সংলাপের আগ্রহে ভাটার টানঃ রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটছে না

জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিবের সফরে দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট কেটে যাওয়ার আশা কিছুটা জেগেছিল, অস্বীকার করা যাবে না। দেখা যাচ্ছে তার বিদায়ের পর সে আশা উবে যেতেও সময় লাগেনি।
সংলাপ নিয়ে সরকার ও বিরোধী দলের ইতিবাচক মনোভাব এবং চিঠি দেয়ার কথায় সৃষ্ট পরিস্থিতি ক্ষমতাসীনরাই দ্রুত পাল্টে দিয়েছে। একের পর এক নেতিবাচক পদক্ষেপের পর আনুষ্ঠানিকভাবেই বিরোধী দলকে সংলাপের চিঠি না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে শাসক দল আওয়ামী লীগ। সদ্যসমাপ্ত কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত সভার সিদ্ধান্ত ও সেখানে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পর সংলাপ-সমঝোতা নিয়ে জাগা জল্পনা-কল্পনার আপাত অবসান ঘটল বলা যায়।
প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে বিশ্বব্যাপী সংসদীয় গণতন্ত্রের উল্লেখ করে সেভাবেই আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা বলেছেন। বিশ্বব্যাপী অবস্থার সঙ্গে এখানকার বাস্তবতার মিল কতটা সেটা সম্ভবত তিনি ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করেননি। এক্ষেত্রে পাঁচ বছর পর ভোট ছাড়া সংসদীয় গণতন্ত্রের আর কিছুই যে অবশিষ্ট নেই, সেটা বলতে গেলে শেষ করা যাবে না। জাতীয় সংসদের একদলীয় ও ব্যক্তি নিয়ন্ত্রিত রূপ এর ভূমিকাকে সরকারের রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত করেছে। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ছাড়াই কীভাবে দ্রুত এবং সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত নেয়া হচ্ছে তার উদাহরণের অভাব নেই। এক্ষেত্রে তথ্যবিকৃতি ও মিথ্যাচারেও কেউ পিছিয়ে থাকে না। আদালতের রায়ের কথা বলে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়েছে, সে বিতর্ক থামার কোনো লক্ষণ এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। তাছাড়া প্রশাসনসহ সর্বত্র যেভাবে স্বেচ্ছাচারিতা, অধিকারহীনতা, দুর্নীতি, দলীয়করণের জোয়ার বইছে তাতে উল্লিখিত গণতন্ত্রের নামমাত্র অস্তিত্বও লক্ষ্য করা যায় না। মানবাধিকার পরিস্থিতি অবনতি নিয়ে দেশ-বিদেশে সৃষ্ট উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা কারও কাছেই পাত্তা পায় না। এমন পরিস্থিতিকেই প্রধানমন্ত্রী আইনের শাসন বলে দাবি করেছেন। তিনি মিডিয়া নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অস্বীকার করে জনপ্রিয় পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ করে সম্পাদককে গ্রেফতার ও নির্যাতন করা বা টিভি চ্যানেলের সম্প্রচার বন্ধ করা নিয়ে কোনো কথা না বললেও তিনি একটি পত্রিকায় প্রকাশিত জনমত জরিপের সমালোচনায়মুখর হয়েছেন। জরিপে দেশের ৯০ ভাগ মানুষের নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত প্রকাশিত হওয়ায় তিনি তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠেছেন। তার শাসনামলের দুঃসহ পরিস্থিতি তাকে কতটা জনবিচ্ছিন্ন করেছে সেটা প্রকাশ হয়ে যাওয়াতেই তার এমন প্রতিক্রিয়া কি-না জানা যায়নি। বিগত নির্বাচনে তাকে সমর্থনকারীরাও যে এখন মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে এমন তথ্য তার পক্ষে মেনে নেয়া কঠিন বৈকি!
মনে হয় প্রধানমন্ত্রী কিছু কিছু বিষয় ভুলে যেতে পছন্দ করেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধিতার নামে তিনি গত জরুরি অবস্থার সরকারের বিরোধিতা করলেও মানুষ ভুলে যায়নি সে সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি কীভাবে ক্ষমতায় এসেছেন। এখন পর্যন্ত সেই সেনাসমর্থিত সরকারের অপকর্মের কোনো বিচার হলো না কেন সেটাও সবার জানা। অথচ সে সময় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়ার ছেলেদের দেশ ছাড়ার উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী যে ইঙ্গিত দিয়েছেন তার বাস্তবায়নে তো তারই খুশিতে ফেটে পড়ার কথা। তাহলে ফাঁকা মাঠে গোল দিতে তার কোনো বাধাই থাকে না। তারপরও তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার বিরোধিতায় তার উঠেপড়ে লাগার আসল কারণ যে নিজেকে আসন্ন বিপদ থেকে রক্ষা করা সেটা মানুষ বোঝে। তাই ক্ষমতাসীনদের কোনো যুক্তিই হালে পানি পাচ্ছে না। ফলে সংলাপে বসার সাহস হারিয়ে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতেই মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। এ অবস্থায় সহসা সৃষ্ট রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটবে ভাবার কোনো কারণ নেই।


No comments

Powered by Blogger.