত্যা প্রতিরোধ করে কর্মমুখর আনন্দের জীবন ফিরে পাওয়া সম্ভব।
লেখক: মনোরোগ চিকিৎসক

No comments

Powered by Blogger.