ফের বিতর্কে দুদকঃ রমেশের ডায়েরি না পাওয়ায় আসামি হননি দুই আবুল by আদিত্য আরাফাত

পদ্মাসেতু প্রকল্পে পরপর দু’বার সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে দায়মুক্তি দেওয়ায় বিতর্কের মুখে পড়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
পদ্মাসেতুর দুর্নীতির মামলায় এজাহারের বর্ণনায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরীর নাম থাকলেও আসামির তালিকায় `কৌশলে` বাদ দিয়েছে দুদক। এ দু’জনকে বাদ দিয়েই সাতজনের বিরুদ্ধে রাজধানীর বনানী থানায় সোমবার মামলা দায়ের করা হয়। এর আগে পদ্মাসেতুর ঠিকাদার নিয়োগে দুর্নীতির অনুসন্ধানে আবুল হোসেনকে `নির্দোষ` দাবি করেছিল দুদক। একই সঙ্গে ‘ঠিকাদার নিয়োগে কোনো দুর্নীতি হয়নি’ বলে বিবৃতি দিয়েছে ‘কাগজে-কলমে স্বাধীন’ এ প্রতিষ্ঠানটি।

এবার পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির অনুসন্ধানে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা মামলা করা হলেও এ মামলা থেকে বাদ পড়েছেন মহাজোট সরকারের বিতর্কিত সাবেক এ যোগাযোগমন্ত্রী।

তবে দুদকের দাবি, আবুল হোসেন ও আবুল হাসানকে ‘দায়মুক্তি’ দেওয়া হয়নি। আসামি না করা হলেও এজাহারে সন্দেহভাজন হিসেবে তাদের নাম রয়েছে।

সোমবার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দুদকের পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘‘এসএনসি লাভালিনের কর্মকর্তা রমেশ শাহের নোটবুক না পাওয়ায় সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। নোটবুকের অনুলিপি পাওয়া মাত্রই আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’’

মামলার বাদী ও দুদকের জ্যেষ্ঠ উপ-পরিচালক আবদুল্লাহ-আল জাহিদ ব্রিফিংয়ে বলেন, “পরিতাপের বিষয়, আমরা বাংলাদেশে যা পেয়েছি (জিজ্ঞাসাবাদের তথ্যানুযায়ী) তা দিয়ে মামলা করেছি। কানাডা থেকে এখনও আমরা রমেশের নোটবুকের অনুলিপি, প্রতিলিপি, ফটোকপি কিংবা কোনো ডকুমেন্ট পাইনি। তবে খুব শিগগিরই পাবো বলে আশা করছি। পাওয়ার পরই এই দু`জনের (আবুল হাসান ও আবুল হোসেন) বিরুদ্ধে দালিলিক তথ্য-প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

দুদকের অনুসন্ধান দলের প্রধান এ কর্মকর্তা আরও বলেন, “পদ্মাসেতু প্রকল্পে কাজ হওয়ার কথা ছিল পাঁচটি প্যাকেজে। পরামর্শক নিয়োগ তার মধ্যে একটি। এই প্রকল্পে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে। আর দুই জনকে অভিযুক্তের সন্দেহের তালিকায় রাখা হয়েছে। এই দুই জনের বিরুদ্ধে যখনই যথাযথ তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যাবে, তখনই তাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।”

জাহিদ বলেন, ‘‘অনুসন্ধানকালে আপাতত যা পেয়েছি, তার ভিত্তিতে সাতজনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে।’’

তিনি দাবি করেন, “মামলার পর (দুদকের আইনি ধারা অনুযায়ী অনুসন্ধানের পর তদন্ত) এখন তদন্ত করতে সুবিধা হবে। মামলা দায়েরের পর আইনি ক্ষমতাবলে জব্দ তল্লাশি করার অধিকার দুদক আইনে রয়েছে।’’

এ প্রকল্পে কাজ পেতে ঘুষের পার্সেন্টেজের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “বিশ্বব্যাংক পার্সেন্টেজের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য দেয়নি। নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজের বিষয়ে দুদকের কাছে কোনো তথ্য নেই।”

সাবেক দুই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা না করতে কোনো চাপ ছিলো কি-না? এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “সরকার কিংবা কোনো পক্ষের চাপ ছিলো না।’’

কৌশলে সরকারের সাবেক দুই মন্ত্রীকে মামলা থেকে বাঁচানো হয়েছে কি-না? এ প্রশ্নের উত্তরে মামলার এ বাদী বলেন, “আড়াল করার চেষ্টা থাকলে এজাহারে দু’জনের নাম আসতো না। রমেশের ডায়েরির অনুলিপি, প্রতিলিপি দুদকে নেই এবং বিশ্বব্যাংক থেকেও কানাডা পুলিশের জব্দকৃত ডায়েরির অনুলিপি দেওয়া হয়নি। তদন্তে এখন আমরা তা বের করবো। তদন্তে এ সুযোগ রয়েছে।”

