প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইন-অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মচারী গ্রেপ্তার নয়! by আশরাফুল হক রাজীব

সরকারি কর্মচারীরা অপরাধ করলেও গ্রেপ্তার এড়াতে চান; তাই প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইনে সরকারের পূর্বানুমোদন ছাড়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করা যাবে না- এ রকম বিধান রাখা হয়েছে। এ ধরনের বিধান এর আগের খসড়া আইনে ছিল না।
নতুন করে এটা সংযোজন করে বলা হয়েছে, 'আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হইবার পূর্বে কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের প্রয়োজন হইলে সরকারের পূর্বানুমোদন লাগিবে।' প্রস্তাবিত আইনের এ ধারাটি প্রচলিত অন্যান্য আইনের পরিপন্থী।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) আইন এবং বাংলাদেশ সার্ভিস রুলে (বিএসআর) মামলা হলেই কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের বিধান রয়েছে। দুদক আইনেই পদ্মা সেতু মামলায় সেতু বিভাগের সাবেক সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ও সেতু কর্তৃপক্ষের নদী শাসন বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফেরদৌসকে গত বুধবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তদন্ত শেষে এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হবে। আইনের আওতায়ই তাঁদের গ্রেপ্তারে সরকারের কোনো পূর্বানুমোদন লাগেনি।
সরকারি কর্মচারীরা সব সময়ই গ্রেপ্তারের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছিলেন। দুদক আইন প্রণয়নের সময়ও তাঁরা তাঁদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সরকারের পূর্বানুমোদনের বিষয়টি খসড়া আইনে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছিলেন। তবে সংসদে চূড়ান্ত আইন পাস হওয়ার সময় তা বাদ দেওয়া হয়।
সরকারি কর্মচারী আইনে কর্মচারীদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে সরকারের পূর্বানুমোদনের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম কালের কণ্ঠকে বলেন, 'বিষয়টি খসড়া আইনে এসেছে। আমরা চিন্তাভাবনা করে দেখব।'
সাধারণ আইনে মামলার আগে সরকারি কর্মচারীরা বিভাগীয় তদন্ত চেয়েছেন। সেই তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলেই আদালতে যাওয়ার বিধান করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। গতকাল বৃহস্পতিবার সরকারি কর্মচারী আইনের ওপর এক মতবিনিময় সভায় মামলা ছাড়াও প্রশাসনে আউটসোর্সিং, প্রশিক্ষণে ফেল করলে চাকরিচ্যুতি, সংক্ষোভ নিরসন কর্তৃপক্ষ গঠন, লিখিত পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতির বিধান আলোচনায় উঠে আসে। সোনারগাঁও হোটেলে দিনব্যাপী আলোচনায় ২৬টি ভিন্ন ভিন্ন ক্যাডারের সভাপতি বা মহাসচিব, কর্মচারী সংগঠনগুলোর নেতারা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর জনপ্রশাসনবিষয়ক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম ও পররাষ্ট্রবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী উপস্থিত ছিলেন। সিভিল সার্ভিস চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট প্রোগ্রামের আওতায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় খসড়া আইনের ওপর মতবিনিময় সভার অয়োজন করে।
মতবিনিময় সভায় সরকারি কর্মচারীরা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে সচিবসহ যেকোনো পর্যায়ে লোক নিয়োগের বিরোধিতা করেন। তাঁরা স্পষ্ট করে বলেছেন, 'আমরা আউটসোর্সিং চাই না।' প্রস্তাবিত সরকারি কর্মচারী আইন থেকে এ ধারা বাদ দেওয়ার দাবি করেছেন তাঁরা। আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ রাখা হলে সরকার যেকোনো পর্যায়ে বেসরকারি লোক নিয়োগ দিতে পারবে। এই সুযোগে প্রশাসনে নগ্ন রাজনৈতিকীকরণ হবে।
