পোশাকশিল্প-জীবন্ত দগ্ধ কঙ্কালগুলো এখনও আমার চারপাশে by রাশেদ মেহেদী

পঁচিশ নভেম্বরের পর এক মাসেরও বেশি সময় পার হতে চলেছে। কোনো কাজে মন দিতে পারছি না। চলতে-ফিরতে কিংবা লিখতে বসে চোখের সামনে দেখি কতগুলো পোড়া কঙ্কাল। কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করলেই রক্তের আঁশটে গন্ধমাখা কিছু ছাই মনে হয় নাখে, মুখে, চোখে লেগে যাচ্ছে।
রাতে ঘুমোতে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করলেই কেমন একটা গোঙানির শব্দ পাই। মনে হয় চোখ খুললেই দেখব ঘরের ভেতর এখানে-সেখানে পড়ে আছে জীবন্ত দগ্ধ মানুষের কঙ্কালের সারি, বীভৎসভাবে পুড়ে যাওয়া এক বধ্যভূমি, যেখানে লোহা, ইস্পাত, কাপড়ের টুকরোর সঙ্গে আবর্জনার স্তূপ হয়ে পড়ে আছে পুড়ে যাওয়ার মানবদেহের এক টুকরো হাত, কান, চুল, চোখ।
নিশ্চিন্তপুরের তাজরীন ফ্যাশনের কারখানায় আগুন লাগার পর পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য সেই রাতেই (২৪ নভেম্বর) ঘটনাস্থলে যেতে হয়েছিল। একেবারে কাছ থেকে দেখেছিলাম দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা প্রাণপণ চেষ্টা করছেন আগুন নেভাতে। রাত ১২টায় যখন প্রথম রিপোর্ট লিখতে বসেছি তখনই খবর পেলাম ঘটনাস্থলে এসেছেন তাজরীন ফ্যাশনের মূল প্রতিষ্ঠান তোবা গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সুমন ফারুক। চোখের সামনে তার প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হওয়ার দৃশ্য দেখেও এই মানুষটির চোখে-মুখে কোনো উদ্বেগের ছাপ দেখিনি। অনেকটা নির্বিকার ভঙ্গিতে উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি প্রথমেই জানালেন, আগুনে এরই মধ্যে তাদের প্রায় ২০০ কোটি টাকার সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। জানতে চাইলাম, আগুন লাগার সময়ে কারখানায় কত মানুষ ছিলেন, ভেতরে কী পরিমাণ মানুষ আটকা পড়েছে বলে তাদের ধারণা। তিনি চটপট জবাব দিলেন, ভেতরে কেউ আটকা নেই বলে তারা মোটামুটি নিশ্চিত হয়েছেন। আগুন লাগার সময় স্টাফ ও শ্রমিক মিলিয়ে প্রায় সাড়ে পাঁচশ' লোক ছিলেন। তাদের সবাই বের হয়ে গেছেন। তখন পর্যন্ত যে আটজনের মৃতদেহ পাওয়া গেছে তারা সবাই লাফ দিয়ে নামতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন, আগুনে পুড়ে কেউ নিহত হননি। লাফ দিয়ে নামতে হলো কেন, আগুন লাগার সময় কি কারখানার সব দরজা বন্ধ ছিল_ উপস্থিত আর একজন সাংবাদিকের এই প্রশ্ন এড়িয়ে সুমন ফারুক চলে গেলেন।
