ঐতিহ্য-গোল্লাছুট প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতা ২০১১- আগামীর লেখকেরা by জিয়াউর রহমান চৌধুরী

ছোটরা ফুটবল খেলে, স্কুলের ছুটিতে দাদাবাড়ি যাওয়ার বায়না ধরে, কখনো রং-তুলি নিয়ে আঁকতে চায়...। এ রকম ছোটদের কথা আমাদের সবারই জানা। কিন্তু এমন দামাল খুদেদের রাজ্যের বাইরেও একদল খুদেবন্ধু আছে, যারা স্কুলের পরীক্ষায় প্রথম হলে খেলনার বদলে উপহার চায় ‘বই’।
বড়দের মতো তারা দেশের সমস্যা-সম্ভাবনার কথাও ভাবে! এদের আছে মনের খাতা ও কলম। মনের পটে আঁকা ছবিগুলোকে লেখার মাধ্যমে প্রকাশ করতে চায় তারা। তাই বাড়ির সামনের আমগাছটির কষ্টও তাদের চোখ এড়ায় না। কখনো বা স্কুলের অঙ্ক খাতাতেই লিখে ফেলে এক-দুই লাইন। এসব খুদে বন্ধুর কথা শুনতে শুনতে তোমরা যারা এখন একপলক দেখতে চাও তাদের, তোমাদের একটু হতাশই হতে হবে। কারণ, পুরস্কার বিতরণ উপলক্ষে খুদে বন্ধুদের সেই মিলনমেলা শেষ হয়েছে ২২ ডিসেম্বর।
অনুষ্ঠানের কথা এবার তবে ভেঙেই বলি। সেদিন ছিল ‘ঐতিহ্য-গোল্লাছুট প্রথম আলো গল্পলেখা প্রতিযোগিতা’-এর পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান। জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তনে এই অনুষ্ঠানেই বসেছিল খুদে লেখকদের মিলনমেলা।
হ্যাঁ, সেদিন ১৮৫ জন ছোট্ট লেখক বন্ধুর দেখা মিলেছিল এই পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠানে। গল্প লিখে পুরস্কার নিতে হাজির সবাই। তাই প্রত্যেকের মুখেই জমাটবাঁধা উচ্ছ্বাস। নিবন্ধন আর অনুষ্ঠান শুরুর অপেক্ষার পালা শেষ করে সবাই তখন পুরস্কার নেওয়ার অপেক্ষায়।
অতিথিদের মঞ্চে আগমনের মধ্য দিয়ে শুরু হলো অনুষ্ঠান। খুদে লেখকদের পুরস্কার আর উৎসাহ দিতে এসেছেন সাংসদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আসাদুজ্জামান নূর, প্রতিযোগিতার প্রধান বিচারক ও শিশুসাহিত্যিক কাইজার চৌধুরী, প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্যের প্রধান নির্বাহী আরিফুর রহমান, কথাসাহিত্যিক ও প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আনিসুল হক এবং সম্পাদক মতিউর রহমান। আর সঞ্চালক হিসেবে বরাবরের মতো এবারও হাজির প্রথম আলোর ফিচার সম্পাদক সুমনা শারমীন।
এদিকে এতসব প্রিয়মুখ দেখে দর্শকসারিতে ততক্ষণে খুশির ঝিলিক।
কথা আর গানের মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলল অনুষ্ঠান। আরিফুর রহমান খুদে লেখকদের স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘ঐতিহ্য ২০০৫ সাল থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে এই প্রতিযোগিতায় যুক্ত আছে। তোমাদের মধ্য থেকে আগামীর লেখক বেরিয়ে আসবে—এটাই আমাদের চাওয়া।’