মতবিনিময় সভায় স্থানীয় সরকার সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, 'প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী আইনে আউটসোর্সিং রাখার দরকার নেই। কারণ ভবিষ্যতে এ ধারার অপব্যাখ্যা হতে পারে।' এ ছাড়া আউটসোর্সিংয়ের বিরোধিতা করে সভায় বক্তব্য দিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সোহরাব হোসেন, অতিরিক্ত কর কমিশনার ফজলুল হক, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোতাহার হোসেন, বিসিএস সমন্বয় কমিটির প্রচার সম্পাদক স ম গোলাম কিবরিয়া এবং সরকারি কর্মচারী সমন্বয় পরিষদের সভাপতি নিজামুল হক ভূঁইয়া মিলনসহ আরো অনেকে।
কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিরোধিতা করলেও সরকারের দুই উপদেষ্টা আউটসোর্সিংয়ের পক্ষে মত দেন। আলোচনায় এইচ টি ইমাম বলেন, সরকারের দক্ষতা বাড়ানোর জন্যই আউটসোর্সিং দরকার। নিচের পদের নিয়োগ পরীক্ষা নিয়ে নানা অভিযোগ ওঠে। আউটসোর্সিং করা হলে এ প্রশ্ন উঠবে না। আর বেসরকারি খাত অনেক এগিয়েছে। গ্রামীণ ব্যাংক, বেঙ্মিকোসহ নানা সংস্থায় করপোরেট কালচার চালু হয়েছে। তাদের সেবা নেওয়া হলে সরকারই লাভবান হবে।
এ প্রসঙ্গে গওহর রিজভী বলেন, আউটসোর্সিং নিয়ে একটি বিরোধী মতামত গড়ে উঠেছে। কিন্তু বেসরকারি দক্ষতা কাজে লাগানোর বিষয়টি আলোচনায় আসছে না। যাদের কোয়ালিটি আছে তাদের সেবা নেওয়ার মানসিকতা থাকা দরকার।
সরকারি কর্মচারী আইনে পদোন্নতির জন্য কর্মকর্তাদের পরীক্ষায় বসতে হবে। প্রথম পর্যায়ের খসড়া আইনে এ বিষয়টি স্থান পেলেও কর্মকর্তাদের চাপে পরে তা বাদ দেওয়া হয়। নতুন করে আবার তা খসড়া আইনে স্থান পেয়েছে। উল্লেখ্য, প্রশাসনের কর্মকর্তারা পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি পেতে আগ্রহী নন। তাঁদের যুক্তি, একবার পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়েছি, আবার পরীক্ষা কিসের? উল্লেখ্য, পরীক্ষার বিধান না থাকার কারণে মেধাবী কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন না। দলবাজ কর্মকর্তারা মেরিট লিস্টের পেছনে থেকেও পদোন্নতি পাচ্ছেন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আবদুল্লাহ বলেছেন, কতবার লিখিত পরীক্ষায় ফেল করলে পদোন্নতির পরিবর্তে চাকরিচ্যুতি ঘটবে, আইনে এর উল্লেখ থাকা দরকার।
নতুন খসড়া আইনে প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে 'সংক্ষোভ নিরসন কর্তৃপক্ষ' গঠন করার কথা রয়েছে। এই কর্তৃপক্ষ গঠন নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। কর্মচারীদের ক্ষোভ নিরসনের ব্যবস্থা হিসেবে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। বিসিএস সমন্বয় কমিটির মহাসচিব ফিরোজ খান বলেন, নতুন কর্তৃপক্ষ না করে প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালকে গতিশীল করুন।
খসড়া আইনে কর্মকর্তারা বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে ফেল করলে তাঁদের চাকরিচ্যুতির কথা রয়েছে। কিন্তু এ ধারার বিরোধিতা করেছেন কর্মকর্তারা। তাঁরা চান, ফেল করলেও তাঁদের যেন চাকরিচ্যুত করা না হয়। নতুন আইনে কোটা পদ্ধতি আরো সম্প্রসারণ করার কথা রয়েছে। কিন্তু জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সোহরাব হোসেন বলেছেন, কোটার কারণে মেধাবীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। মেধাবীরা পিছিয়ে পড়ছেন। বর্তমানে ৫৫ ভাগ নিয়োগ হচ্ছে কোটার ভিত্তিতে। মাত্র ৪৫ ভাগ মেধাবী চাকরি পাচ্ছেন। এই কোটা আরো বিস্তৃত হলে প্রশাসনের ওপর খারাপ প্রভাব পড়বে।
সংবিধানের ১৩৩ অনুচ্ছেদের বিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিয়োগ, কর্মসম্পাদন ও আনুষঙ্গিক বিষয়ে আইন প্রণয়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এর পরও গত ৪১ বছরে সেই আইন প্রণিত হয়নি। জনপ্রশাসনসচিব আবদুস সোবহান সিকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, শিগগির আইনটি মন্ত্রিসভায় নেওয়া হবে। এ আইন প্রণীত হলে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব অভিযোগ আছে, তা বন্ধ হবে।

No comments

Powered by Blogger.