সুমন ফারুক কেন শেষ প্রশ্নের জবাব দেননি, তার উত্তর জানা গেল আরও কয়েক ঘণ্টা পর। ভোর সাড়ে ৪টার দিকে যখন একের পর এক পুড়ে অঙ্গার হওয়া মৃতদেহ কিংবা দেহের টুকরো পলিথিনের প্যাকেটে ভরছিলেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা, তখন আর কারও বলে দিতে হয়নি, আগুন লাগার পর বের হওয়ার পথ না পেয়েই তারা জীবন্ত দগ্ধ হয়েছেন। উদ্ধার করা অধিকাংশ মৃতদেহের শুধু কঙ্কাল, কাউকে চেনার উপায় নেই। মানুষগুলো শুধু অপঘাতে জীবনই দিল না, হাজারো স্বজনের আহাজারির মাঝেই 'বেওয়ারিশ লাশে'র তালিকায় উঠে নাম-ঠিকানাও হারাল। তাজরীন ফ্যাশনের বধ্যভূমি থেকে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা তখন পলিথিনে ভরছেন অসংখ্য হাত, পা, চুল, মুখমণ্ডলের খণ্ডিত অংশ। চোখের সামনে যে ভয়াবহতা দেখেছি তার বর্ণনা আর বাড়ানো সম্ভব নয়, প্রথম দিনের রিপোর্টেও লেখা যায়নি। কারণ সেই ভয়াবহতার পুরো চিত্র তুলে ধরলে হাজার হাজার শ্রমজীবী মানুষকে মৃত্যুর দুয়ারে রেখে যারা সমাজ-সংসারে জাতে উঠেছেন, তারা অসুস্থবোধ করতে পারেন।
তাজরীন ফ্যাশনের ধ্বংসস্তূপে ঢুকে মনে হয়েছিল, দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শ্মশানের ভেতরে পথ ভুল করে চলে এসেছি। কেমন একটা দম বন্ধ করা চাপা গন্ধ, পরিচিত কোনো বিশেষণে বিশেষায়িত করাও যায় না। চোখে পড়ল নিচতলার গোডাউনের ভেতরে তিন কোনায় তিনটি সিঁড়ির মুখ। যে সিঁড়ি দিয়েই নামেন না কেন, গোডাউনের ভেতর দিয়েই বের হতে হবে। প্রায় হাজার ফুট লম্বা গোডাউনের যে দুটি দরজা তার পরিসর খুবই ছোট। ঠেলেঠুলে দু'জন বের হওয়া যায়, তার বেশি নয়। গোডাউনের এক কোনায় পুড়ে যাওয়া একটা যন্ত্র ঠিক বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমারের মতো। ছবি তুললাম মোবাইল ক্যামেরায়। পরে অনেককে দেখিয়েছি, সবাই বললেন, এটা তো ট্রান্সফরমার। কারখানার কয়েকজন শ্রমিকের কাছেও জেনেছি গোডাউনের ভেতরেই ছিল এই ট্রান্সফরমার। স্থানীয় পল্লী বিদ্যুতের একজন কর্মী জানিয়েছিলেন, কারখানার ভেতরে একটা ট্রান্সফরমার থাকতে পারে, আরও অনেক কারখানার ভেতরেও ট্রান্সফরমার বসানো আছে। তবে তাজরীনের আগুন ট্রান্সফরমার থেকে নয়, তা শুধু পল্লী বিদ্যুতের কর্মী নন, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরাও জানান। অবশ্য কেউই আগুনের উৎস সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু জানাতে পারেননি। ঘটনার পর বেশ কয়েকজন বেঁচে যাওয়া আহত শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলেছি। তাদের প্রত্যেককে জানিয়েছেন, আগুন লাগার পর যখন ফায়ার অ্যালার্ম বেজে ওঠে, তখন প্রতি ফ্লোরের দু'পাশের দরজা বন্ধ করে দেন ফ্লোর ইনচার্জ এবং প্রোডাকশন ম্যানেজাররা। যে কারণে জানালা ভেঙে লাফ দেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না ওই অগি্নকুণ্ড থেকে বের হওয়ার। আগুন লাগার পর ঘরের দরজা বন্ধ করে দেওয়ার বর্বরতাকে কার সঙ্গে তুলনা করা যায়? এই দরজা বন্ধ করে দেওয়ার কারণেই এত মানুষের জীবন্ত দগ্ধ হওয়া। এর দায় কার?