এরপর আসাদুজ্জামান নূরের বক্তব্য—‘তোমাদের শুধু ভালো লেখক হলেই চলবে না, ভালো মানুষও হতে হবে। কারণ, দেশকে সামনে এগিয়ে নিতে হলে ভালো মানুষের প্রয়োজন সবার আগে।’ এসব কথা বলে যখন বক্তৃতা শেষ করছেন আসাদুজ্জামান নূর, তখনই দর্শকদের পক্ষ থেকে অনুরোধটি এল। সঞ্চালক সবার সেই অনুরোধে সম্মতি জানিয়ে যেন আরও জোরদার করলেন অনুরোধকে। ফলে আসাদুজ্জামান নূরকে দেখা গেল আবৃত্তিকারের ভূমিকায়। এবার সৈয়দ শামসুল হকের কাব্যনাটক নূরুলদীনের সারাজীবন-এর প্রস্তাবনা অংশ আবৃত্তি করছেন তিনি। মিলনায়তনজুড়ে তখন পিনপতন নীরবতা।
ওদিকে বক্তব্যের ফাঁকে এগিয়ে চলছে পুরস্কার বিতরণের কাজও। এ সময় সঞ্চালক সবাইকে মনে করিয়ে দিলেন, ‘তোমরা ১৮৫ জন সকলেই সেরা। কারণ, প্রায় আট হাজার ৭৭৮ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে তোমরা এখানে এসেছ। সুতরাং তোমরাও কম নও।’
চারপাশে যেন শ্বাস রোধ করা উত্তেজনা। শুরুতেই গ বিভাগের পুরস্কার। গ বিভাগের প্রথম পুরস্কার পাওয়া গল্পটি লিখেছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজের মালিহা তাসনিম। গল্পটি একটি মুরগির বিড়ম্বনা নিয়ে। তাই পুরস্কার নেওয়ার সময় মালিহাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘এই গল্পের আইডিয়া তোমার মাথায় এল কীভাবে?’ মালিহা বলল, ‘ঘটনাটা ঘটেছিল আমার দাদাবাড়িতে। সেখানে এ রকম একটা মুরগি হারিয়ে গিয়েছিল। আর তখনই গল্পের প্লটটা মাথায় আসে আমার।’ এরপর সঞ্চালক বললেন, ‘মালিহা, যেহেতু প্লট বলেছে, তাহলে সে তো লেখক হয়েই গেছে!’ এবার আরও জোরে হাততালি।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে শিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ ও কনার গান মুগ্ধতার আবেশ ছড়াল চারদিকে। সেই আবেশ দ্বিগুণ হলো যখন মঞ্চে পা রাখলেন নতুন কুঁড়ির এক সময়ের খুদে তারকা ঈশিতা। ছোট্ট বন্ধুদের উৎসাহিত করে এ সময় তিনি বললেন কয়েক টুকরো কথা।
তবে গানের শিল্পী কনার কথাও কম অনুপ্রাণিত করেনি লিখিয়েদের। তিনি শোনালেন তাঁর ছোটবেলার কথা।
খুদে বন্ধুদের এই অনুষ্ঠানে তাঁদের প্রতিনিধি থাকবে না তা কি হয়? তাই তো অনুষ্ঠানের একপর্যায়ে খুদে লেখকদের উৎসাহ দিতে মঞ্চে এল আমার বন্ধু রাশেদ চলচ্চিত্রে রাশেদ চরিত্রে অভিনয় করা আফনান।
আফনানকে দেখে দর্শকসারিতে জেগেছে প্রাণচাঞ্চল্য। দর্শকসারি থেকে তখন কেবল ‘আফনান আফনান’ স্লোগান। কেউ কেউ আফনানের সঙ্গে ভাইয়াটাও জুড়ে দিল। এ সময় আফনান সবার উদ্দেশ্যে বলল, ‘পড়াশোনার পর আমার যা করতে ইচ্ছে করে তা-ই করি। তাই তোমারও পড়াশোনাটা ঠিক রেখে বাকি সব কিছু করবে। জানবে মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের ইতিহাস। কারণ মুক্তিযুদ্ধ অনেক গৌরবের ধন, আমাদের অনেক বড় অর্জন এটি।’
এরপর আফনানকে প্রশ্ন করলেন সুমনা শারমীন, ‘রাশেদ চরিত্রে অভিনয় করতে তোমার কেমন লেগেছে?’ আফনানের উত্তর, ‘বইতে রাশেদের চরিত্রটা পড়েছি। কিন্তু চলচ্চিত্রে রাশেদের চরিত্রে অভিনয় করার যে অনুভূতি তা সত্যিই অসাধারণ! যখন আমাকে গুলি করে মেরে ফেলা হয় ওই সময় মুক্তিযুদ্ধের আবেগ আর আবহটা মনে হয় সবচেয়ে ভালোভাবে বুঝতে পেরেছি।’
