শিশুদের টিভি দেখার প্রভাব

ঘুম থেকে উঠেই নাফির প্রথম কাজ কার্টুন চ্যানেল খুলে বসা। যতক্ষণ না ওর প্রিয় অনুষ্ঠান শেষ হবে ততক্ষণ সোফা ছেড়ে একটুও নড়বে না। মায়ের বকুনি খেয়েও কোন কাজ হয় না।
৮ বছরের ছেলের টিভির এতই নেশা যে, স্কুল থেকে এসে কোন রকমে জামাকাপড় ছেড়েই টিভির সামনে বসে পড়ে। খাওয়া-দাওয়ার কথা মাথায় থাকে না। কী না ওর পছন্দের শোয়ের নায়িকা আজ প্রথম ডেটে যাবে। আর সেই নায়িকার বয়সও নেহাতই কম, খুব বেশি হলে ১৪-১৫। তাই দেখে নাফির মনে হয়েছে তারও ডেটে যাওয়া উচিত, যদিও ডেট শব্দটার মানেও পুরোপুরি বোঝে না। নায়িকার হাবভাবও নখদর্পণে, কথা বলছে, খাচ্ছে, সবই তারমতো করে। কথায় কথায় মাকে বলছে, কুলমম, হ্যাভফান। ওর মা-বাবা তো রীতিমতো বিরক্ত। টিভি বন্ধ করে দিলে এত কান্নাকাটি শুরু করে দেয় যে, তাঁরা বাধাও দিতে পারেন না। নাফির ভাই নাবিদেরও টিভির নেশা সাংঘাতিক। যত এ্যাকশন মুভি বা সিরিয়াল আছে, সব ওর দেখা চাই-ই চাই। নতুন রিয়েলিটি শো দেখে মাথায় বাইক কেনার ভূত চেপেছে। ও নাকি স্ট্যাস্ট ম্যান হবে, স্কুলে ও কায়দা দেখাতে গিয়ে বেশ চোট পেয়েছে। তাতেও কুছ পরোয়া নেহি। কথায় কথায় হলিউড স্টারদের উদাহরণ, পড়াশোনায় মন নেই, বাবা-মায়ের কথা এককান দিয়ে শুনে আর এককান দিয়ে বের করে দেয়। এ রকম চিত্র প্রায় প্রত্যেক বাড়িতেই দেখতে পাওয়া যায়। মনে হতেই পারে এগুলো খুবই ছোটখাটো সমস্যা। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিজ থেকেই ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু বাবা-মা হিসেবে বাচ্চার ভালমন্দ দেখার দায়িত্ব আপনার। নিয়ন্ত্রণ আপনাকেই করতে হবে।