২০০৫ সালে বাইপাইলে 'স্পেকট্রাম গার্মেন্ট' ভবন ধসে পড়ার পর সেখানেও পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য যেতে হয়েছিল। একটা দৃশ্য এখনও চোখে ভাসে, মনে হলে রক্ত হিম হয়ে যায়। স্লাইসের মতো করে একটার ওপর আর একটা ফ্লোর ধসে পড়েছে। ঘটনার পর ঘণ্টা দুয়েক পার হয়েছে। ভবনের উত্তর পাশে দাঁড়িয়ে দেখলাম, মাত্র দুই-তিন ফুট উঁচুতে বিধ্বস্ত ভবনের ভেতর থেকে একটা হাত বের হয়ে নড়ছে। আট-দশ মিনিট কিংবা তারও বেশি কিছু সময়। হাতটা স্থির হয়ে গেল। সেই দৃশ্য আজও ভুলতে পারি না। ঘটনার দু'বছর পর ২০০৭ সালের এপ্রিল মাসে স্পেকট্রামের মালিক শাহরিয়ার সাহেব আমার তৎকালীন কর্মস্থল জনকণ্ঠে এসেছিলেন। সিটি এডিটর ওবায়দুল কবির ভাই তার সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। অঝোরে কাঁদলেন দাড়ি-টুপি পরা শাহরিয়ার সাহেব। ওই ঘটনার পর থেকে তার জীবন যন্ত্রণার অনেক কিছুই শোনালেন। ভবন ধসে পড়ার কারণ হিসেবে জানালেন, তদন্তে দেখা গেছে ভবনটি নির্মাণের সময় ভিত্তির একটি কলাম ত্রুটিপূর্ণভাবে নির্মাণ করেছিলেন রাজমিস্ত্রিরা। সেই ভুলের মাশুল দিতে জীবন দিয়েছিলেন ৭৪ জন নিরীহ শ্রমিক, আর কেউ নয়! শাহরিয়ার সাহেব জানালেন, তিনি সেখানে নতুন করে কারখানা নির্মাণ করছেন এবং সেটা হবে শুধু শ্রমিকদের জন্য। তার শেষ কথাটা খুব মনে ধরেছিল। 'ভাই, এখন বুঝি শ্রমিক না বাঁচলে কোনো মালিক বাঁচবেন না, দেশও বাঁচবে না। তাই এখন নিজের যা কিছু আছে তার সবকিছু দিয়ে যাব শ্রমিকদের জন্য। সে জন্যই নতুন করে কারখানা করছি। আপনারা দোয়া করবেন, একটু সমর্থন দেবেন।' তাজরীনের ঘটনার পর মালিক দেলোয়ার হোসেনও সেই সুরে সাংবাদিকদের বললেন, 'এতগুলো শ্রমিকের লাশ দেখার পর আমার বেঁচে থাকাও অর্থহীন মনে হচ্ছে। আমি শেষ হয়ে গেছি।' বিজিএমইএ ভবনে তিনি যখন এই আক্ষেপ করছিলেন, তখন তার পাশে অন্য গার্মেন্ট মালিকরা মিডিয়ার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করছিলেন। 'গার্মেন্টে একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই ফলাও করে প্রচার করে মালিকদের চরিত্র হনন করা হয়', 'দেশের অর্থনীতি না ভেবে গার্মেন্ট শিল্পকে ধ্বংস করছে মিডিয়া' এমন নানা অভিযোগ। এই মালিকদের অভিযোগ শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল, স্পেকট্রাম, তাজরীনের মালিকের মতো নির্মম ট্র্যাজেডির মুখোমুখি না হলে কি এই মালিকরাও শ্রমিকের জীবনের দাম ঝুববেন না? আমার চারপাশে যে কঙ্কালগুলো ঘুরে বেড়াচ্ছে কেন তারা এই মালিকদের আশপাশে থাকে না?

রাশেদ মেহেদী :সাংবাদিক

No comments

Powered by Blogger.