রাশেদের এমন উত্তরে আবারও নীরব মিলনায়তন। আফনানের বক্তব্য শেষে কে কার আগে তাঁর অটোগ্রাফ নেবে এই নিয়ে শুরু হয়েছে প্রতিযোগিতা। এক্ষণে অটোগ্রাফ নিতে আসন ছেড়ে সুবিধামতো জায়গায় অবস্থান নিয়েছে খুদে অটোগ্রাফশিকারিরা। পরে অবশ্য ভিড়ের কারণে তাদের মিলানায়তনের বাইরে গিয়ে অটোগ্রাফ নিতে হয়।
এর মধ্যে একসময় মঞ্চে এলেন আনিসুল হক। খুদে লিখিয়েদের তিনি শোনালেন নানা গল্প। বললেন, ‘লেখক হতে গেলে কোনো বিশেষ বিদ্যালয়ে পড়তে হয় না। কিন্তু পড়তে হয় বড়, মহৎ সব লেখকের লেখা।’
কাইজার চৌধুরীর গল্প লিখিয়েদের প্রশংসা করে বলেন, ‘লেখাগুলো পড়তে গিয়ে মনে হলো, তোমরা দেশকে নিয়ে ভাবো। তোমাদের এ ভাবনাই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।’
আর অনুষ্ঠানের শেষ বক্তা মতিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে বললেন দেশের সাফল্যের কথা। তিনি বলেন, ‘দেশ অনেক ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তোমাদেরও এগিয়ে যেতে হবে। তোমাদের সামনে এখন অনেক সুযোগ।’ মতিউর রহমানের কথায় দর্শকসারি থেকে একজন বলে উঠল, ‘হ্যাঁ, পারব, আমারাও পারব...।’
একে একে সব বিভাগের পুরস্কার দেওয়া শেষ। এবার সঞ্চালক বললেন, ‘তোমরা যারা পুরস্কার পাওনি তাদের কি মন খারাপ?’ অমনি লিখিয়েরা দিল ঝটপট উত্তর, ‘আমরা পুরস্কার পাইনি তো কী হয়েছে? অন্যরা তো পেয়েছে। আগামীবার আমরাও পাব।’
তিন বিভাগের পুরস্কার দেওয়ার পর এখন শুধু বাকি সর্বশ্রেষ্ট এক লাখ টাকার বইয়ের পুরস্কারটি।
এবার সবার সেরা পুরস্কারপ্রাপ্ত গল্পটি বলতে শুরু করলেন সুমনা শারমীন।
সঞ্চালকের মুখে গল্প শুনতে শুনতে আনমনা দর্শক। প্রতিযোগিতার সেরা গল্প লিখিয়ে অর্ঘ্য দত্ত মঞ্চে চলে এসেছে ততক্ষণে। কিন্তু কোনো হাততালি নেই! কারণ, সবাই যেন তার গল্পের নায়ক অপুকেই দেখছে এখন।
সঞ্চালকের কথায় আবার সংবিৎ ফিরে এসেছে সবার । অর্ঘ্যর সাথে তার বাবা-মাকে ডেকে নেওয়া হয়েছে মঞ্চে। কিন্তু আবেগে কথা বলতে পারছেন না বাবা-মা। আর অর্ঘ্যর প্রতিক্রিয়াটা এমন, ‘গল্পটা আমার নিজের জীবনের নয়। তবে ভাবনা থেকেই এমন গল্প লিখেছি। কিন্তু পুরস্কারটা যে সত্যিই পেয়ে যাব তা ভাবিনি!’ অর্ঘ্য ও তার বাবা-মায়ের জন্য এবার হাততালির বৃষ্টি নামল।
সেদিন এত এত পুরস্কারের পরও সবার জন্য ছিল আরেকটি পুরস্কার—সেরা গল্পগুলো নিয়ে ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করলেন অতিথিরা।
সব আয়াজন যখন শেষ, তখন ১৮৫ জন খুদে লিখিয়ে সবার দুই চোখে চিকচিক করছে স্বপ্ন। তাদের ওই স্বাপ্নিক অভিব্যক্তি দেখে মনে হয়, নিশ্চয়ই একদিন বাংলাদেশকে বদলে দেবে তারা।

No comments

Powered by Blogger.