তিনি জানান, ‘‘৪৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন করতে হয়। বিশেষ ক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১৫ দিন দেওয়া হয়। এর মধ্যেই তদন্ত সম্পন্ন করতে হয়।’’

‘‘এ সময়ের মধ্যে রমেশের ডায়রির অনুলিপি বা প্রতিলিপি পেতে আইনি প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে দুদক”-এমনটাও মন্তব্য করেন এ কর্মকর্তা।

তিনি বলেন, “রমেশের ডায়েরি কানাডার আদালতে রয়েছে। সার্টিফাইড কপি পেতে আইনের সাহায্য নেওয়া হবে।”

প্রসঙ্গত, কানাডিয়ান পুলিশ তদন্তকালে এসএনসি-লাভালিনের অফিস থেকে পদ্মাসেতু প্রকল্পের কাজকর্ম সংক্রান্ত একটি ডায়েরি জব্দ করে। ওই ডায়েরিতে ঘুষের টাকা দাবি সংক্রান্ত তালিকাটি পাওয়া যায়। কানাডিয়ান পুলিশ তদন্তের কিছু তথ্য-উপাত্তসহ নামের তালিকাটি বিশ্বব্যাংকে পাঠায়। বিশ্বব্যাংক গত জুনের মধ্যে ওই তালিকা দুদকে পাঠিয়েছে।

জানা গেছে, কানাডায় এসএনসি-লাভালিনে কর্মরত কর্মকর্তা রমেশ শাহ পদ্মা সেতুর ঘুষের তালিকা তৈরি করেছেন। তদন্তে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, কানাডায় এসএনসি-লাভালিন কর্মকর্তা রমেশ শাহ ও মো. ইসমাইল হোসেনকে গ্রেফতার করেছিল কানাডিয়ান পুলিশ। বর্তমানে তারা জামিনে মুক্ত আছেন।

এজাহারে আবুল, মামলায় নেই!
এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, “দরপত্র প্রক্রিয়াকরণের বিভিন্ন পর্যায়ে তদানিন্তন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন কানাডিয়ান পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এসএনসি-লাভালিনের  এবং অন্যান্য প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকার প্রদান করছেন। এসএনসি লাভালিনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রাক্তন মন্ত্রীর সাক্ষাতের ক্ষেত্রে সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আবুল হাসান চৌধুরী যোগাযোগ স্থাপনকারীর ভূমিকা পালন করেছেন। তাছাড়া রমেশ শাহের (এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট) নোটবুকে কাজ পাওয়ার পর পদ্মা পিসিসি (প্রজেক্ট কমার্শিয়াল কস্ট/ প্রজেক্ট কমিটমেন্ট কস্ট) হিসেবে দরপত্র মূল্যের বিভিন্ন পার্সেন্টেজ প্রদানের হিসাবে তাদের বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে।’’

‘‘তবে আলোচ্য ক্ষেত্রে ষড়যন্ত্রমূলক কার্যক্রম পরিচালনা সংক্রান্ত অপরাধ সংঘটনে আবুল হাসান চৌধুরী ও সৈয়দ আবুল হাসানের ভূমিকা রাখার বিষয় অপরাপর সাক্ষীদের সাক্ষ্য বা পরিপূরক সাক্ষ্য এ যাবৎ অনুসন্ধাণকালে সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। অপরাধ সংঘটন সৈয়দ আবুল হোসেন ও আবুল হাসান চৌধুরীর অপরাধ সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি তদন্তকালে খতিয়ে দেখা হবে।”

মামলায় আসামি হলেন যারা-
মামলার আসামিরা হচ্ছেন- সাবেক সেতুসচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগে দরপত্র মূল্যায়নে গঠিত কমিটির সদস্য সচিব কাজী মো. ফেরদৌস, সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) নির্বাহী প্রকৌশলী রিয়াজ আহমেদ জাবের, ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড প্ল্যানিং কনসালট্যান্ট লিমিটেডের (ইপিসি) উপ-পরিচালক মো. মোস্তফা, এসএনসি লাভালিনের সাবেক পরিচালক (আন্তর্জাতিক প্রকল্প বিভাগের) মোহাম্মদ ইসমাইল, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট রমেশ শাহ ও কেভিন ওয়ালেস।

এ সাতজনের বিরুদ্ধে এজাহারে উল্লেখ রয়েছে, ‘‘আসামিগণ ১৯৬১ এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় অপরাধ করার অভিপ্রায়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেন। যা দণ্ডবিধির ১২০ (বি) ধারা মোতাবেক শাস্তিযোগ্য অপরাধ।’’

এজাহারে আরও উল্লেখ রয়েছে, ‘‘পদ্মাসেতু প্রকল্পের নির্মাণ কাজে পদ্মা বহুমূখী সেতু প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি পরামর্শক হিসেবে এসএনসি-লাভালিন ইন্টারন্যাশনাল কাজ পেলে ঘুষ লেনদেন সম্পন্ন হতো।’’