এক্ষেত্রে যা করবেন
বাড়িতে টিভি দেখা নিয়ে নির্দিষ্ট গাইড লাইন সেট করুন। বাচ্চা কতক্ষণ টিভি দেখতে পারে, সেটা ভাল করে বুঝিয়ে বলুন। যত কম সময় বাচ্চা টিভি দেখবে তার জন্য ততটাই ভাল। তবে আপনি যদি বলেন যে, দিনে ১ ঘণ্টা টিভি দেখতে পারবে, তাতে বাচ্চা আপত্তি জানাতে পারে, সে অভিযোগ করতেই পারে যে তাকে খুব কম সময় দেয়া হচ্ছে। পরিবর্তে যদি আপনি বলেন যে, ও দুটো অনুষ্ঠান দেখতে পারবে এবং নিজের পছন্দমতো অনুষ্ঠান বেছে নিতে পারবে, তা হলে কখন তার মনে হবে না আপনি ওর ওপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন।
কয়েকটা নির্দিষ্ট রুল বানান, যেমন স্কুলের আগে বা রাতে ডিনারের পর টিভি দেখা চলবে না। হোমওয়ার্ক না করে টিভি দেখতে পারবে না। উইকএ্যান্ড ছাড়া যেন নিয়মের ব্যতিক্রম না হয়। সেদিকে খেয়াল রাখুন। রুল সেট করার সময় বাচ্চাকে ইনভলভ করুন। এতে ওর মনে হবে, আপনি ওকে গুরুত্ব দিচ্ছেন। যখন নিয়ম বানাবেন তার কারণটা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলুন।
বাচ্চার ঘরে কখনোই টিভি রাখবেন না। এমন কী নিজেদের বেডরুমেও টিবি না রাখাই ভাল। লিভিং রুমে টিভি রাখুন। পুরো পরিবার মিলে টিভি দেখলে বাচ্চা নিজেকে পরিবারের সদস্য মনে করবে। তবে তার মানে এই নয় যেসব সময় বড়দের অনুষ্ঠান দেখবেন। বাচ্চা সঙ্গে থাকলে মাঝে মাঝে ওর পছন্দের অনুষ্ঠান দেখলে ওরও ভাল লাগবে।
* সন্তানের কাছ রোল মডেল হয়ে ওঠার চেষ্টা করুন। বাচ্চার জন্য যে নিয়ম বানিয়েছেন নিজেও সেটা মেনে চলুন। বাচ্চাকে বারণ করে যদি আপনি টিভি দেখতে বসে যান, তাহলে বাচ্চা আপনার কথা মানবে না। ভায়োলেন্ট অনুষ্ঠান এড়িয়ে চলুন। রিক্রিয়েশনের মাধ্যম হিসাবে শুধু টিভি বেছে নেবেন না। অন্য কাজে নিজেকে ইনভলভ করুন। এতে আপনার বাচ্চাও অন্য হবি ডেভেলপ করতে উৎসাহ পাবে। ভাল বই কিনে দিন, ইনডোর গেমস আউটডোর স্পোর্টসে এনকারেজ করুন। ছবি আঁকা, স্ট্যাম্প কালেকশন, মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট বাজানো ইত্যাদিতে উৎসাহ দিন। এতে ওর নিয়মিত টিভি দেখার নেশা কমবে।
* বাচ্চাকে শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান দেখতে উৎসাহ দিন। দু’জনে মিলে অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা করুন। নিজেদের মধ্যে কোন মজার খেলা খেলতে পারেন। যেমন ধরুন, অনুষ্ঠান থেকে কী কী শিখলেন, দু’জনেই লিখে ফেলুন। তারপর তালিকা মিলিয়ে দেখুন কার বেশি মনে আছে। ও যদি জেতে তাহলে ওকে ছোটখাটো উপহারও দিতে পারেন। এতে ওর আগ্রহ বাড়বে এবং এই ধরনের অনুষ্ঠান দেখার উৎসাহ পাবে। তবে উপহার পাওয়াটাই যেন একমাত্র কারণ না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
*ছুটির দিনে বাচ্চাকে নিয়ে ঘুরতে যেতে পারেন। মিউজিয়াম, পার্ক, সায়েন্স সেন্টার আমিউজমেন্ট পার্কে নিয়ে যান। এক সঙ্গে নানা ধরনের কাজ করুন, যাতে এর মধ্যে সবকিছু এক্সপ্লোর করার ইচ্ছা জাগে। নিজ থেকে কিছু শেখার অভিজ্ঞতা কিন্তু টিভি থেকে জানার চেয়ে সব সময় আলাদা।
* যে চ্যানলগুলো আপনার মনে হয় বাচ্চার দেখা একেবারেই উচিত হবে না, তাতে পেরেন্টাল লকের ব্যবস্থা করুন। টিভির পরিবর্তে কম্পিউটার বা ভিডিও গেম খেলার উৎসাহ দেবেন না। এতে ওর টিভির নেশা কমে যাবে ঠিকই, কিন্তু পরিবর্তে অন্য এ্যাডিকশন তৈরি হয়ে যাবে। আর টিভির প্রভাব যতটা খারাপ, তা থেকে বেশি না হলেও কম্পিউটার বা ভিডিও গেমের কুপ্রভাবও খুব একটা কম নয়।
শামিমা আক্তার রিমা
মডেল : বর্ণ

No comments

Powered by Blogger.