এজাহারে ঘটনার সময়কালে ধরা হয় ২০১০ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত এবং ঘটনাস্থল হলো রাজধানীর মহাখালীর সেতু ভবন।

এজাহারে থেকে আরো জানা গেছে, পরামর্শক নিয়োগে সৈয়দ আবুল হোসেন এবং আবুল হাসান চৌধুরীসহ ২০১১ সালের ২৯ মে এসএনসি লাভালিনের ভাইস প্রেসিডেন্ট কেভিন ওয়ালিস, রমেশ শাহ, আর্ন্তজাতিক প্রকল্প বিভাগের সাবেক পরিচালক মো. ইসমাইল এবং ইপিসি উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মোস্তফার সঙ্গে ঢাকায় বৈঠক করেন। এরপর ১৯ জুন যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে কানাডার এসএনসি লাভালিনের অনুকূলে কার্যাদেশ দেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

মামলার ১ নম্বর আসামি মো. মোশাররফ হোসেন ও ২ নম্বর আসামি তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌসের বিষয়ে এজাহারে বলা হয়, ‘‘পদ্মাসেতু প্রকল্পের নির্মাণ তদারকি পরামর্শক নিয়োগের কারিগরি ও আর্থিক প্রস্তাব মূল্যায়নের লক্ষ্যে গঠিত কমিটি বিলুপ্ত না করেই বা সংশ্লিষ্ট নথিতে প্রস্তাব উপস্থাপন না করেই বার বার কমিটি ভেঙে চতুর্থবারে সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া নিজেকে আহ্বায়ক করে ৭ সদস্যের কমিটি গঠন করেন। এবং তিনি কাজী ফেরদৌসের সঙ্গে মিলিত হয়ে প্রথমে জাপানি কোম্পানি ওরিয়েন্টাল কনসালটেন্ট কোম্পানিকে ও পরবর্তীতে এসএনসি লাভালিনকে কার্যাদেশ প্রদানে অপপ্রয়াস চালান। এই কমিটি দিয়ে তাদের কার্য সিদ্ধি না করতে পেরে ২০১০ সালের ৪ নভেম্বর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বয়ক করে ৫ম বারের মতো কমিটি পুনর্গঠন করা  হয়। যা মূল্যায়ন কমিটির সদস্যদের জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায়। এছাড়া এসএনসির মো. ইসমাইল, রমেশের সঙ্গে তারা নিয়িমিত ই-মেইলের মাধ্যমে গোপন সম্পর্ক রক্ষা করে টেন্ডার প্রক্রিয়ার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গোপন তথ্যাদি সরবরাহ করতেন বলে দুদক প্রমাণ পেয়েছে।’’

‘‘৩ নম্বর আসামি সড়ক ও জনপথের নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী ফেরদৌসের বন্ধু রিয়াজ আহমেদ জাবের এ কাজে তাদের সহযোগিতা করেন। এ সময় ৪ নম্বর আসামি এসএনসি লাভালিনের বাংলাদেশের সাব কনসালট্যান্ট ইপিসির ডিএমডি মো. মোস্তফা এই অসাধু চক্রের সঙ্গে যোগ হন।’’

‘‘এক পর্যায়ে মো. ইসমাইল চাকুরিচ্যুত হলে মো. মোস্তফা ৭ নং আসামি এসএনসি লাভালিনের কেভিন ওয়ালিসের সঙ্গে গোপন ই-মেইল আদান-প্রদান করে আস্থা পুনঃস্থাপন করার চেষ্টা চালান। এক্ষেত্রে সচিব মোশাররফ হোসেনের ইচ্ছানুযায়ী ঢাকায় মোস্তফা, রমেশ ও ওয়ালিস ২৯ এপ্রিল মন্ত্রীসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। অতপর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন না হওয়া সত্ত্বেও এসএনসি লাভালিনকে কার্যাদেশ পাওয়ার ব্যাপারে সুপারিশ করা হয়।’’

পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে ২০১১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর অনুসন্ধান শুরু হয়ে শেষ হয় নভেম্বরের শেষ সাপ্তাহে। এ পর্যায়ে ১৪ অক্টোবর ও ১ ডিসেম্বর দু’দফায় বিশ্বব্যাংকের বিশেষজ্ঞ প্যানেল ঢাকা সফরে এসে কিছু গাইড-লাইন দিয়ে যায়। দুই সফরেও সন্তুষ্ট হয়নি দাতা সংস্থাটি।

পদ্মাসেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষ ১শ’ ২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করে গত ২৯ জুন।

পরে সরকার অভিযোগ অনুসন্ধানে বিশ্বব্যাংক কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি সই করার পর ‘শর্তসাপেক্ষে’ বিশ্বব্যাংক আবার অর্থায়নে ফিরে আসার ঘোষণা দেয় গত ২০ সেপ্টেম্বর। গত ৮ ডিসেম্বর বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, দুদক নিরপেক্ষ তদন্ত না করলে পদ্মাসেতু প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না দাতা সংস্থাটি।

No comments

Powered by Blogger.